ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মিল্টন বিশ্বাস

এক দশকের উন্নয়ন ॥ পরিপ্রেক্ষিত গ্রামীণ জনপদ

প্রকাশিত: ০৮:৪৫, ৩০ জানুয়ারি ২০১৯

এক দশকের উন্নয়ন ॥ পরিপ্রেক্ষিত গ্রামীণ জনপদ

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০১৮) ইশতেহারে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রত্যন্ত গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেছে। দেশের যুবগোষ্ঠীকে সুসংগঠিত, উৎপাদনমুখী শক্তিতে রূপান্তর করার জন্য আগামী ৫ বছরে ১ কোটি ২৮ লাখ কর্মসংস্থান তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। বলা হয়েছে, প্রতিটি গ্রাম থেকে গড়ে ১ হাজার যুবশক্তিকে দেশের বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিটি গ্রামকে শহরের মতো করে উন্নত করার অঙ্গীকার অর্থাৎ শহরের সমান সুবিধা পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি যা ইশতেহারে এবার ব্যক্ত করা হয়েছে তা গত ১০ বছরে উন্নয়নের ধারাবাহিকতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ১৬ মার্চ ‘স্বল্পোন্নত’ দেশ থেকে ‘উন্নয়নশীল’ দেশের মর্যাদা লাভ করেছে। এর আগে দীর্ঘ ৪২ বছর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় ছিল এদেশ। উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, অতীতে এই সরকার গ্রামীণ জনপদে পরিবর্তনের অঙ্গীকারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। তাছাড়া বর্তমান সরকারের রয়েছে ধারাবাহিকতা। ফলে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গতি পেয়েছে। গ্রামের অর্থনীতির প্রায় সমগ্রটা জুড়ে আছে কৃষি আর গ্রামীণ উৎপাদন কাঠামো, গত ১০ বছরে সেই গ্রামের উন্নয়নের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসের ধারায় বর্তমান সময়ে ভিন্নতর এক মাত্রা সংযুক্ত হয়েছে। এ সময় (২০০৯-২০১৮) সরকারী বাজেটে গ্রামাঞ্চলের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ॥ দুই ॥ বাংলাদেশে মোট গ্রাম আছে ৮৭,৩১৬টি। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১৮,১৩৮টি। সবচেয়ে কম গ্রাম বরিশাল বিভাগে মাত্র ৪০৯৭টি। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে ১১ কোটির বেশি লোকের বাস রয়েছে এসব গ্রামে। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করে। সমতল এলাকা ছাড়াও গ্রামীণ জনপদে রয়েছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য- কোথাও রয়েছে হাওড় ও জলাভূমি, আবার কোথাও বা পার্বত্যভূমি। আছে এদেশে অন্তর্ভুক্ত ছিটমহলের নতুন বাসিন্দারা। কোথাও বা সাগরের তটরেখা বিদীর্ণ করে চলে গেছে জনবসতি। কোথাও বা অরণ্যের বৃক্ষছায়ায় বসতি গড়েছে এদেশের মৃত্তিকার সন্তান। রয়েছে নদীর বুকে ভাসমান জীবনও। মনে রাখতে হবে, ভারতীয় গ্রামের উদ্ভবের সঙ্গে বাংলাদেশের গ্রামের উদ্ভবের বিষয়টি অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত। এজন্য ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ গ্রামের সেই অতীত ধারণা যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অভিঘাতে পাল্টে যায় তখন বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনও পাল্টাতে থাকে। যদিও দীর্ঘকাল সেই গ্রাম ছিল নিস্তরঙ্গ ও পরিবর্তন শূন্য। এ জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলার পল্লী প্রকৃতিকে ভালবেসে লিখেছিলেন- ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমার/হেরিনু পল্লী জননী।’ আর আমরা বাল্যকালে পড়েছি- ‘আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন/মাটির তলায় এর ছড়ানো রতন।’ বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদ পাশ্চাত্য ‘ভিলেজ’ বা ‘কান্ট্রি’ ধারণা থেকে ভিন্ন। ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে গ্রাম শহরের সঙ্গে সরাসরি সকল সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সম্পৃক্ত। ব্যাপক পরিসরে গ্রামকে কেন্দ্র করে লোকালয় বা সমাজ গড়ে না উঠলেও জীবন ধারণের অনেক উপকরণ সেখানে উৎপাদিত হয়। প্রযুক্তি আর যান্ত্রিক সভ্যতার আশীর্বাদে তাদের গ্রামাঞ্চলে আধুনিক উৎপাদন ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার পর ব্যাপক নগরায়ন ও আধুনিক যান্ত্রিক সভ্যতার প্রভাবে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হতে শুরু করে। পোশাক শিল্পের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে গ্রামের বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ চাষাবাদ ও খেত খামার ফেলে তুলনামূলক সস্তা দামে নিজেদের শ্রমিক হিসেবে নাম লেখায়। অবশ্য পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের বৈশি^ক অবস্থান এখন ২য়। তবে বড় বড় শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে কুটির শিল্পের সমাদর কমেছে। ফলে কর্মসংস্থানের খোঁজে, নিজেদের নিত্যনৈমিত্তিক অভাব পূরণে ও উচ্চাশার কারণে মানুষ গ্রামীণ জীবন ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এছাড়া রয়েছে নদী ভাঙন ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে গৃহহারা মানুষের উদ্বাস্তু হওয়ার বাস্তবতা থেকে শহরমুখী হওয়ার করুণ ইতিহাস। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার ছিল একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রায়ণ, গৃহায়ন, আদর্শ গ্রাম, ঘরে ফেরা ইত্যাদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। বর্গাচাষীদের জন্য ঋণ, ক্ষেতমজুরদের কর্মসংস্থান ও তাদের পল্লী বেতনের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি- সড়ক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্রাম-ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা সদরকে সংযুক্ত করা। এসব ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত রয়েছে। একইভাবে অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং সামাজিক উন্নয়নে ২০১৪ সালে যেসব নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল তা পূরণ হয়েছে। যেমন মাথাপিছু আয়, প্রবৃদ্ধির হার, দারিদ্র্য দূরীকরণ, এসব ক্ষেত্রে আমরা সাফল্য দেখেছি। অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের প্রবৃদ্ধি যথেষ্ট ভাল। দারিদ্র্য দূরীকরণের দিকেও যদি দেখা যায়, যা লক্ষ্যমাত্রা ছিল, সরকারের অর্জন তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যে হারে দারিদ্র্য দূরীকরণ হয়েছে, সেই হারটা অবশ্যই ইতিবাচক। এর মধ্যে মাথাপিছু আয় হয়েছে ১৮০০ ডলার। যা ২০০৬ সালে ছিল ৫৪৩ ডলার। প্রবৃদ্ধির হার প্রায় ৮ শতাংশ। একজন রিকশাচালকের দৈনিক আয় ২০০৬ সালে ছিল ২০০ টাকা, ২০১৮ সালে হয়েছে ৫০০-৭০০ টাকা। পোশাক শ্রমিকের মাসিক বেতন ২০০৬ সালে ছিল ১৬০০ টাকা বর্তমানে তা হয়েছে ৮ হাজার। অতীতে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হতো না। এখন বছরে ৩৭ কোটি বই বিতরণ করা হয়। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে ১৪৫টি প্রকল্প। সব জেলাতে রেল যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২৩০টি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। জানা গেছে, ২০১৯ সালের মধ্যেই দেশের সব ইউনিয়ন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে। শুধু তা-ই নয়, তিন মাসের মধ্যে দেশের ৫৪৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনা মূল্যে ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হবে। গ্রামপর্যায়ে শহরের নাগরিক সেবা ও সুবিধা পৌঁছে দিতেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ॥ তিন ॥ গত ১০ বছরে গ্রামের অধিকাংশ ছনের ঘর পরিবর্তনের ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে। হারিকেনের আলোর বদলে বিজলি বাতি বা এনার্জি বাল্বের সরবরাহ বেড়েছে। তবে বিদ্যুত পৌঁছায়নি কিছু পার্বত্য ও হাওড়াঞ্চলে। অবশ্য দেশের ৯০% লোক বিদ্যুত ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। বাকি ১০% গ্রামে বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম এই বছরের মধ্যে শতভাগ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে ১৪% মানুষ সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করছে। এখন গ্রামের ৫০-৬০ শতাংশের ঘরে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা এবং প্রায় প্রতিটি ঘরের জন্য সুপেয় পানির বন্দোবস্ত রয়েছে। গ্রামের মানুষ এখন সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমানোর জন্য প্রস্তুত হয় না। তারা টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনের মধ্যে বিনোদনের জগতে বিচরণ করে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক খবর নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পায়। ফলে গ্রাম থেকে ধীরে ধীরে বিদায় নিচ্ছে যাত্রা, পালাগান, জারিগান এবং পুঁথিপাঠের আসর। এখন গ্রামের ক্ষুদ্র দোকানিরাও নাগরিক জীবনের সুযোগ সুবিধার অনেক উপকরণ বিক্রি করে। প্রক্রিয়াজাত অনেক খাদ্য কিংবা টিভি-ফ্রিজ এখন সহজলভ্য গ্রামে। স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনেও ঘটেছে পরিবর্তন। অবশ্য আমরা জানি, কোন গ্রামীণ পরিবারে আয়ের সিংহভাগ আসে রেমিট্যান্স থেকে। আবার কোন কোন পরিবারের সদস্য শহরে চাকরি করে গ্রামে তাদের পরিবার প্রতিপালন করে। ॥ চার ॥ গবেষকদের পর্যবেক্ষণে গ্রামীণ বাংলাদেশের উন্নয়নের পিছনে প্রধানতম কৃতিত্ব হচ্ছে কৃষির সাফল্য। যেমন- ভাল ফসল, দামের ওঠানামা কম, বাজারজাতকরণে সুবিধা। এরপর হলো- ক্রমবর্ধিষ্ণু কর্মসংস্থান বা মজুরি প্রাপ্তি। তৃতীয়ত, রেমিট্যান্সের প্রবাহ। চতুর্থত, ছোট পরিবার তথা প্রজননহার হ্রাস পাওয়া। সর্বশেষ, সাক্ষরতা তথা শিক্ষার হার বৃদ্ধি। অবশ্য আমরা প্রথমেই বলতে চাই, গ্রামীণ জনপদের পরিবর্তনের অন্যতম অনুঘটক ‘অবকাঠামোগত উন্নয়ন’। গত এক দশকে পাকা রাস্তা, সেতু, স্কুল নির্মিত হয়েছে এবং বিদ্যুত ও সেচ সুবিধার ব্যাপক অগ্রগতি এসেছে। রাস্তা পাকা ও সুপ্রশস্ত হওয়ার ফলে গ্রাম-শহর দূরত্ব দ্রুত হ্রাস পেয়েছে এবং বৃদ্ধি পেয়েছে অভিবাসন। এর ফলে উৎপাদন ও উপকরণ বিনিময় সহজ ও ব্যবসাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সালে গ্রামীণ জনপদে পাকা সড়ক ও গ্রামীণ রাস্তা ছিল যথাক্রমে ৬০,৫০০ কি মি এবং ১,১৫০ কি মি। তা ২০১৮ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭৭,০০০ কিমি এবং ৩,৫০০ কিমি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কীর্তনখোলা নদীর ওপর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতু, কুড়িগ্রামে তিস্তা সেতু, আড়িয়াল খাঁ নদীর ওপর ৭ম চীন মৈত্রী সেতু, পটুয়াখালী খেপুপাড়ায় শহীদ শেখ কামাল সেতু, হাজীপুরে শেখ জামাল সেতু এবং নড়াইলে শেখ রাসেল সেতু নির্মাণ সম্পন্ন ও উদ্বোধন হয়েছে। সেচ সম্প্রসারণের ফলে উৎপাদনে এসেছে পরিবর্তন। বিশেষত সেচ, সার ও আধুনিক বীজের কারণে জমির উৎপাদিকা শক্তি বেড়ে গেছে, যেমন উন্নত জাতের ধান ২৮, ২৯ বিঘাপ্রতি উৎপাদন দেয় ২০-২৫ মণ। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই সেচযন্ত্র আছে। এসব কারণে এখন একফসলি জমি বহুফসলি জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আবার গ্রামের জীবন কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে উন্নীত হয়েছে। এখনকার কৃষক নিজের জীবন এবং বাজার উভয়েরই যোগানদাতা। কৃষকদের ভর্তুকি হিসেবে সরকার বর্তমানে ৯০০ মিলিয়ন ডলার পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রেখেছে যা ২০০৬ সালে ছিল ৭২৩ মিলিয়ন ডলার। কৃষি প্রধান দেশ এবং কৃষিই অর্থনীতির মূল ভিত্তি হওয়ায় গত ১০ বছরে গ্রামীণ জনপদে ব্যাপক কর্মসূচী পরিচালিত হয়েছে। যেমন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবা যা তৃণমূলের জনজীবনে ডিজিটাল বাংলাদেশের অনন্য ছোঁয়া। খাদ্য ঘাটতি না থাকায় এবং সরকারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও খামারবহির্ভূত কাজের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ধনী অথবা দরিদ্র কারও জীবনই এখন আর জমিকেন্দ্রিক নয়। মানুষের আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় নির্ভরশীলতার পরিমাণ কমেছে। গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোতে জমির মালিকানার চেয়ে ক্রমবর্ধিষ্ণুভাবে শিক্ষা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একসময় মুরব্বিদের দ্বারা গ্রামের বিচার সালিশ চলত এখন ইউনিয়ন পরিষদ বা উপজেলা সদরে বন্দোবস্ত হয়। অর্জিত সম্পদ ও সরকারী সুযোগের মধ্যে যারা সমন্বয় সাধন করতে পেরেছে তাদের ভাগ্যে উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। উল্লেখ্য, বিশালসংখ্যক প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকরা মূলত কৃষিতে আমূল পরিবর্তনের সুবাধেই টিকে আছে। ॥ পাঁচ ॥ এক সময় বাংলার গ্রামবাসীদের গোলাভরা ধান ছিল, গোয়াল ভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ ছিল। সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি পাল্টে যায় দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের ধারাবাহিক তা-বে। যেমন, প্রাকৃতিক কারণেই হাওড় কিংবা প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ আধুনিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। দারিদ্র্য, কুসংস্কার, শিক্ষার অভাব ইত্যাদি উক্ত এলাকাসমূহের মানুষের উন্নয়নের অন্তরায়। ২০১৪ সালে ‘হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর’ গঠন এবং ১৯৯৭ সালের ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম দুটি কাজ। তবে দুর্যোগপ্রবণ এদেশের গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন জরুরী বলেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে আওয়ামী লীগ ‘ডেল্টা প্লানে’র কথা তুলে ধরেছে। তাদের মতে, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততা, বন্যা, নদী-ভাঙন, ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড় দেশের নিয়মিত চিত্র, যা খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে কাক্সিক্ষত উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার ‘বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’ নামে একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে পানি, জলবায়ু, পরিবেশ ও ভূমির টেকসই ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন এবং চরম দারিদ্র্য দূূরীকরণসহ ২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাংলাদেশের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনাসমূহের সমন্বয় করবে। বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রাথমিকভাবে ২০৫০ পর্যন্ত মধ্যমেয়াদী ডেল্টা এজেন্টা ঘিরে প্রণীত হলেও, তাতে ২০৫০ পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী এজেন্ডার বিষয়েও আলোকপাত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ব-দ্বীপের গঠন, নদীর গতিপথ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে ৫ম স্থানে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নীতিনির্ধারকগণ উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অন্যদিকে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট বা এসডিজির (২০১৫) যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে কাউকে পিছনে ফেলে নয় সকলকে নিয়ে উন্নয়নের যে চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে তাও গৃহীত হয়েছে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন ধারণায়। ওই লক্ষ্যমাত্রার কয়েকটি যেমন- দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি, সু স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, মানসম্মত শিক্ষা, উপযুক্ত কাজের সুবিধা নিশ্চিত করা, টেকসইভাবে বন ব্যবস্থাপনা, মরুকরণ রোধ, ভূমিক্ষয় রোধ ও বন্ধ করা এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি রোধ করা- প্রভৃতি বিষয়গুলো সরাসরি গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে চাষাবাদ, উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ, গ্রাম্য জনগণের ঐক্য ও সরকারের সহযোগিতামূলক মনোভাবই পারে গ্রামীণ জীবনের হারানো আনন্দ ও লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে দিতে। গ্রামীণ জনপদে ধর্মান্ধতার বীজ যেন প্রসারিত না হয় সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×