
‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসীগণে,/প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া।/কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি,/বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া...’- ‘মাতৃসম মাতৃভাষা’ কবিতায় কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের এভাবেই দেশপ্রেমের প্রগাঢ় প্রকাশ। তাঁর দেশপ্রেম এবং নীতিমূলক কবিতাগুলোই অধিক জনপ্রিয় ছিল। ‘কে?’ অথবা ‘মানুষ কে?’ নীতিমূলক-কবিতার মতো কবিতাগুলো এখনও আমাদের মুখে মুখে। কিছু কবিতাংশ তো প্রবাদতুল্য মর্যাদাও পাচ্ছে।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (জন্ম : ৬ মার্চ, ১৮১২-মৃত্যু : ২৩ জানুয়ারি, ১৮৫৯) যুগসন্ধির কবি। বিখ্যাত সাহিত্যসাময়িকী ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর স¤পাদক। বলা যায় যে, তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তাঁর ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন শেষের পথে, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে কবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নীতিমূলক অনেক কবিতা আমরা কথাপ্রসঙ্গে তুলে ধরে থাকি। এমন কিছু কবিতাংশ-
(১) ‘বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,/সর্ব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।/বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,/সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।/বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,/হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে। বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে, নিজ বোধ আছে যার জ্ঞানী বলি তারে।’- (কে, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
(২) ‘চেষ্টা যত্ন অনুরাগ মনের বান্ধব।/আলস্য তাদের কাছে রণে পরাভব।।/ভক্তিমতে কুশলগণে আয় আয় ডাকে।/পরিশ্রম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।/চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে জীবনের আশা।/যতনে হৃদয়েতে সমুদয় বাসা।।/স্মরণ স্মরণ মাত্রে আজ্ঞাকারী যার। মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?’-(মানুষ কে?, ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় মানুষ, মানবতা নিয়ে ভাবনার বহির্প্রকাশ পাই। এক্ষেত্রে তিনি রূপকাশ্রয়ীও হয়েছেন। তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যঙ্গাত্মক কবিতা, প্রচুর যমকের ব্যবহার, রূপকের মাধ্যমে সামসময়িক রাজনীতি ও সমাজের নানা অসঙ্গতি তুলে ধরা। গুপ্তের দেশপ্রেম ছিল তীব্র ও বিশুদ্ধ। তাঁর পূর্বে বাংলাভাষায় কোন কবির তীব্র দেশপ্রেমের এমন কবিতা কমই পাওয়া যায়-
(১) ‘জননী ভারতভূমি আর কেন থাক তুমি/ধর্মরূপ ভূষাহীন হয়ে।/তোমার কুমার যত সকলেই জ্ঞানহত/মিছে কেন মর ভার বয়ে?’
(২) ‘যে ভাষায় হয়ে প্রীত পরমেশ-গুণ-গীত/বৃদ্ধকালে গান কর মুখে।/মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা/তুমি তার সেবা কর সুখে।’-(মাতৃভাষা , ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)।
‘বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী, মুখে গন্ধ ছুটে’ অথবা ‘সিন্দুরে বিন্দুসহ কপালেতে উল্কি।/নসী জশী ক্ষেমী বামী, রামী শ্যামী গুল্কী’- বাঙালী মেয়েদের ইংরেজীপনা নিয়ে তীব্র শ্লেষাত্মক কবিতাগুলো যেন এক একটি শেল। দেশী বনাম বিলিতি টানাপড়েন ছিল দীর্ঘদিনের। ইংরেজী শিক্ষিত বাঙালীর ‘বুলি’ আর ‘মাতৃভাষা’ বাংলার দ্বন্দ্ব ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায়ও দেখা যায়। নতুন প্রজন্মকে তাঁর কটাক্ষ, ‘যত কালের যুবো যেন সুবো/ইংরেজী কয় বাঁকাভাবে’। বাঙালী নবপ্রজন্ম বিলাতি কায়দায় রপ্ত হবে বলে তাঁর আশঙ্কা, ‘সব কাঁটা চামচে ধোরবে শেষে/পিঁড়ি পেতে আর কি খাবে’? একদিকে আধুনিকতার প্রতি অনুরাগ অন্যদিকে প্রাচীন সংস্কারের প্রতি দুর্বলতা ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের দ্বৈতসত্তার বিষয়টিকে অনেক সময় কবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। তারপরও কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আধুনিক চিন্তাকেই গ্রহণ করে কাব্যসাধনায় বিভিন্ন বিষয়কে কবিতার উপাদান করেছেন। আরও কয়েকটি উদাহরণ-
(১) ‘গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে।/ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁসে ॥/রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম।/ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানি ড্যাম ড্যাম ড্যাম ॥/ পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম।/মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম?/শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম। বেলাক নেটিভ লেডি শেম শেম শেম ॥’-(ইংরেজী নববর্ষ)
(২) ‘মিছা কেন কুল নিয়া কর আঁটাআঁটি।/এ যে কুল কুল নয় সার মাত্র আঁটি।।/কুলের গৌরব কর কোন অভিমানে।/মূলের হইলে দোষ কেবা তারে মানে’-(কৌলীন্য)।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও বহুবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করে কবি-সাহিত্যিকদের উৎসাহ প্রদানের জন্য সমসাময়িককালে তিনি ‘কবিগুরু’ হিসাবে আখ্যায়িত হয়েছেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।
বাংলার নবজাগরণ ও নীল বিদ্রোহের প্রতি মানুষকে সহানুভূতিশীল করে তোলার ক্ষেত্রে এই সংবাদপত্রের বিশেষ প্রভাব ছিল। ১৮৫৩ সাল থেকে পত্রিকাটির মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মাসিক সংবাদ প্রভাকরে ঈশ্বরচন্দ্র প্রাচীন বাংলার কবিয়াল ও গীতিকারদের জীবনী ও কর্মগাথা সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। নারীশিক্ষার প্রসার, বিধবা বিয়ে ও কৌলিন্য প্রথার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রভাকরের অবস্থান ছিল সুদৃঢ়।
‘তুমি মা কল্পতরু, আমরা সব পোষা গোরু,/শিখি নি সিং বাঁকানো,/কেবল খাব খোল বিচালি ঘাস।/যেন রাঙ্গা আমলা, তুলে মামলা,/গামলা ভাঙ্গে না।/আমরা ভুসি পেলেই খুসি হব,/ঘুসি খেলে বাঁচব না।’-(পাঁঠা)। এখানে রূপকের মাধ্যমেই সমাজের স্তরবিন্যাস (উঁচু-নিচু) ও ভোগের বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছেন।
কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ব্যঙ্গ ও বিদ্রƒপের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয় সহজভাবে প্রকাশ করতেন। আমরা তাঁর কবিতায় ব্যঙ্গবিদ্রƒপের বিষয়টি প্রবলভাবে লক্ষ্য করি।
ব্যঙ্গ কবিতা, প্রচুর যমকের ব্যবহার, রূপক শব্দাবলি ব্যবহারে সমাজের অসঙ্গতির প্রতিবাদ করেছেন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। এসবের মাধ্যমেই তাঁর কবিতায় দেশপ্রেমের কথা উঠে এসেছে।