
৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে ১ জুলাই ২০২০ থেকে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ এই পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন ২০২০ এর ২৯ ডিসেম্বর। ২০৪১ সালে দেশের দীর্ঘ মেয়াদী ২০২২-৪১ সালের প্রক্ষেপিত উন্নয়ন কাঠামোয় এটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে, ২০২১ এর ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদ বা জিডিপি বেড়ে আসবে ৭.১৩%। কোভিড-১৯ এর তাণ্ডবের পটে অর্থনীতির উপরোক্ত হারে বাড়া বাংলাদেশকে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত হারে বেড়ে ওঠা অর্থনীতি সমূহের সারিতে স্থান দিয়েছে। ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে এই দেশে কারখানাজাত শিল্প বেড়েছে বার্ষিক ১২.৭% আর এই পরিকল্পনায় পাঁচ বছরে উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তীয় বিনিয়োগ হয়েছে মোট অভ্যন্তরণীয় উৎপাদ বা জিডিপির ৩১.৬%। মাথাপিছু জাতীয় আয় বেড়ে হয়েছে বার্ষিক ২০৬৪ ডলার। ২০১৫ সালে দেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থানরত ২৪.৮% লোকসংখ্যার তুলনায় ২০২০ এ দারিদ্র্যসীমার নিচে আপতিত লোকসংখ্যা নেমে গেছে ১০.৫%। আর মুদ্রাস্ফীতির হার কমিয়ে আনা হয়েছে ৫.৫% এ। এই পটে কোভিড-১৯ এর ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে সরকার সন্দিপনীয় কার্যক্রমে প্রযুক্ত করেছে ১১৯৬০৪ বিলিয়ন টাকা, যা মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদের ৪.৩%।
কোভিড-১৯ উৎসারিত অন্তরায় সত্ত্বেও ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার এরূপ সফলতার পটে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় মূলত একই মৌল কৌশল অনুসরণের প্রস্তাব করেছে। অবশ্য ৭ম পরিকল্পনার তুলনায় ৮ম এ অভিজ্ঞতার আলোকে সামাজিক প্রকৌশলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আয় বৈষম্য সর্ব পর্যায়ে দূরীকরণ, কর্মসংস্থানের ব্যাপ্তি বাড়ানো এবং পানি সম্পদের নিপুণতর ব্যবহার এবং জলবায়ু ও পরিবেশের প্রতি অধিকতর দৃষ্টি দেয়া সমীচীন হবে বলে ধরা হয়েছে।
৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষ বছর ২০২৫ এ মাথাপিছু মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ৭.৩৩% হারে উন্নীত হবে বলে প্রক্ষেপিত হয়েছে। তেমনি ২০২১ এর ৩১.৮৪% থেকে ২০২৫ সালে মোট জাতীয় সঞ্চয় বাড়বে জিডিপির ৩৪.৪৮%। এই সঞ্চয়কে ভিত্তি করে মোট জাতীয় বিনিয়োগ উঠে আসবে জিডিপির ৩৬.৫৯% এ। ব্যক্তি বিনিয়োগ হবে জিডিপির ২৭.৩৫% এবং গণবিনিয়োগ হবে জিডিপির ৯.২৪%। জিডিপির ৩% পরিমাণ বিনিয়োগ আসবে বিদেশ থেকে বা বিদেশীদের মাধ্যমে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। মাথাপিছু আয় ২০২০ এর ২০৬৪ মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৩০৫৯ মার্কিন ডলারে।
পরিকল্পনাবিদদের বিবেচনায় আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হবে বিদ্যুত। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০১৯ সালের ২২৭৮ মেঃ ওয়াটের তুলনায় ২০২৫ এ বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে ৩৫৮০০ মেঃ ওয়াটে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের সকল গৃহস্থালীতে বিদ্যুতের লভ্যতা নিশ্চিত করা হবে। বিদ্যুতের সর্বজনীন লভ্যতা সকল উৎপাদন ও সেবা ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর সঙ্গে বাড়াবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অদম্য আত্মবিশ্বাস। একই সঙ্গে সারা দেশকে একটি একক বাজার ও উৎপাদন নিলয় হিসাবে গড়ে তুলতে ৫৫০ কিঃমিঃ ৪-৮ লেনবিশিষ্ট সড়ক ও ৯৮০০ কিঃমিঃ জাতীয় জলপথের উন্নয়ন, ৩৭৩০০ মিটার ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করা হবে, ৭৯৮ কিঃমিঃ নতুন রেলপথ নির্মাণ, ৮৯৭ কিঃমিঃ রেলপথকে ডুয়াল গজে উন্নয়ন, প্রতিটি জেলায় রেল সংযোগ স্থাপন, অভ্যন্তরীণ নৌপথের সমন্বিত উন্নয়ন, পায়রা, মাতারবাড়ী, মংলাসহ চট্টগ্রাম বন্দরের আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণ এবং পরিবহন ও যোগাযোগ এর গ্রাম বিস্তৃত উন্নয়নে সর্বমোট ২২৩৬.৫ বিলিয়ন টাকার বিনিয়োগ প্রক্ষেপিত হয়েছে। সারাদেশে বিদ্যুতের লভ্যতা ও একক বাজারের বিস্তৃতি সর্বক্ষেত্রে উৎপাদন, ভোগ ও রফতানি বাড়ানোর শক্ত ও পারস্পরিক সম্পর্ক যুক্ত অর্থনৈতিক ভিত স্থাপন ও প্রসারিত করবে। এসব ক্ষেত্রে এরূপ বিশাল উন্নয়ন ও বিনিয়োগ এর আগে কখনও প্রস্তাবিত হয়নি।
৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে শিল্প উৎপাদনের হার সমকালীন বার্ষিক ১০.৮% থেকে ২০২৫ সালে ১১.৯% এ বেড়ে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদের ৪২% এ উপনীত হবে। এর মধ্যে কারখানাজাত শিল্পের অবদান দাঁড়াবে ৩০.২৩% কৃষি উৎপাদন ২০২০ এ জিডিপির ১৩.৩৫% ভাগ থেকে ২০২৫ সালে বৃহত্তর জিডিপির ১০.৫৬% এ থাকবে। এই ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হার ২০২৫ সালে প্রক্ষেপিত হয়েছে বার্ষিক ৩.৬% এ। ২০২৫ সালের জিডিপিতে সেবা খাতের অংশ দাঁড়াবে পরিবর্ধিত জিডিপির ৪৭.৫৮%।
কোভিড-১৯ উৎসারিত চেতনা বোধ ৮ম পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য খাতে ২০১৩ সালে জিডিপির ০.৭% বরাদ্দ থেকে ২০১৫ এ জিডিপির ২% ভাগে উন্নীতকরণের প্রক্ষেপণ করেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে যেখানে ২০২১ সালে বরাদ্দ ছিল ১৭০ বিলিয়ন টাকা, সেখানে ২০২৫ এর বরাদ্দ বাড়িয়ে ৩৩৬.১ বিলিয়ন টাকায় স্থিরীকৃত হয়েছে। এই পরিমাণ বিনিয়োগের ফলশ্রুতিতে গড় জীবন প্রত্যাশা ৭২.৬ বছর থেকে ৭৪ বছরে উন্নীতকরণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২% নামিয়ে এনে অপরিবর্তনশীল সংখ্যায় সংরক্ষণ করা, সকল ক্ষেত্রে সংক্রমণীয় রোগ নিবারণ, পুষ্টির মানোন্নয়ন, সকল জনগণের জন্য নিরাপদ পানি সরবরাহ, পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসার বিস্তৃতি ও উন্নয়ন এবং চিকিৎসা ও সেবা শিক্ষার প্রসার এবং স্বাস্থ্যবীমার প্রচলন উন্নয়নের সুফল সকল আয় শ্রেণীর কাছে পৌঁছে দেবে বলে বলা হয়েছে। সামাজিক সুরক্ষার বলয় বিস্তৃতকরণের উদ্দেশ্যে দরিদ্র ও অসহায় জনগণের অনুকূলে আয় বিতরণ গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হিসেবে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গৃহীত হয়েছে।
সামাজিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাকে ৮ম পরিকল্পনায় এর আগের সকল পরিকল্পনার তুলনায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সরকারের শিক্ষা বাজেট জিডিপির ২% থেকে ২০২৫ সালে পরিবর্ধিত সরকারী বাজেটের ৪% উন্নীত করা হবে। পরিরকল্পনা কালের শেষে বয়স্ক শিক্ষা ১০০% এ উন্নীত হবে। বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে শিক্ষাকে প্রত্যক্ষভাবে জাতীয় আয় বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে প্রয়োগ করা হবে বলে কার্যক্রম প্রণীত হয়েছে। সম্প্রদায় হিসেবে পেছনে থাকা জনগোষ্ঠী যথাÑ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শারীরিক প্রতিবন্ধকতার শিকার জনগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গসহ অন্যান্য অবহেলিত সামাজিক গোষ্ঠীকে জাতীয় জীবনের মধ্যস্রোতে নিয়ে আসা হবে। অক্ষম ব্যক্তিদের ভিক্ষা বৃত্তি থেকে মুক্তি দেয়া হবে। সমকালে দরিদ্র ও বিপদসঙ্কুল জনগোষ্ঠীর সামাজিক অন্তর্ভুক্তিতে জিডিপির ১.২% বরাদ্দ ও ব্যবহারকে ২০২৫ সালে পরিবর্ধিত জিডিপির ২.৫% উন্নীত করা হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সরকারী বাজেটের এই আকারের কল্যাণধর্মী পরিবর্তন এর আগের কোন বাজেটই দেখা যায়নি।
এই সকল লক্ষ্য অর্জনে ৮ম পরিকল্পনাকালে মোট ৬৩.৬ ট্রিলিয়ন টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এর মধ্যে ৭৫% বিনিয়োগ হবে ব্যক্তিখাতে, তার ২৫% হবে গণখাতে। প্রাকৃতিক অবকাঠামো নির্মাণ ও প্রসারণে এবং সামাজিক সুরক্ষা বিস্তৃতকরণে প্রধানত গণখাত প্রযুক্ত হবে। ব্যক্তিখাত মূলত মুক্ত উদ্যম সূত্র অনুসারী হয়ে উন্নয়নশীল প্রযুক্তির ধারক হয়ে ভূমিকা পালন করবে। সার্বিকভাবে সেবাখাত অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের সেতুবন্ধন হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। সেবাখাতে ২০২১ সালের মোট বিনিয়োগ ৩৬১০ বিলিয়ন টাকা ২০২৫ সালে ৬৯৪৪ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত করা হবে। সেবা খাতে এই উন্নীত বিনিয়োগ হবে ২০২৫ সালের জিডিপির ১৮.৬%, যার মধ্যে ব্যক্তি বিনিয়োগ হবে জিডিপির ১৪% এবং গণবিনিয়োগ জিডিপির ৪.৬%।
গত শতাব্দীর শেষ ভাগে উন্নয়ন অর্থনীতির মৌল বিবেচ্য বিষয় ছিল সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়িয়ে পরিসংখ্যানের হিসেবে মাথাপিছু আয় বাড়ানো। বিভিন্ন দেশে পরবর্তীকালের অভিজ্ঞতার আলোকে অর্থনীতিবিদরা মাথাপিছু আয়ের উৎসারণ ও ব্যবহার ক্রমে দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক সমতা অর্জনকে উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য সূচক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। দেশের সংবিধানে পরিকল্পিত বিকাশের মাধ্যমে সকল নাগরিকের অনুকূলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য সেবা ও যুক্তিসঙ্গত বিনোদনের নিশ্চয়তা বিধানের অনুজ্ঞা দেয়া হয়েছে। (১৫ অনুচ্ছেদ) সর্বজনীন ও একই মাপের অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা সকলকে ওপরে ওঠার সিঁড়ি উন্মুক্ত করা ও রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছে (১৭ অনুচ্ছেদ)। উৎপাদন ও বিতরণ রাজনৈতিক সামাজিকভাবে সমর্থনীয় সামাজিক ভুক্তি অনুগামী হবে বলে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কেবলমাত্র মাথাপিছু উৎপাদন বা আয় বাড়লেই উন্নয়ন অর্জিত হয় না বলে আমরা অর্থনীতিবিদরা এখন একমত। যুগ প্রেক্ষিতে উন্নয়ন কার্যক্রমের এরূপ সম্পূর্ণতাকে গ্রহণ ৮ম পরিকল্পনাকে আগের পরিকল্পনা সমূহের তুলনায় প্রশংসনীয় বিশিষ্টতা দিয়েছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যক্রমে এরূপ বিশিষ্টতা প্রদান জননেত্রী শেখ হাসিনার দেশের সাধারণ জনগণ, বিশেষত দারিদ্র্য সীমার নিচে আপতিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের অনুকূলে আদর্শিক আনুগত্যের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় তার এই প্রশংসনীয় প্রয়াসে যথার্থ সহায়তা দিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আবদুল মান্নান ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারন অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ড. শামসুল আলম এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অর্থনীতিবিদদের প্যানেল প্রধান ড. ওয়াহিদউদ্দীন মাহমুদ। তাদের সকলের নিষ্ঠা ও কাজ অভিনন্দনযোগ্য।
৮ম পরিকল্পনার প্রশংসনীয় লক্ষ্যাদি অর্জনের জন্য ও পথে কয়েকটি বিষয়ে অধিকতর মনোযোগ ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এক, ব্যক্তিখাতে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর কাঠামো ও পথক্রম অধিকতর বিশ্লেষণ ও বিন্যস্ত করা প্রয়োজন। ব্যক্তি সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে সঞ্চয় ও বিনিয়োগের আরও সাম্যধর্মী হাতিয়ার ও প্রক্রিয়া এবং ক্ষেত্রাদি শনাক্তকরণ এবং সেই পথে অগ্রসর হওয়া পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থার সমকালীন শ্লখতা এমনকি ক্ষেত্র বিষয়ে অকর্মন্যতা দূর করে একে একটি চলিষ্ণু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় উন্নীতকরণ সকল শ্রেণী কর্তৃক সঞ্চয় ও বিনিয়োগ বাড়ানোর পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। ব্যাংক ব্যবস্থার মূলধন ঘাটতি, তারল্যের বৃদ্ধি, বড় উদ্যোক্তাদের ঋণ খেলাপী, উদ্যোগী যৌথ বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে ঋণ স্বল্পতা ও ঝুঁকি মূলধনের অনুপস্থিতি দেশের ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থাকে এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজন মেটানোর লক্ষ্যে সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা সামনে নিয়ে এসেছে। তেমনি অনুধাবন ও বিবেচনার বলয়ে দেখা দিয়েছে প্রগতিশীল মূলধনের সঙ্গে শ্রম- আয়ের ওপর দর নির্ধারণ ও আয়ন। এসব সংস্কার করার কাজটি ৮ম পরিকল্পনায় কার্যকরণীয় অবয়বে স্থান পায়নি। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার দুর্বলতা, পারস্পরিক তহবিল ও বিনিয়োগ কোম্পানিসমূহের অপূর্ণতা, শেয়ার বাজারসমূহের প্রবেশাধিকার সকল শ্রেণীর বিনিয়োগকারীদের জন্য লাভজনকতার ভিত্তিতে উন্মুক্তকরণ বিষয়ে আমরা এখনও পিছিয়ে। বিদেশ থেকে শ্রমিক প্রেরিত আয়ের সৃষ্ট ব্যবহার, সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যত তহবিলের ব্যবস্থাপনা, সঞ্চয় ও সেবামূলক কাজ প্রসারণে বীমা প্রতিষ্ঠান সমূহের ফলপ্রসূতা বিষয়ে যথাপ্রয়োজন পদক্ষেপ নেয়ার পরিধি এখনও বিস্তৃত। আর্থিক লেনদেন সম্পর্কিত আইন ও বিচারিক কাঠামো দুর্বল ও শ্লখ। এসব লক্ষ্যে একটি অর্থ কমিশন বা কমিটি গঠন করে যথার্থ পদক্ষেপগুলো বিস্তারিতভাবে শনাক্ত করে সমাধানের জন্য এগিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। দুই, উন্নয়নকে ৮ম পরিকল্পনায় বিবৃত একটি সুসংহত আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়ায় উন্নীতকরণ, বিশেষত দারিদ্র্য বিমোচন, বিস্তৃত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবার মাধ্যমে সকল নাগরিককে ওপরে ওঠার সিঁড়ি দেখিয়ে দেয়া ও লভ্য করার জন্য সকল গণ ও ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যম শনাক্ত ও গ্রন্থনা করা প্রয়োজন। ৮ম পরিকল্পনায় এসবের প্রতি দৃষ্টি দেয়া হয়েছে, কিন্তু বিস্তারিত পথক্রম নির্দেশ বা রূপরেখা করা হয়নি। বিশেষত এসব ক্ষেত্রে ও লক্ষ্যে স্থানীয় সরকারের ভূমিকা, কাজের ও সেবার পরিধি এবং অর্থায়নের ক্ষেত্র, সীমা ও প্রক্রিয়া বিস্তারিতভাবে শনাক্তকরণে আমরা এখনও এগুতে পারিনি। দারিদ্র্য বিমোচন, কর্মসংস্থানের বিস্তৃতি, শ্রম বাজারের যোগ্যতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক নমনীয়তা, পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর সামনে নিয়ে আসা ও সামাজিক কাঠামো এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সামাজিক সহায়তা, সামাজিক বীমা ও মৌলিক উৎকর্ষ বিশিষ্ট সেবা সূচারুভাবে লাগসই সামাজিক প্রকৌশলের সূত্রাদি নির্ধারণ, বিস্তার ও বাস্তবায়ন মূল্যায়নের জন্য সামাজিক প্রকৌশলবিষয়ক একটি কমিটি বা কমিশন গঠন করা লক্ষ্যানুগ হবে। তেমনি একটি স্থানীয় সরকার কমিশন গঠন করে জেলা বোর্ড পর্যায়ে গ্রহণীয় আর্থ-সামাজিক প্রকৌশলীয় পদক্ষেপসমূহ ব্যাপ্ত, গভীর ও একনিষ্ঠ করলে ৮ম পরিকল্পনায় স্থান পাওয়া জনকল্যাণমূলক ও জবাবদিহিত্বের আওতাধীন সূত্রাদি বাস্তবায়ন করা সম্ভব ও সহজতর হবে। তিন, ব্যক্তিখাত ও উদ্যমকে বিস্তৃত করার জন্য প্রয়োজন হবে নিত্যনতুন প্রযুক্তি নির্বাচন, আহরণ ও প্রযুক্তকরণ। এই লক্ষ্যে বিনিয়োগ বোর্ডকে কেবলমাত্র শিল্প উৎপাদনের স্থান নির্বাচন ও বিদ্যুত এবং জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতকরণের বাইরে প্রযুক্তির পরিচিতি ভাণ্ডার হিসেবে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সহযোগের দায়িত্ব পালনের সক্ষমতা দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে ভিয়েতনাম যে প্রক্রিয়া অনুকরণ করেছে তা আমাদের গ্রহণ করে এগিয়ে যেতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগকে যথার্থ প্রযুক্তির আমদানি ও ব্যবহারকারী হিসেবে সন্দীপিতি করতে হবে এবং একই সঙ্গে বিদেশ থেকে নতুনতর প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি ও ব্যবহার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রত্যাগত উদ্যমী ব্যক্তিদের উৎপাদনশীলতা অর্জন ও বিস্তারণের পদক্ষেপ নেয়া সঙ্গত হবে।
দেশের ১ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার প্রারম্ভিক কথায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ভাবে বলেছিলেন যে, জাতি গঠনে আমাদের সবাইকে সর্বাত্মক মাত্রায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে এগিয়ে যেতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অন্যান্য সকল পরিকল্পনার আপেক্ষিকতায় সবচেয়ে বেশি বিন্যাসিত, জনকল্যাণমূলক ও বাস্তবধর্মী জাতীয় কর্মপ্রচেষ্টার সমাহার ও প্রতিফলন। এর সফল বাস্তবায়ন এই দেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের সারিতে পৌঁছাতে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী