সম্প্রতি লতা সমাদ্দার নামে তেজগাঁও কলেজের ফিল্ম এ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষককে কপালে টিপ পরার কারণে রাস্তায় দিনেদুপুরে জনসম্মুখে ইউনিফর্ম ও লেবাসধারী পুলিশের এক সদস্যের কাছে নাজেহাল হতে হয়। এই রেশ চলাকালীন হৃদয় কৃষ্ণ ম-ল নামের এক শিক্ষককে ধর্ম অবমাননার কথিত অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলা সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক। ঘটনাটির সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, তিনি ক্লাসে ‘ধর্ম’কে বিশ্বাস ও ‘বিজ্ঞান’কে প্রমাণনির্ভর হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাতে পূর্ব ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ক্লাসের কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে মোবাইলে তা ধারণ করে ধর্ম অবমাননার ভুয়া ধোঁয়া তুলে তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত অশ্লীল ভাষায় ও ভঙ্গিমায় অন্যান্য শিক্ষার্থী ও লোকজন নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। তার রেশ কাটতে না কাটতেই নওগাঁর মহাদেবপুরে দাউল বারাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে হিজাব পরার কারণে ছাত্রীদের পেটানোর অভিযোগ তুলে সাম্প্রদায়িক বিক্ষোভ তোলা হয় আমোদিনী পাল নামে এক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে এবং ১৫০-২০০ জন মানুষ উক্ত স্কুলে ব্যাপক ভাঙচুর করে। পরে তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায় যে, তিনি হিজাব নয়, স্কুল ড্রেস পরে না আসার কারণে ছাত্রীদের অনুশাসন করেছিলেন। দুটি ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায় উক্ত শিক্ষকদ্বয় প্রাতিষ্ঠানিক ও আঞ্চলিক কূট-ষড়যন্ত্রের শিকার এবং তারা হিন্দুধর্মী হওয়াতে তাদের বিরুদ্ধে ইসলাম বিরুদ্ধ সাম্প্রদায়িক ভুয়া অভিযোগ তুলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অপব্যবহার করে তাদেরকে হেনস্তা করার অপচেষ্টা চালানো হয়। অর্থাৎ এই সমাজে কোন অমুসলিমকে ঘায়েল করতে গেলে ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতা যে একটি সস্তা ধারালো অস্ত্র তা এখন শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের মাঝেও বদ্ধমূল ধারণায় পরিণত হয়েছে মর্মে এ দুটি ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। এটি একটি গভীর আতঙ্কের বিষয় এবং এটি ভাববার দাবি রাখে। এ অবস্থা চলতে থাকলে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে অবাধ সৃজনশীল শিক্ষা চর্চা নিদারুণভাবে ব্যাহত হবে। ভূলুণ্ঠিত হবে শিক্ষার মাহাত্ম্য। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমাজ-সভ্যতা। উল্লেখ্য, বর্তমানে একাডেমিক শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাথমিক স্তর হতে সৃজনশীল পদ্ধতি বিদ্যমান। কিছু বছর পূর্বেও যেখানে শিক্ষার্থীরা মুখস্থ বিদ্যানির্ভর ছিল সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তারা সৃজনশীল পদ্ধতির আত্মবিশ্লেষণিক ধারায় চিন্তার বিকাশ ঘটাবে তা বিশ্বায়নের যুগে অবশ্যই একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এ পদ্ধতির বিশেষত্ব হলো কোন নির্দিষ্ট পাঠ্য আলোচনাকে তাৎপর্যময় করে তুলতে প্রাসঙ্গিক একাধিক ‘তথ্য’ ও ‘তত্ত্ব’র অবতারণা ঘটানো। এটি একটি বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা পদ্ধতিও বটে। শিক্ষক হৃদয় কৃষ্ণ ম-ল ‘ধর্ম’ ও ‘বিজ্ঞান’-এর ভিত্তি যথাক্রমে ‘বিশ্বাস’ ও ‘প্রমাণ’ বলে চিরন্তন সত্যকেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। এভাবে তিনি কার্যত সৃজনশীল শিক্ষাই দান করছিলেন। ধর্মের ভিত্তি যে বিশ্বাস তা পবিত্র কোরানের শুরুতেই উচ্চারিত হয়েছে। কোরানে বর্ণিত-‘আল কোরান সেই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই; এতে রয়েছে মোত্তাকি (গুণী ধার্মিক)দের জন্য পথের দিশা। মোত্তাকি তারা যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখে, নামাজ প্রতিষ্ঠা করে এবং আমি তাদের যে রুজি দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে’-[২:২-৩]। এ থেকে বোঝা যায় যে, উক্ত শিক্ষক কখনই ধর্ম তথা ইসলাম অবমাননা করেননি, বরং তিনি ইসলামের সত্যটাকেই উপস্থাপন করেছেন। যারা মিথ্যা-গুজবে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করেছে তারাই বরং ধর্ম অবমাননা করেছে। কোরান ঘোষণা করছে-’ ফিতনা (ফ্যাসাদ) হত্যার চেয়ে মহাপাপ ‘[২:২০১৭]। অথচ এক শ্রেণীর তথাকথিত আলেম নামের বক্তারা ধর্মীয় ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানিমূলক গুজব সৃষ্টি করে সমাজে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে চলেছে। এরা ধর্মের মূল তত্ত্ব- ‘সর্বজনীন মানবিকতা ও সহনশীলতা’র ওপর বয়ান-বক্তৃতা করে না বরং পবিত্র ধর্মকে বিকৃত করে মানুষে মানুষে বিভাজন সৃষ্টি করে সমাজিক শান্তি বিনষ্টের অপচেষ্টায় লিপ্ত। ইসলামসহ কোন ধর্মই এহেন কুচর্চা কখনই বরদাস্ত করে না। অবাক বিষয় যে, তাদের অনুসারীর সংখ্যায়ও ব্যাপক যাদের একটি বিরাট অংশ শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণী। বর্তমানে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার কুপ্রভাব ধর্মভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পেরিয়ে তা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে, যা অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। আড়াই দশক আগেও ইসলামী বক্তাদের বয়ানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল সর্বজনীন নীতি-নৈতিকতা-মানবিকতার চর্চা। কিন্তু বর্তমানের বক্তারা পারস্পরিক গীবত, মনগড়া ফতোয়া, চরম নারী বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ফাটল ও সমাজের শান্তি বিনষ্টের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অর্থাৎ, এদের কারণে ধর্মের মানবিক আবেদন ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। ফলে মসজিদ-মাদ্রাসায় এক শ্রেণীর মোল্লার দ্বারা আশঙ্কাজনকহারে নারী ও শিশু ধর্ষণ ও বলাৎকার হচ্ছে। টিপ, হিজাব, ভাস্কর্য প্রভৃতি গৌণ বিষয় নিয়ে এদের ধর্মবিকৃত মারাত্মক মাতম লক্ষ্য করা যায়, অথচ ধর্মালয়ে সংঘটিত ধর্ষণ ও বলাৎকার বিষয়ে তাদের ন্যূনতম প্রতিবাদ তো দূরের কথা, বিরোধিতাও লক্ষ্য করা যায় না, যা সত্যিই ঘৃণিত বিষ্ময়। এদের এ সকল অনৈতিক ভূমিকা পবিত্র ইসলামের মাহাত্ম্যকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং অমুসলিম ও ধর্মপ্রাণ সরল মুসলিম সমাজে পবিত্র ইসলাম সম্বন্ধে খারাপ বার্তা দিচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশনের কোন ইতিবাচক ভূমিকা পরিলক্ষিত হয় না। তাদের কি কোনই দায়-দায়িত্ব নেই? ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কাজ কি শুধুই হজ মৌসুমে হজযাত্রী ও আসন্ন ঈদে চাঁদের ক্ষণ গণনা করা? সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতার প্রভাব এখন তৃণমূল পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলছে। অচিরেই হয়ত তারা ‘বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতির পিতা’ এই বিষয়টির বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ফতোয়া জারি করে তা নিষিদ্ধের দাবি তুলবে, যেমনটি তাঁর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে ফুঁসেছিল। পহেলা বৈশাখসহ সকল জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে তাদের বিরোধিতা এখন চরমে পৌঁছেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অবাধ অপব্যবহার তাদের এই ধর্মবিকৃত অপচর্চাকে অভাবনীয় সুযোগ করে দিচ্ছে। হতাশার বিষয় হলো সরকারসহ সুশীল সমাজের এ নিয়ে তেমন কোন মাথাব্যথা নেই। দেশ ও জাতিকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার করাল গ্রাস থেকে বাঁচাতে হলে-১) এদেরকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে; ২) সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রতি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাধ্যমে বিশেষ নজরদারি রাখতে হবে; বিশেষ করে ধর্ম শিক্ষকদের প্রতি। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষা দিতে হবে; ৩) অধিকাংশ মসজিদ-মাদ্রাসা ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা চর্চার উর্বর অভয়ারণ্য। সেখানে সরকারের কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে। ইসলামী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ইমামদের ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী শিক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে দিয়ে খুতবায় এগুলোর বিরুদ্ধে আলোচনা করাতে হবে; ৪) প্রখর জনসচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। এর কুফল সম্বন্ধে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে সজাগ করতে হবে; ৫) মিডিয়াতে এদের প্রশ্রয় বন্ধ করতে হবে। ধর্মের আলোকেই এদের ধর্মবিকৃত ধারণার বিরুদ্ধে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় আনতে হবে; ৬) এগুলোর কুফলসমূহ পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে ধর্মের প্রকৃত মহানুভবতাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে; ৭) ধর্মীয় ওয়াজের প্রতি বিশেষ নজরদারি রাখতে হবে। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প সৃষ্টিকারী বিতর্কিত বক্তাদের নিষিদ্ধ করতে হবে; ৮) এদের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে তৃণমূল পর্যায়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায় এদের বিধ্বংসী কবল হতে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে হয়ত আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন পড়বে যা কখনই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখা উচিত সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়।
লেখক : সাংস্কৃতিক সম্পাদক, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম,
মুক্তিযুদ্ধ ’৭১, যশোর