কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) সাম্যবাদের সার্থক রূপকার। তিনি কবিতার মাধ্যমে সাম্যের গান গেয়েছেন, মানবতার জয়গান করেছেন। তিনি সমাজের পিছিয়ে-থাকা নারীকে উদ্বুদ্ধ করতে চেয়েছেন, শোষিত-অবহেলিত নারীর সাহসী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সমাজের তথাকথিত উঁচু শ্রেণীর পায়ের নিচের ভিতকে বার বার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাদের উত্থানে শ্রমিক ও নি¤œশ্রেণীর মানুষের অবদানের কথা তুলে ধরে কবিতায় এদের জয়গান গেয়েছেন। ‘সর্বহারা’, ‘সাম্যবাদী’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘ভাঙার গান’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো যেন সর্বহারাদের জন্য নিবেদিত, সাম্যবাদের অনুপম নিদর্শন।
‘ধুমকেতু’ কবিতার শুরুটাই হয়েছে দুর্দান্তভাবে- ‘আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু/এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধুমকেতু...’। এখানে মূলত স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহ, অন্যায়-অবিচার সৃষ্টিকারীদের প্রতি বিষেদাগার ও শক্তবিদ্রোহ। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের কবিতাগুলো যেন এমন বিদ্রোহের কথা বকে। অগ্নিবীণা-র পর বিদ্রোহচেতনা আরও ¯পষ্ট হয় ‘ভাঙার গান’, ‘ফণিমনসা’ ও ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থের বিভিন্ন কবিতায়। কোন কিছু সৃষ্টি করতে হলে ত্যাগ স্বীকার আবশ্যক। সৃষ্টি করতে অনেক সময় ধ্বংস করতে হয়। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় নজরুলের কণ্ঠে শুনতে পাই- ‘ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর?- প্রলয় নতুন সৃজন-বেদন,/আসছে নবীন-/জীবন হারা অ-সুন্দরে করতে ছেদন।’ পুরাতন ভেঙে নতুনকে গড়া বা স্বাগত জানানোর আহ্ববান জানিয়েছেন কবি। ‘রক্তাম্বরধারিণী মা’ কবিতায় অত্যাচারে জর্জরিত দেশবাসীকে মুক্তি দিতে হিন্দুধর্মের কালিমাতাকে আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে- ‘টুটি টিপে মারো অত্যাচারে মা,/গল-হার হোক নীল ফাঁসি,/নয়নে তোমার ধুমকেতু-জ্বালা/উঠুক সরোষে উদ্ভাসি’।
‘সাম্যের গান গাই/আমার চক্ষে পুরুষ রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।/বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর’ (নারী, সাম্যবাদী)- বহুল প্রচারিত কবিতাংশ। এটা যেন প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেছে। পিছিয়েথাকা নারীর অবদানকে তুলে ধরেছেন কবি নজরুল। নারীরা আজও অবহেলিত। এরা সমাজের নিচুস্তরের মর্যাদা পান, শ্রমের মূল্য পান কমই। ফলে কবিকে বলতে হয়েছে, ‘খোদার রাজ্যে আজ পুরুষ জালিম, নারী মজলুম’। নারী কবিতায় নারীদের গুণগান করেছেন, নারীর জয়গান গেয়েছেন। নারীকে শক্ত হতে বলেছেন, সাহসী হতে বলেছেন, স্বীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করার মন্ত্রণা দিয়েছেন এভাবেই-‘আমি মহাভারতী শক্তি নারী।/আমি কৃষতনু অসিলতা/স্বাহা আমি তেজঃ তরবারি’। মানুষকে ঘিরেই সভ্যতা, মানুষ ঘিরেই সাহিত্য। শ্রমিক ও মেহনতী মানুষের ওপর ভিত্তি করেই সভ্যতা। এদের ঘামে তথাকথিত বড়দের ভিত তৈরি। আমরা কিন্তু বেমালুম ভুলে যায় তা। নজরুল কিন্তু স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এভাবে- ‘তোমার অট্টালিকা/কার খুনে রাঙা? ঠুলি খেলে দেখ, প্রতি ইটে আছে লিখা’-(কুলিমজুর, সাম্যবাদী)। মানুষে মানুষে হানাহানি। ধর্মের দেওয়ালে মানবতা লুণ্ঠিত। নজরুলের কণ্ঠে বিস্ফোরণ- ‘কোথা চেঙ্গিস, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?/ ভেঙে ফেলো ঐ ভজনালয়ের যত তালা দেয়া দ্বার!/খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?/সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুরি-শাবল চালা!’-(মানুষ, সাম্যবাদী)।
অত্যাচারীদের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কবিতা লিখতে গিয়ে যুতসই উপমা, উৎপ্রেক্ষার ব্যবহারে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। কখনও সরাসরি কখনও প্রতীকী হিসাবে সংশ্লিষ্ট শব্দ/উপমা ব্যবহারে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন নজরুল। কিছু কবিতাংশ তুলে ধরি-
(১) ‘কাল-বাঘিনী যেমন ধরিয়া শিকার/তখনি রক্ত শোষে না রে তার/দৃষ্টি-সীমায় রাখিয়া তাহারে উগ্র চন্ড সুখে/’পুচ্ছ সাপটি’ খেলা করে আর শিকার মরে সে ধুঁকে’-(ধুমকেতু)
(২) ‘কেঁদে গেছে থামি হেথা মৃত্যু ও রুদ্র,/বিশ্বের ব্যথা যেন বালিকা এ ক্ষুদ্র!’-(মোহররম, উৎপ্রেক্ষা অলঙ্কারের প্রয়োগ)
(৩) ‘(আজ) চারদিক হতে ধনিক বণিক শোষণকারীর জাত/(ও ভাই) জোঁকের মতন শুষছে রক্ত কাড়ছে থালার ভাত’- (কৃষকের গান, সাম্যবাদী)
(৪) ‘যত শ্রমিক শুষে নিঙড়ে প্রজা,/রাজা উজির মারছে মজা’-( শ্রমিকের গান, সর্বহারা)
১৯২৫ সালে কবি নজরুল সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ বের করেন। এটি শ্রমিক, প্রজা, স্বরাজ সমাজের মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হয়। লাঙলের অফিসে বসে ‘সাম্যবাদী’ কাব্যের বেশ কিছু কবিতা লেখেন। কবি/স¤পাদক নজরুল এ পত্রিকায় সর্বহারাদের অধিকার ও মূল্যায়ন নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন। নজরুলের প্রধান সত্তা হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’- অবিচারের প্রতি, অন্যায়ের প্রতি বিদ্রোহ। বিদ্রোহ-র মতো নজরুলের আরও একটি শক্তিশালী সত্তা হচ্ছে ‘সাম্যবাদ’। সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে একইসঙ্গে অসাম্প্রদায়িক নীতিও সমানভাবে বজায় রেখেছেন। এখানেও নজরুলের কৃতিত্ব। ক্ষুদিরাম বসু, সূর্য সেন, যতীন দাস প্রমুখের সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের কথা নজরুলের কবিতায় পাওয়া যায়। বিদ্রোহী ও স্বাধীনতা চেতনায় এসব নামে অণুপ্রাণিত হন তিনি। এসব নাম স্বাধীনতার সূর্যসন্তানদের, স্বাধীনতা ও মুক্তি প্রত্যাশীদের। এছাড়া তিনি ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনেও প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজাফফর আহমদ নজরুলের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। নজরুলের সাহিত্যিক উন্মেষে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। নৈরাশ্য, সমাজের বিভিন্ন বেদনা, অস্থিরতা, দ্বন্দ প্রভৃতি নজরুলের কবিতা, সাহিত্য বা গানে উঠে এসেছে। শ্রমিক, কৃষক, নি¤œবৃত্ত মানুষের কথা, সমাজের অবক্ষয়ের কথা তার কবিতায় প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি কবিতায় ভারতীয় পুরাণ ও পশ্চিম এশীয় ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন। এখানে তিনি অনন্য। তিনি জন্মসূত্রে ভারতীয় এবং ধর্মসূত্রে মুসলমান। ফলে দু-ধারা উঠে এসেছে কবিতায়। তবে বরাবরের মতো তিনি অসাম্প্রদায়িকতার স্মারক রেখেছেন।