ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

তিন হাজার লাইসেন্স বাতিল করেছে বিআরটিএ ঢাকা সার্কেলের দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা

ভুয়া লাইসেন্সের রাজত্ব ॥ সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ৫০ হাজার চালক

প্রকাশিত: ২৩:১১, ৩০ ডিসেম্বর ২০২১

ভুয়া লাইসেন্সের রাজত্ব ॥ সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ৫০ হাজার চালক

আজাদ সুলায়মান ॥ একদিকে সড়কে মৃত্যুর মিছিল, অন্যদিকে অদক্ষ চালকদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে মারণাস্ত্র-ড্রাইভিং লাইসেন্স। সড়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীসহ দেশজুড়ে এসব ভুয়া লাইসেন্সধারী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যার করুণ পরিণতি- সড়ক দুর্ঘটনা। সম্প্রতি বিআরটিএ-এর মুন্সীগঞ্জ ও সাভার সার্কেল অফিসের দুটো জাল জালিয়াতি ও ভুয়া লাইসেন্স প্রদানের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে এ ধরনের ভয়াবহ তথ্য। সবচেয়ে বড় বিতর্ক দেখা দিয়েছে- এমন একটি প্রমাণিত অভিযোগ যার বিরুদ্ধে- সেটা যিনি তদন্ত করছেন তারও নৈতিকতা ও সততা নিয়েও। যিনি এতদিন নিজেই ভুয়া লাইসেন্স প্রদানকারীদের প্রশ্রয় দিয়েছেন- সেই কর্মকর্তাকে দিয়েই দুর্নীতিবাজদের দুর্নীতির তদন্ত করানোর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বিআরটিএ’র সাধারণ স্টাফদের মাঝে। এরই মাঝে অভিযুক্তদের রক্ষা করার জন্য আপোস রফার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় লাইসেন্স জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় যাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছে তাদেরই আবার ঢাকা সার্কেলের মতো জায়গায় প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়েছে। এ সব ঘটনা অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসার মতো অবস্থা। যদিও প্রতিষ্ঠানটির ভেতর থেকে দেয়া তথ্যমতে- সারাদেশের সড়ক মহাসড়কে কমপক্ষে ৫০ হাজার অদক্ষ চালক বা ভুয়া লাইসেন্সধারী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান দাবি করছেন, ভুয়া লাইসেন্স এত হবে না। অনেক কম। কিন্তু কত কম সেটার কোন পরিসংখ্যান তিনিও দিতে পারেননি। তবে তিনি অভিযুক্ত তন্ময় কুমার ও বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের এডি যে ৩ হাজার ভুয়া লাইসেন্স প্রদান করেছিল- সেগুলো স্থগিত করা হয়েছে। এগুলো দিয়ে কোন চালক আর গাড়ি চালায় না।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকৃতপক্ষে বিআরটিএ’র কাছে কত অদক্ষ চালক লাইসেন্স পেয়েছেন কিংবা দক্ষ চালক ভুয়া লাইসেন্স পেয়েছেন তার কোন হিসেব নেই। কোন গবেষণাও নেই। যখন যেই চেয়ারম্যান যোগ দেন- তখন সেই চেয়ারম্যান তার মতো করে একটা হিসাব দিয়ে দেন। গত দুই দশক ধরেই চলছে এমন কা-। এ বিষয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেছেন, অযোগ্য ব্যক্তির কাছে প্রকৃত লাইসেন্স কিংবা ভুয়া লাইসেন্স যেটাই প্রদান করা হোক তা যাত্রীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। বিআরটিএ’র যারা এসব লাইসেন্স প্রদানের সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। একই সঙ্গে লাইসেন্সগুলো বাতিল করতে হবে। তবে আমাদের কাছে মনে হচ্ছে এখন আগের তুলনায় ভুয়া লাইসেন্স প্রদানের সংখ্যা কমে আসছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ জেলা সার্কেল হতে কোন রকম পরীক্ষা ও ভলিউম রেজিস্টার এন্ট্রি ছাড়াই জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে কমপক্ষে তিন হাজার লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। এ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ জেলা সার্কেলের (মোটরযান পরিদর্শক ও সহকারী পরিচালক ও অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোঃ মইদুল ইসলাম কে চাকরিচ্যুত করা হয়। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই একই ধরনের অভিযোগ ওঠে ঢাকা জেলা সার্কেলের তন্ময় কুমার ও বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে সালাহউদ্দিন নামের ভুক্তভোগী গ্রাহক বিআরটিএ’র চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। ওই অভিযোগের চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন’ তন্ময় কুমার ও বিল্লাল হোসেন অত্যন্ত ঠা-া মাথায় তাদের সার্কেল থেকে একদিনে ১৮৯টি ফিটনেস সার্টিফিকেট ও মাত্র তিন দিনে লাইসেন্স প্রদান করেছেন। ওই অঞ্চলের ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ছাড়াই গ্রাহকদের লাইসেন্স প্রদান করা হয়েছে। জানা গেছে, সুনির্দিষ্ট ওই অভিযোগ পেয়ে চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মুজুমদার তাৎক্ষণিক কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পরিচালক প্রশাসনকে নির্দেশ প্রদান করেন। বিষয়টি বর্তমানে তদন্ত করা হচ্ছে। এর আগেও তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনার পর সেটা প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় এখন বিভাগীয় তদন্ত করা হচ্ছে। এর আগেও অপর এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, বিআরটিএ ঢাকা জেলা সার্কেল সাভার কার্যালয় দালাল চক্রের কাছে জিম্মি। বিশেষ করে মাদ্রাজ সিকিউরিটিজের কিছু অসাধু ডাটা এন্ট্রি কম্পিউটার অপারেটর ও বিআরটিএর কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জালিয়াতি করে হাজার হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে। সদর দফতর থেকে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশগামী যাত্রীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাশীদের কোন রকম পরীক্ষা ছাড়াই শুধুমাত্র আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদান করা হয়। তন্ময় কুমারের বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগের সত্যতা খতিয়ে দেখার জন্য গত ১৯ অক্টোবর উপ-পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ জামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার সহকারী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তৌহিদ রেজা কে ৭ কর্ম দিবস সময় দেয়া হয়। চিঠিতে বলা হয়- তন্ময় কুমারের কম্পিউটারে ব্যক্তিগত প্যানেল থেকে অনুমোদন দেয়া বেশ কিছু রেফারেন্স নাম্বারের সত্যতা খতিয়ে দেখতে হবে। বিশেষ করে বিগত ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত ইস্যু করা নাম্বারগুলোর যথার্থতা দেখতে হবে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রশাসন শাখার এক কর্মকর্তা জানান, মেকানিক্যাল এসিস্ট্যান্ট বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে এর আগেও পিরোজপুর ও নেত্রকোনায় থাকা অবস্থায় ভুয়া লাইসেন্স ও ঘুষ বাণিজ্য করার দায়ে বিভাগীয় মামলা দায়ের করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে মামলা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা সার্কেলে পরিদর্শকের মতো অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়। এ নিয়ে চরম সমালোচনা শুরু হয়েছে গোটা বিআরটিএ অফিস জুড়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ -প্রকৌশল শাখার একজন কর্মকর্তা জানান- নিয়ম অনুযায়ী একজন ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রত্যাশী প্রথমে শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স লার্নার কার্ড ইস্যু হওয়ার সর্বনিম্ন ২ মাস পর পরীক্ষা দেয়ার সুযোগ পান। কিন্তু বিআরটিএ সাভার সার্কেলে ঘটেছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য কা-। দেখা গেছে, লার্নার কার্ড ইস্যু এবং পরীক্ষার তারিখ এডিট করে পরের দিন পরীক্ষার্থী উপস্থিত না থাকলেও পরীক্ষায় পাস দেখানো হয়েছে। এজন্য সহকারী পরিচালক তন্ময় কুমার, মোটরযান পরিদর্শক শফিক, মোটরযান পরিদর্শক হোসনে মোবারক, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আব্দুল আউয়াল, অফিস সহকারী আরিফ এবং এক সময়ের ইকুরিয়ার অফিসের পেশাদার দালাল বর্তমান সময়ের আলোচিত (মোটরযান পরিদর্শক অতিরিক্ত দায়িত্ব) বেলাল হোসেন নেত্রকোনা সার্কেল ও পিরোজপুর জেলা সার্কেল হতে পরীক্ষা ছাড়াই ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করে। জানা গেছে, স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি ভুয়া গাড়ির নিবন্ধন ও ফিটনেস জালিয়াতি প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দায়ের করে বিআরটিএ। এ ধরনের বিভাগীয় মামলা চলমান থাকার পরও দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তা সাভার সার্কেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স শাখার দায়িত্বে বহাল রয়েছে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে সরেজমিন পরিদর্শন ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অনেকেই টাকা জমা দিয়েও সঠিক সময়ে লাইসেন্স পাচ্ছেন না। আবার অনেকে পরে জমা দিয়েও পেয়ে যাচ্ছেন। ওই সার্কেলের এডির ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে লাইসেন্স প্রদান। বিশেষ করে বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির অনেক ভিসা বাতিল হয়ে গেছে- শুধু সময়মতো লাইসেন্স না পাওয়ায়। এমন একটি প্রমাণিত অভিযোগ যার বিরুদ্ধে সেটা যিনি তদন্ত করছেন তারও নৈতিকতা ও সততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যিনি এতদিন নিজেই তাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন সেই জামালকে দিয়েই তন্ময়ের দুর্নীতির তদন্ত করানোর সিদ্ধান্তে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে বিআরটিএ’র সাধারণ স্টাফদের মাঝে। এরই মাঝে অভিযুক্তদের রক্ষা করার জন্য আপোস রফার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, অভিযুক্ত তন্ময় কুমার ও বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের চাকরি যাবে। আমরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মতো কাজ কাউকে করতে দেব না। বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা থাকা সত্ত্বেও তাকে কিভাবে ঢাকা সার্কেলের মতো জায়গায় পরিদর্শকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলো প্রশ্ন করা হলে নূর মোহাম্মদ মজুমদার তার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, হ্যাঁ। তার বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ তদন্ত করা হয়েছে। এখন আবার তার বিরুদ্ধে তদন্ত করা হচ্ছে। এবারের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সোজা চাকরি চলে যাবে। আমরা তার দায় নেব না। ঢাকা জেলা সার্কেলের তন্ময়ের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যিনি তদন্ত করছেন সেই জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধেও অনৈতিকভাবে এ ঘটনা আপোস রফা করার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, এটা আমার নলেজে নেই। মনে হয় এ অভিযোগ ঠিক নয়।
×