ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

শামসুদ্দোহা চৌধুরী

ঝলমল মসলিন

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ২২ এপ্রিল ২০১৬

ঝলমল মসলিন

বাঙালীর উৎপাদিত সূক্ষ্ম কাপড়ের নামকরণ ‘মসলিন’ শব্দটি কোথায় কীভাবে জন্ম নিয়েছিল ইতিহাসে তার ধারণা খুঁজে পাওয়া কঠিন। ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিম মনে করেন মসলিন ফার্সি। সংস্কৃত শব্দ নয়, বাংলা তো নয়ই। হেনরি-ইউল এবং এ.সি বার্নেল মনে করেন মসলিন শব্দ মসুল থেকে উদ্ভূত। মসুল ইরাকের অন্তর্গত একটি বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র। মসুল এলাকায় পুরাকালে উৎকৃষ্ট ধরনের বস্ত্র তৈরি হতো হয়ত ইউরোপীয়রা সূক্ষ্ম সুতি বস্ত্রকে সাধারণভাবে মসুলি বা মসুলিন নামে অভিহিত করত। এর জের ধরে ইউরোপিয়ানরা যখন ঢাকার সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়ের সন্ধান পায় সেই সুবাদে ঢাকার সূক্ষ্ম কাপড়কেও তারা মসলিন নামে আখ্যায়িত করতে পারে। এ ছাড়াও ঢাকার সূক্ষ্ম কাপড়কেই শুধু মসলিন বলা হতো না গুজরাট, গোলকুন্ডা ইত্যাদি স্থানে প্রস্তুত কাপড়কেও মসলিন নামে অভিহিত করা হতো। ঢাকার সূক্ষ্ম সুতি বস্ত্রকে কোন নামে অভিহিত করা হতো তা জানা দুরূহ ব্যাপার। তবে বিত্তশালী, শ্রেষ্ঠী, রাজা, সম্রাট, সুবেদার, নায়েবে নাজিমদের, সম্রাজ্ঞী, শাহজাদা শাহজাদীদের জন্য ব্যবহৃত মূল্যবান মসলিন কাপড়ের নাম ছিল ‘ঝলমল খাস’ ঝলবুস গাস’। ‘আঁবে-ই-রওয়া, শবনাম, শরবতি, জামদানি, আলিবালি নামে মসলিনের চমৎকার নাম পাওয়া যায়। সূক্ষ্ম ও মিহি মসলিন কাপড় যোগাড় করা সে আমলেও কঠিন ব্যাপার ছিল। কারণ সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীদের ঝলমল খাস তৈরি করার জন্য বাদশাহী তাঁতখানা ছিল। এ তাঁতখানা শুধু রাজা-বাদশাদের ফরমায়েশকৃত মসলিন তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। যুগে যুগে মসলিন ভারত বর্ষে মশলার আধিপত্য নিয়ে পর্তুগিজ এবং ডাচদের মধ্যে যে বাণিজ্যযুদ্ধ হয়েছিল পরবর্তীকালে পাশ্চাত্যে গ্রীক, রোমান সাম্রাজ্যে ধস নামার পর সামুদ্রিক বাণিজ্য আধিপত্য নিয়ে মসলিন যুদ্ধ না হলেও কালের বিবর্তনে রোমান ও গ্রীক সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর পর সামুদ্রিক বাণিজ্যে একচেটিয়া আধিপত্যটুকু আরব বিশ্বের কাছে চলে যায়। নবম শতকে লিখিত আরব ভৌগোলিক সোলায়মানের সিলসিলাত-উত-তাওয়ারিখে রুমী নামক এক রাজ্যের বিবরণ পাওয়া যায় যেখানে যে ৪০ হাত দৈর্ঘ্য ও ২ হাত লম্বা এক টুকরা কাপড় একটি ছোট আংটির ভেতর দিয়ে অনায়াসে নাড়াচাড়া করা যেত এমন সূক্ষ্ম বস্ত্রের বর্ণনা রয়েছে। ১৩৪৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত মুসলিম পর্যটক ইবনে বতুতা যখন সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন তিনি সোনারগাঁওয়ে উৎপাদিত মসলিন কাপড়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। চতুর্দশ শতকে সুলতান গিয়াসুদ্দীন আযম শাহের রাজত্বকালে চীনা দূত কংছুলোর নেতৃত্বে যে দলটি সোনারগাঁও এবং পাতুয়া ভ্রমণ করেন ইতিহাস মিংশরে লিখিত আছে সে সময়ের ঐশ্বর্যশালী বাংলায় সূক্ষ্ম সুতি বস্ত্র তৈরি হতো। গিয়াসুদ্দীন আযম শাহ এবং সাইফুদ্দিন হামজা শাহের দরবারে আগত চীনা প্রতিনিধিদের মহামূল্যবান মসলিন কাপড় ভেট হিসেবে প্রদান করা হয়েছিল। ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে আগত পর্তুগিজ পর্যটক ডুয়ার্টে বারবাসাও বাংলাদেশের সুতি বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে ঈসা খাঁর রাজত্বকালে রানী এলিজাবেথের বিশেষ দূত রালফ ফিচ যখন সোনারগাঁও ভ্রমণ করেন তখন তিনি সোনারগাঁওয়ের মসলিনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। ১৮৫১ সালে লন্ডনে সোনারগাঁওয়ের মসলিন কাপড় প্রদর্শিত হয়। ঐ প্রদর্শনীতে দর্শনীয় জিনিসসমূহের মধ্যে মসলিন এক বিশেষ স্থান অধিকার করে মসলিন সর্বোত্তম বস্ত্র বলে বিবেচিত হয়। সোনারগাঁও মোহনীয় মসলিনের পুণ্যভূমি চতুর্দশ শতকের চারু কারুকলা খ্যাত বাংলার মধ্যযুগীয় রাজধানী সোনারগাঁও ছিল আদি মসলিনের পুণ্যভূমি। শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র বিধৌত দ্বীপসম এ স্থানটি এক সময় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শুধু শীর্ষস্থান অধিকার করেনি। সোনারগাঁওয়ের বর্ণাঢ্য খ্যাতির গভীরে আছে মসলিন নিয়ে অনেক অজানা কাহিনী। আজ যেখানে লোনা ইটের প্রস্তর খসানো দালান মহাকালের করাল দৃষ্টি এড়িয়ে এখনও টিকে আছে, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এক সময় এ স্থানই বণিক, সওদাগর, মসলিন কারিগর, দালাল, ফড়িয়াদের কলগুঞ্জনে মুখরিত থাকত। এ কথা আজ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত সোনারগাঁওয়ের পানামনগরী যা এখনও মধ্যযুগীয় সমৃদ্ধ সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করে আসছে সেই পানামনগরীই ছিল মসলিনের বিখ্যাত আড়ং। সোনারগাঁওয়ের খাসনগর দীঘি থেকে উত্থিত আদ্র বায়ু মসলিন সুতো কাটানোর জন্য উৎকৃষ্ট ছিল। মসলিন কারিগদের বসাবাস ছিল সম্ভবত খাস নগর দিঘির তীরেই। খুব ভোরে সোনারগাঁওয়ের মসলিন তাঁতিরা দীঘির চারদিক ঘিরে মসলিন সুতো টাঙিয়ে শুকাত। ভোরবেলার দীঘির আর্দ আবহাওয়া মসলিন সুতো শুকানোর জন্য অনুকূলে ছিল। খাসনগর দীঘির তীরের মসলিন কারিগররা শ্রেষ্ঠী, বিত্তশালীদের জন্য তৈরি করত ঝলমল খাস, মলবুস খাস আবে-ই-রওয়া, শাবনাম, আলিবালি নামক মহামূল্যবান মসলিন শুধু মসলিন তৈরিই নয় ধোপার কাজ থেকে শুরু করে, রঙ করা এবং মসলিনের মাঝে সোনা রূপার নান্দনিক ডিজাইনে মসলিনকে মোহনীয় করার জন্য সোনারগাঁওয়ের মসলিন কারিগরদের সুনাম ছিল। উৎকৃষ্ট ‘ফুটি’ কার্পাস উৎপাদিত হতো ব্রহ্মপুত্র তীর ঘেঁষেই। ঝলমল খাসের মতো উৎকৃষ্ট মসলিনের জন্য প্রয়োজন হতো ফুটি কার্পাসের। ফুটি কার্পাসের এই সহজলভ্যতার কারণেই আদি মধ্যযুগের রাজধানী সোনারগাঁওয়ের পৃথিবীখ্যাত মসলিন তৈরি সম্ভব হয়েছিল। খাসনগর দীঘিকে কেন্দ্র করে সোনারগাঁওয়ের সমাজব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন হয়েছিল। উৎকৃষ্ট চাল, বস্ত্র রফতানির ফলে সোনারগাঁওয়ের অর্থনীতি ফুলে ফেঁপে উঠলেও সাধারণ তাঁতিদের অর্থনৈতিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং মলমল ঝলমল খাসের জন্য যে সমস্ত সুতো কাটুনি তরুণীরা নিয়োজিত ছিলেন তাদের কখনও ভাগ্য ফেরিনি। নিপুণ সুতা কাটুনি হওয়াতে অনেক সময় প্রশাসনিকভাবে নির্যাতনও নেমে আসত তাদের ওপর। ইতিহাসে উল্লেখ আছে সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী সুবেদার, আমলা, শাহযাদা, শাহযাদি নায়েব নাজিযাদ জন্য যে বিশেষ মসলিন বস্ত্র তৈরি হতো মোগল রাজশক্তির বিশেষ কর্মচারীদের তত্ত্বাবধানে তাদের থাকতে হতো। মোগল রাজ কর্মচারীদের নির্দিষ্ট তাঁত খানায় যে রাজ কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন তাদের উপাধি ছিল ‘দারোগাই-মলবুস খাস’। দারোগাই মলবুস খাসের শ্যেনদৃষ্টি ছিল মসলিন কারিগরদের ওপর। মাসের পর মাস মসলিনের মতো সুক্ষ্ম কাপড় বুননে কারিগরদের যে শ্রমটুকু ব্যয় হতো তার প্রকৃত মজুরি কখনো তাদের ভাগ্যে জুটতো না। বরং নিজেরা নিপুণ সুতো কাটুনে হওয়াতে তারা নিজকে অভিশপ্তই মনে করত। সোনারগাঁও কারিগরদের নির্মিত মসলিন সুতো কোন কোন সময় ১৭৫ হাত লম্বা ছিল। জেমস টেলর সোনারগাঁওয়ে এক পাউন্ড ওজনের এক লাল সুতো দেখেছিলেন যার দৈর্ঘ্য ছিল ২৫০ মাইলের মতো। উল্লিখিত সুতো ১৮৫১ সালে বিলেতের প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছিল। প্রদর্শিত সুতার সুক্ষ্মতা সম্পর্কে টেলর বলেছেন, ইহার ব্যাস ১/১০০০ থেকে ১/১৫০০ ইঞ্চি পরিমাণ! সুলতানি যুগে রাজধানী সোনারগাঁও থেকে মসলিন কাপড়ের ব্যবসায়ী হিসেবে আরব বণিকদের পাশাপাশি ইরানি ব্যবসায়ীদেরও পরিচয় পাওয়া যায়। সুলতানি আমলে ঠিক কতো টাকা মূল্যের মসলিন বিদেশে রফতানি হত তার সঠিক পরিসংখ্যান না পাওয়া গেলেও জেমস টেলরের বর্ণনায় দেখা যায় ইংরেজ আমলে সোনারগাঁও আড়ং হতে ৩ লাখ ৫০ হাজার (তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার) টাকার মসলিন রফতানি হয়েছিল। স্বভাবতই রাজধানী সোনারগাঁও এবং তার পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোকে ঘিরে মসলিনবিষয়ক রমরমা বাণিজ্যের উত্থান হয়েছিল। এই সমৃদ্ধ বাণিজ্যের ধারা পলাশী যুদ্ধের আগ পর্যন্ত ক্ষীণ বহমান ছিল। মুসলিম রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সোনারগাঁওয়ের মসলিনের বর্ণাঢ্য ধারাটি বিলুপ্ত হতে হতে পলাশী যুদ্ধে বাংলার শোচনীয় পরাজয়ের পর তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এ সমস্ত কারণ ছাড়াও পাশ্চাত্যে আধুনিক বস্ত্র নির্মাণের ফল আবিষ্কৃত এবং সস্তা দামে কাপড়ের প্রচলন হওয়াতেও মসলিন শিল্পে একটি বড় রকমের ধাক্কা লাগে। ব্রিটিশ কলোনির বাজার হিসেবে ভারতবর্ষে তখন প্রচুর পরিমাণে মোটা সুতি কাপড় আমদানিতে বস্ত্রশিল্পের প্রতিযোগিতায় মসলিন শিল্প আর টিকে থাকতে পারেনি। এ ছাড়াও কোম্পানির তাঁতখানা কর্মকর্তা তাদের নিয়োগকৃত গোমস্তাদের মসলিন কারিগরদের ওপর অত্যাচার দালাল এবং ফড়িয়া দ্বারা মসলিনের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করাও ছিল সোনারগাঁওয়ের মসলিন শিল্প ধ্বংস হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। ক্ষোভ এবং অসন্তোষের পুঞ্জিভূত নির্যাতনের শিকার সোনারগাঁওয়ের মসলিন কারিগররা একবার বিদ্রোহ করে। কোম্পানির কুঠিয়ালের লাঠিয়াল এবং ঢাকা থেকে আসা গোরা সৈনিকরা সোনারগাঁওয়ের মসলিন কারিগরদের এই বিদ্রোহকে কঠোর হস্তে দমন করে। ঢাকার মসলিনের ইতিকথা যেখানে রাজধানী সেখানে রাজসিক পরিবেশ। বিত্ত ও আভিজাত্যের স্থানান্তর রাজধানীকে কেন্দ্র করেই। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দের দিকে রাজধানী সোনারগাঁও থেকে ঢাকা স্থানান্তরিত হওয়ার পর স্বভাবতই ঢাকা অভিজাত মহলের ব্যবসা-বাণিজ্য ও বাসস্থানের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। মসলিনের ব্যাপারে এ কথাটি ষোলআনাই প্রযোজ্য। ১৬০৮ খ্রিস্টব্দের পর সোনারগাঁওয়ে মসলিন কাপড় যে তৈরি হতো না তা কিন্তু নয়। ঢাকা রাজধানী হওয়ার পরও সোনারগাঁওয়ে মসলিনের আয়ুষ্কাল টিকে ছিল আরও দেড়শত বছর। রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার পর মসলিন কাপড় বিদেশে পরিচিত হতে থাকে ঢাকাই মসলিন হিসেবে। মোগলদের সময়ে এবং তৎপরবর্তী সময়ে ঢাকাই মসলিনের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়ায়ে পড়ে আরব বণিকদের মারফত উত্তর আফ্রিকা, জেদ্দা কায়রো, বশরা, নগরীতে ছড়ায়ে পড়ে। ইউরোপিয়ানদের সময়ে ঢাকায় দলে দলে ইউরোপীয় বণিকরা এদেশে আসতে শুরু করে এবং ঢাকাই মসলিন ইউরোপে এতো অধিক পরিমাণে রফতানি হতে থাকে যে ল-ন, প্যারি, আর্মস্টার্ডামের বাণিজ্য কেন্দ্রেও বিপুল প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। যেহেতু ঢাকার মসলিন নিয়ে একচেটিয়া বাণিজ্য ছিল ইউরোপিয়ানদের। তারা এ সম্পর্কে। বিভিন্ন অফিসিয়াল রিপোর্টে অল্প বিস্তর আলোচনাও করেছেন। ১৮৪৪ সালে ঢাকা বিভাগের তদানীন্তন অস্থায়ী কমিশনার ডানবারের লিখিত এক চিঠিতেও ঢাকাই মসলিন সম্পর্কে কিছু জানা যায়। চারশত বছরের কৌলীন্য নিয়ে ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীর যে যাত্রা এবং যে ঢাকাকে বলা হয় মোগলদের শহর, সে ঢাকার মহামূল্যবান মসলিন সম্পর্কে মোগলরা তেমন কিছুই লিখে যায়নি। মোগলদের সময়ের লিখিত ঢাকার মসলিন সম্পর্কিত কোন ঐতিহাসিক গ্রন্থ থাকলে ব্রিটিশ প্রাক মসলিন সম্পর্কে আরও বেশি অবহিত হওয়া যেত। আইন-ই-আদববীর লেখক আবুল ফজল কিছুটা উল্লেখ করলেও। মসলিন সম্পর্কে লেখা যথার্থ নয়। মোগল সুবেদারদের আমলে ঢাকা, সোনারগাঁও থেকে মোগল রাজদরবারে রাজস্ব পাঠানোর সঙ্গে মূল্যবান মসলিন কাপড় পাঠানোরও একটি দাফতরিক নির্দেশনামা ছিল। ইতিহাস পাঠে লক্ষ্য করা যায় সুবেদার ইসলাম খান, দেওয়ান মুর্শিদকুলি খান মোগল রাজদরবারে রাজস্ব পাঠানোর সঙ্গে, সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীদের জন্য মলবুস খাস মসলিন পাঠিয়েছিলেন। তো এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না ঢাকার মোগল সুবেদার এবং নায়েবে নাজিসরা মসলিনের আদর্শ সমঝদার ও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ঢাকাই-মসলিনের স্বর্ণযুগ শুরু হয় মোগলদের আমল থেকেই এবং ইউরোপিয়ানদের আমলে তা ফুলে ফেঁপে দাঁড়ায়। শুধু রাজধানীতেই নয়, ঢাকা জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে তাঁতশিল্প ছড়িয়ে পড়েছিল তা ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে জেমস টেলর নিজ চোখেই দেখেছেন। বিশেষ করে অভিজাত রাজ-রাজরাদের মসলিন তৈরির জন্যে ঢাকা, সোনারগাঁও, ধামরাই, তিতাবাদি ও জঙ্গলবাড়ির কথা জেমস টেলর বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। ঢাকায় বসে ইউরোপিয়ানরা অনেক কাঁচা সোনা-রূপা লগ্নী করত। ইউরোপিয়ান এবং পাশ্চাত্যের টাকা বিনিময়কারী অনেক সংস্থাও ঢাকাতে গড়ে উঠেছিল। শুধু ঢাকাতেই নয়, রাজকীয় মসলিন তৈরি এবং জোগাড় করার জন্যে সরকারী প্রতিনিধিরা তিতাবদি, জঙ্গলবাড়ি, ধামরাই, সোনারগাঁওয়ে আসতেন। অনেক তাঁতিরা যাতে মসলিন বুননে ফাঁকি দিতে না পারে সে জন্যে সরকারী তাঁতখানায় পাহাড়ার বন্দোবস্ত ও থাকত। যে কাপড় যত বেশি দীর্ঘ এবং যত বেশিসংখ্যক সুতোবেষ্টিত ও ওজনে কম হতো সে মসলিনকেই উৎকৃষ্টতম মসলিন হিসেবে চিহ্নিত করা হেতা। এই শ্রেণীর মলবুস খাস এবং সরকার-ই-আলী মসলিনের ওজন ছিল ৬/৭ তোলা। এ কাপড় এতো সুক্ষ্ম ছিল যে একটি ছোট্ট আংটির ভেতরে তা অনায়াসে নাড়াচাড়া করা যেত। সম্রাট আওরঙ্গজেবকে ঢাকার যে মসলিন পাঠানো হয়েছিল তার ওজন ছিল ছয় তোলা। এ কাপড়ের দৈর্ঘ্য ছিল ১০ গজ এবং প্রস্থে ছিল ১ গজ। ঝুনা নামে এক প্রকার সূক্ষ্ম জালের মতো মসলিন তৈরি হতো যার ওজন ছিল ২০ তোলার মতো। পর্যটক ট্যাতাটিয়ার উল্লেখ করেছেন জুনা কাপ বিদেশে রফতানি করতে দেয়া হতো না কারণ এ সমস্ত সুক্ষ্ম কাপড় মোগল দরবারে প্রেরণ করা হতো। রঙ্গ নামে এক প্রকার মসলিনের কথা জেমস টেলর উল্লেখ করেছেন এর ওজনও ছিল ২০ তোলার মতো। মসলিনের এক কাব্যিক ও বর্ণাঢ্য নাম ছিল আব-ই-রওয়ান (স্বচ্ছ জলধারা)। ঢাকার মসলিন কারিগররা প্রবাহিত পানি নাম দিয়ে এর সূক্ষতা ও মসৃণতা নিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। দেশে বিদেশেও ঢাকার আঁবে-ই-রওয়ার অনেক সুনাম ছিল। ইউরোপীয় বণিকরা কম মূল্যের আঁবে-ই-রওয়া কাপড় বিদেশে রফতানি করত। আঁবে-ই-রওয়ান মসলিন লম্বায় ২০ গজ এবং চওড়ায় ১ গজ ছিল এর ওজন ছিল ২০ তোলা। ঢাকাই মসলিনের আরেক বিস্ময়কর সৃষ্টি ছিল মুর্শিবাদের দেওয়ান ও ঢাকার নায়েবে নাজিমদের জন্যে তৈরি সরকার-ই আলী মসলিন। সরকার-ই-আলী নামধারী জায়গীরদারের প্রাপ্য খাজনা থেকে সরকার-ই-আলী মসলিনের মূল্য পরিশোধ করা হতো। সাদা জমিন বিশিষ্ট এই মূল্যবান মসলিনের ওজন ছিল ২০ তালা। সোনারগাঁও ও জঙ্গলবাড়ির তাঁতিরা জঙ্গল খাসসা নামে ২০ তোলা ওজনের মসলিন কাপড় তৈরি করত। শবনাম (ভোর বেলার শিশির) কাব্যিক নামে এক চমৎকার মসলিন উপহার দিয়েছিলেন ঢাকার তাঁতিরা। এ কাপড় এতো সূক্ষ্ম ও মিহি ছিল যে ভোরবেলায় এ কাপড় ঘাসে শুকাতে দিলে শিশির না কাপড় তা বোঝার কোন অবকাশ ছিল না। একখানি শবনামের ওজন ছিল ২০/২২ তোলা। এছাড়া আলিবালি, তন-তরান্দাম, নয়ন সুখ, বদন খাস, সর-বন্দ, সর-বুটি, কামিছ সারিয়া, চারকোনা ও জামদানি। এই সূক্ষ্ম মসলিন প্রতি গজের দাম ৪০০/২০০/২৫০ টাকায় উঠা-নামা করত। পূবেই উল্লেখ করেছি মূল্যবান মসলিন সংগ্রাহকরা সরকারী কর্মকর্তা নিয়োজিত ছিলেন। এ সমস্ত সরকারী কর্মকর্তাদের (১৭২৩-১৭৩৬ খ্রিঃ) কয়েকজনের নাম উল্লেখ করেছেন জেমস টেলর, শ্রীনাথ, সিরাজ-উদ-দীন মোহাম্মদ গনি, ছালেহ মোহাম্মদ নামে কয়েকজন রাজ কর্মকর্তা ও রাজকর্মচারীর নাম পাওয়া যায় জেমস টেলরের গ্রন্থে। সোনারগাঁওয়ে শেখ গরীবউল্লা নামে এক মসলিন ব্যবসায়ীর কথাও ইতিহাস পাঠে জানা যায়। ১৮ শতকের ইংরেজ কোম্পানির দলিলে এবং টেলরের ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকাই মসলিনের ব্যবসা সম্পর্কে একটি মোটামুটি হিসাব দিয়েছেন। * দিল্লীর বাদশাহের জন্য সংগ্রহ করা হয় ১ লাখ টাকা মূল্যের মলবুস খাস, জামদানি, আঁবে-ই-রওয়া কাপড়। * মুর্শিদাবাদের নবাবের জন্য সংগ্রহ করা হয় ৩ লাখ টাকার মসলিন। * জগৎশেঠের জন্য সংগ্রহ করা হয় ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন। * পাক ভারতের উত্তর পশ্চিাঞ্চলে বিক্রির জন্য ইরানী তুরানি ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে ১ লাখ টাকার মসলিন। * পাক ভারতের উত্তর-পশ্চিাঞ্চলে বিক্রির জন্য পাঠান ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন। * বসরা, মত্তল, জেদ্দার বাজারে বিক্রির জন্য আর্মেনিয়াান ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে ৫ লাখ টাকার মসলিন। * বসরা, জেদ্দা, মত্তল বন্দরে বিক্রি করার জন্যে মোগল ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে ৪ লাখ টাকার মসলিন। * পাক ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য হিন্দু ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে ২ লাখ টাকার মসলিন। * ইউরোপে চালান দেয়ার জন্য ইংরেজ বণিক কোম্পানি সংগ্রহ করে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন। পলাশী যুদ্ধের পর মসলিনের রফতানি অনেক বৃদ্ধি পায় এবং বছরে প্রায় ৮ লাখ টাকার মসলিন ইংরেজ কোম্পানি ইউরোপে রফতানি করে। * বিদেশের বাজারে চালান দেয়ার জন্য ইংরেজ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে দুই লাখ টাকার মসলিন। * ফরাসী বণিক কোম্পানি ইউরোপে চালান দেয়ার জন্য সংগ্রহ করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার মসলিন। * ফরাসী ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীরা বিদেশে চালান দেয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকার মসলিন সংগ্রহ করে। * ওলন্দাজ বণিক কোম্পানি ইউরোপে চালান দেয়ার জন্য ১ লাখ টাকার মসলিন সংগ্রহ করেছে ১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দের ঢাকাই মসলিন বাণিজ্যের যে হিসাব দেয়া হয় তাতে দেখা যায় দিল্লীর বাদশাহ, বাংলার নবাব ও জগৎশেঠের জন্য সাড়ে ৫ লাখ টাকার মসলিন সংগ্রহ করা হয়েছিল। মোগল ব্যবসায়ীরা মোট সাড়ে ৬ লাখ টাকার মসলিন আর্মেনিয়ান, হিন্দু ব্যবসায়ীরা সাত লাখ টাকার মসলিন এবং ইউরোপিয়ানরা মোট সাড়ে ৯ লাখ টাকার মসলিন বিদেশে রফতানি করেছিল। এফবি ব্রাডলি বাটের মতে, মসলিনের স্বর্ণ যুগে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা প্রায় ৫০-৬০ লাখ টাকার ঢাকাই মসলিন ইউরোপে রফতানি করেছিল।
×