অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করোনা মহামারী, নানা সঙ্কট আর দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতির জাঁতাকলে যখন নি¤œ ও মধ্যবিত্তরা পিষ্ট, এমন সময়েও ব্যাংকে কোটি টাকা রয়েছে, এ ধরনের হিসাবের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। গত এক বছরে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা আট হাজারের বেশি বেড়ে এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে দাঁড়িয়েছে। আর করোনার ২১ মাসে (মার্চ ’২০-ডিসেম্বর ’২১) এমন হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১টি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২১ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক হালনাগাদ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকিং খাতে কোটি টাকার বেশি আমানতের হিসেবের সংখ্যা ছিল ৯৩ হাজার ৮৯০টি। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে। সে হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ৮ হাজার ৮৬টি।
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। শুরু হয় লকডাউন বিধিনিষেধ। বন্ধ হয়ে যায় বেশিরভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য। মহামারীর কারণে গোটা বিশ্বের মতো দেশেও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেকে কাজ হারিয়েছেন, আবার অনেকে কর্মহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতেও আমানতকারীর সঙ্গে কোটি টাকা জমার হিসাবের সংখ্যা বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের মার্চে দেশে যখন করোনা হানা দেয় তখন ব্যাংক খাতে কোটি টাকার বেশি আমানত রাখার হিসাবের সংখ্যা ছিল ৮২ হাজার ৬২৫টি। মহামারী চলাকালে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরেই কোটিপতি হিসাবের ওই অঙ্ক এক লাখ ছাড়ায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে তা দাঁড়ায় এক লাখ এক হাজার ৯৭৬টিতে। এ হিসেবে মহামারীর ২১ মাসে দেশে কোটিপতি হিসাব বেড়েছে ১৯ হাজার ৩৫১টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৮ লাখ ৯৬ হাজার ৯৩৪টি। যেখানে জমা ছিল ১৫ লাখ ১২ হাজার ৪৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে কোটি টাকার বেশি হিসাবে জমা ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে কোটিপতি ব্যাংক হিসাবগুলোতে জমা ছিল ৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। ওই সময় মোট আমানতের স্থিতি ছিল ১৩ লাখ ৭৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, এক কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি টাকার আমানতকারীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭৯ হাজার ৮৮৩টি। যাদের হিসাবে জমার পরিমাণ এক লাখ ৬৬ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। পাঁচ কোটি থেকে ২০ কোটির মধ্যে রয়েছে ১৭ হাজার ৯টি হিসাব। তাদের হিসাবে জমার পরিমাণ এক লাখ ৫৮ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০ কোটি থেকে ৫০ কোটির ওপরে মোট হিসাবধারীর সংখ্যা ৫ হাজার ৮৪টি। এই হিসাবগুলোতে জমার পরিমাণ তিন লাখ ২৮ হাজার ৭১৯ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবেন, তার কোন নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক হিসাবও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কোটি টাকার হিসাবও রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিলেন ৫ জন, ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭ ও ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি। ২০২০ সালে ডিসেম্বর শেষে দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টিতে।