প্রেম ও প্রকৃতি নিয়েই রোমান্টিক কবি তাঁর স্বপ্নলোক গড়ে তোলেন। শব্দ ও ছন্দের মাধুর্যরসে কবিতাকে আপ্লুত করেন। বাংলা সাহিত্যে প্রেমের কবিতা উৎকর্ষ পায় রাধা কৃষ্ণের লীলায়। আধুনিক যুগে মাইকেলের কাব্যে রোমান্টিক ভাবাবেগের সঙ্গে প্রকাশ পেয়েছে দেহ চেতনা। বিহারীলালের কাব্যে প্রেমের ভাব বিভোরতা থাকলেও গভীরতা নেই। প্রেমের গভীরতা আবেগের বিচিত্র প্রকাশে রবীন্দ্রনাথ অদ্বিতীয়। তবে সাধারণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রকাশে তিনি ব্যর্থ। যদিও তিনি আমাদের সকলকে প্রেমে পড়তে শিখিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা প্রেম করি এবং প্রেমকে গড়ি’। প্রেম স্বর্গীয়, জগৎ জীবন নিরপেক্ষ। প্রেমিক কল্পনাপ্রসূত অর্ধেক মানসী, অর্ধেক কল্পনা। প্রেমিকার সঙ্গে দৈহিক মিলন আকাক্সিক্ষত নয় বরং প্রাত্যহিক মালিন্যে প্রেমের স্বপ্নলোক ম্লান হওয়া অনুচিত। মিলন অপেক্ষা বিরহ শ্রেয়, বিরহই চরম সান্ত¡না লাভের পথ। এর ব্যতিক্রম যা আছে তা মুখ্য নয়। এ পটভূমিতেই নজরুলের প্রেম বিচার্য। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন রোমান্টিক কবি। নজরুলের প্রেমের কবিতায় হৃদয়াবেগের তীব্রতা অতিমাত্রায় প্রকটিত। সচেতন মন দিয়ে তিনি প্রেমের বিচার করেননি। তত্ত্ব নয়, প্রেমের আবেগই তাঁকে আলোড়িত করেছে। মানবিক জীবনের অতি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি প্রেম। কিন্তু নজরুল কাব্যের স্পর্শে সুপ্ত প্রেম চেতনা যেমন জেগে উঠেছে, তেমনি প্রকৃতি পরিবেশ ও পৃথিবীকে মায়াজালের স্পর্শে অপূর্ণ করে তুলেছে। সময়ের প্রয়োজনেই তিনি দৃপ্তকণ্ঠে বিদ্রোহী বাণী উচ্চারণ করেছিলেন। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন, তাই মানুষের মহত্তম বৃত্তি প্রেমকে তিনি আত্ম অনুভবে দীপ্ত করে তুলেছেন তাঁর কবিতার অধিকাংশে। তাঁর প্রেমের কবিতায় অভিমান আছে, অভিযোগ আছে, ব্যর্থতাজনিত হা-হুতাশ আছে, আর আছে বিরহের তীব্র জ্বালা। আমরা তাঁর প্রেমের কবিতাগুলোর প্রকৃতি বিচার করে নজরুল মানসে প্রেমের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।
‘সিন্ধু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রেমের নিবিড়তা, চিরন্তনতা ও বিচ্ছেদের তীব্র জ্বালার প্রকাশ দেখা যায়। সিন্ধুর অশান্ত রূপ কবি চিত্তের বিচ্ছেদ জ্বালা পথিকের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
‘এক জ্বালা, ব্যথা নিয়া
তুমি কাঁদ আমি কাঁদি, কাঁদে মোর প্রিয়া।’
নারীর দৃষ্টিতে থাকে দহন দীপ্তি, যা জ্ঞান ও শিল্পের প্রেরণা। তাই কবিতার বিষয় হিসেবে প্রেম এবং আধার হিসেবে নারী যুগ হতে যুগান্তরে, দেশ হতে দেশান্তরে সমাদৃত ও ধৃত। নজরুলের কণ্ঠেও সর্বজনীন সত্য উচ্চারিত -
‘নারীর বিরহে নারীর মিলনে, নর পেল কবি প্রাণ
যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।’ (সর্বহারা)
নজরুল ইসলামের প্রণয়-কাব্যে কোনো উচ্চমার্গীয় দার্শনিকতা নেই। শেলী, ব্রাউনিং বা রবীন্দ্রনাথের মতো তিনি অতীন্দ্রিয় প্রেমরাজ্যে বিহার প্রয়াসী নন। রবীন্দ্রনাথের কড়ি ও কোমল কাব্যে বিবসনা, স্তন, দেহের মিলন, প্রভৃতি কবিতা রয়েছে। কিন্তু তিনি এ ধরনের কবিতায় তৃপ্তি খুঁজে পাননি। নজরুল দেহনিষ্ঠ মানবীয় ভালোবাসার প্রধান সপ্রতিভ স্তুতিকার। তাঁর অনেক কবিতায় ভোগবাদী দর্শনের প্রভাব আছে। এ ধরনের কবিতায় দৈহিক বাসনা ও কামনার নিরাভরণ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
‘তোমারে করিব পান, অনামিকা, মত কামনায়
ভৃঙ্গারে, গেলাসে কভু, কভু পেয়ালায়।’ ( অনামিকা )
আবার
‘আজ লালসা আলসমদে বিবশ রতি
শুয়ে অপরাজিতায় ধনী স্মরিছে পতি।
তার নিধুবন - উন্মন
ঠোঁটে কাঁপে চুম্বন
বুকে পীন যৌবন
উঠিছে ফুঁড়ি
মুখে কাম কণ্টক ব্রণ মহুয়া কুঁড়ি।’ (মাধবী লতা)
ভোগবাদের ক্ষেত্রে মোহিতলালের প্রভাব কাজী নজরুলের কবিতায় আছে। কবি মোহিতলাল শারীর প্রেমের কবি। সে- প্রেম অবশ্য আত্মাকে বাদ দিয়ে নয়। এছাড়াও নজরুলের কবিতায় আছে ত্রিশোত্তর কবিদের নগ্ন অনুসৃতি। প্রেম মানবাত্মার এক গভীরতম ক্ষুধা যে ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় একমাত্র প্রেমাস্পদের সঙ্গে মিলনে। যৌন কামনাকে ভিত্তি করে প্রেমের জন্ম। প্রেমের প্রতিবন্ধকতায় সৃষ্টি হয় বেদনা, বিষাদ, নৈরাশ্য। প্রেমের কবিতার জন্ম এখানেই। সুখী প্রেমের কোন ইতিহাস নেই। বিরহের বেদনাই প্রেম। নজরুলের কবিতায় নিত্যকালের নর-নারীর বিরোহী প্রাণের অশেষ কান্না ধ্বনিত হয়েছে। চির চাওয়া প্রেমের পরিণতি চির বিচ্ছেদ। মানুষ তাকেই লাভ করে সংবেদনশীলতা ও অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - ‘তুমি দেখা দিয়েছিলে বলে
গানের ফসল মোর এ জীবনে উঠেছিল ভরে
আজো নাই শেষ।’
নজরুল বলেছেন -
‘দূরের প্রিয়া। পাইনি তোমায় তাই এ কাঁদা রোল।’ (গোপন প্রিয়া)
নজরুলের শরীরনিষ্ঠ সাধনায় অসংযম বা অশ্লীলতা নেই। এ দেহসর্বস্ব প্রণয়েও পবিত্রতা এবং সুষমা কোথাও অস্বীকৃত হয়নি। নজরুল শারীর- প্রেমের সাধক হলেও আত্মার অস্তিত্ব ও প্রভাব অস্বীকার করেননি। এজন্য উদ্বেল ভাবাবেগে কবি
এখানে-সেখানে দেহের সঙ্গে আত্মাকে এবং আত্মার সঙ্গে দেহকে টেনে এনেছেন। ফলে অনেক ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য অস্পষ্ট হয়েছে; অসামঞ্জস্য এবং অসঙ্গতি দুর্লভ নয়।
‘পূজারিণী’ কবিতায় কবির চিত্তবিক্ষোভ আছে, তেমনি আছে চিরন্তন প্রেমের জগতে শান্তির সন্ধান। নারীর প্রেমে ব্যর্থ কবি বলেন,
‘এরা দেবী, এরা লোভী
ইহাদের অতি ভীরু মন
এক পেয়ে তুষ্ট নয়, একজনের সুখী নয়,
যাচে বহু জন।’
আবার এ কবিতায় কবি চিরন্তন প্রেমের আকাক্সক্ষা প্রকাশ করেছেন। জন্ম-জন্মান্তরের মানসীকে তিনি চিনতে পেরেছেন।
‘তুমি দেবী চিরশুদ্ধা তাপস কুমারী, তুমি মম চির পূজারিণী।
যুগে যুগে পাষাণে বাসিয়াছ ভালো,
আপনারে দাহ করি মোর বুকে জ্বালায়েছ আলো।’
নজরুল ইসলামের পূজারিণী ও অনামিকা কবিতা আর মোহিতলালের ‘মানস-লক্ষ্মী’, আবদুল কাদিরের ‘লাবণ্যলতা’, গোলাম মোস্তফার ‘পাষাণী’, শাহাদত হোসেনের ‘উপেক্ষিত’ প্রায় একই জাতীয় কবিতা।
প্রেমের সার্থকতা ভোগে নয়, ত্যাগে। মিলনে নয়, বিরহে। তাই কবিতাগুলো উজ্জ্বলতা পেয়েছে। ‘চক্রবাকে’র ত্যাগ ও বিরহ অনুভবে এ কাব্যে কবি প্রকৃতির মাঝে বিরহকে উপলব্ধি করেছেন। ‘চক্রবাক ও চক্রবাকী’র বিরহ প্রতীকে তিনি নিজ জীবনের বিরহকে অবলোকন করেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘প্রকৃতির মাঝে আত্মভাবের বিস্তার এবং একই সঙ্গে প্রকৃতির উপাদান সান্নিধ্যে অন্তর ভাবনার উন্মোচন রোমান্টিক কবির সহজাত বৈশিষ্ট্য। ‘চক্রবাক’ কাব্যে নজরুলের এই রোমান্টিক সত্তার প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ইতোপূর্বের কাব্যসমূহেও আমরা নজরুলের প্রকৃতি চেতনার পরিচয় পেয়েছি কিন্তু ‘চক্রবাক’ এ এসে লক্ষ্য করছি, এখানের প্রকৃতি নজরুলের প্রজ্ঞাশাসিত ও অভিজ্ঞতালব্ধ মানসতার স্পর্শে এসে হয়ে উঠেছে সংযত, সংহত এবং শূন্যতা তথা বেদনার প্রতীকী ধারক।’
প্রকৃতি বর্ণনায়ও কবির সৌন্দর্যপ্রিয় মনের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’ কবিতায় গুবাক তরুকে প্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। চিত্রময়তার সঙ্গে সঙ্গীতময়তার অপূর্ব মিলনে কবিতাটি একটি সার্থক প্রেম কবিতার মর্যাদা পেয়েছে। এ কবিতায় কবির বিরহ তপ্ত হৃদয়ে শান্তির পরশ লেগেছে। বিরহের তপ্ত আগুনে পুড়ে পুড়ে কবির অশুদ্ধ মন শুদ্ধ হয়েছে। প্রেমের এ অমরত্বে নজরুলের স্বঘোষিত নীরবতা -
‘তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না,
কোলাহল করি সারাদিনমান কারো ঘুম ভাঙিব না।
নিশ্চল নিশ্চুপ
আপনার মনে পুড়িব আমি গন্ধ বিধুর ধূপ।’
জীবনে যতই কালিমা, মলিনতা থাক না কেন, শেষ পর্যন্ত প্রেমই মানুষের আশ্রয়। যে আশ্রয় নজরুল-উত্তর সাহিত্যে বনলতা সেন, কঙ্কাবতী, মালতী নামে কাব্যে বন্দিনী। প্রেমকে জৈবিক বৃত্তি না জেনে, তাকে বিস্ময় বেদনা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করায় নজরুলের কবিতায় প্রেমানুভূতি গভীরতা পেয়েছে। অতৃপ্তি ও বেদনা চিরদিন প্রেমিক বহন করে নীরবে নিভৃতে। মানবমনের চিরন্তন আবেগ তাঁর কবিতায় গাঢ় হয়ে ধরা দিয়েছে। নজরুলের প্রেমিক-প্রেমিকার শুভ দৃষ্টি হয় সকলের অন্তরালে, তারা বাসর সাজায় মৃত্যু আর অন্ধকারের নীলপুরীতে। প্রেমের ক্ষেত্রে তারা হৃদয়সর্বস্ব। আত্মদান ও আত্মত্যাগের মহিমায় নজরুলের প্রেম অমর। শেষ পর্যন্ত নজরুলের প্রেমানুভূতি সংসার ও সময়ের গ-ি পেরিয়ে সীমাকে ছেড়ে অসীমের রূপকে অতিক্রম করে অসীম অপরূপের দিকে যাত্রা করেছে। এক জনমের প্রিয়া চির জনমের প্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। নজরুলের কাব্যে প্রেম অবিনশ্বর সম্পদ। ব্যথার নীলোৎপল। দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মান-অভিমান, বেদনা-ঈর্ষা সবকিছুর পরও নজরুল কাব্যে প্রেমের রয়েছে প্রাপ্তি। তাই কবিতাগুলো আজও শৈল্পিক সুষমায় উৎকৃষ্ট এবং চির ভাস্বর।