ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে কিছু কথা

প্রকাশিত: ২১:২১, ২৭ অক্টোবর ২০২১

সাম্প্রদায়িকতা প্রসঙ্গে কিছু কথা

প্রথমে ঘৃণা জানাই সেই কুলাঙ্গার ও তার ইন্ধনদাতাদের যারা সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দিতে কুমিল্লার এক পূজাম-পে পবিত্র কোরান শরিফ রেখেছে। পরে এটাকে কেন্দ্র করে যারা দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজাম-পে ভাংচুর ও হত্যাকা- ঘটিয়েছে, তাদের ধিক্কার জানানোর ভাষা আমার জানা নেই। শুধু মনে প্রশ্ন জাগে তারা কি সত্যি মানুষ? তাদেরকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির জোর দাবি জানাচ্ছি সরকারের প্রতি। সেটা করতে গিয়ে নিরপরাধ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয় সেই দিকেও লক্ষ্য রাখার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান রাখছি। বাঙালী হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হাজার বছর ধরে চলে আসছে। আমরা হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রীস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বী একসঙ্গে বসবাস করছি। আমরা এ দেশে কখনও সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিইনি। এটা আমরা বড় গলায় বলতে পারি।’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বড় গলায় বলতে পারার বিষয়টা আমার কাছে হাস্যকার বলেই মনে হচ্ছে। ছোট গলায় বললে হয়ত এমনটা মনে হতো না। শারদীয় দুর্গাপূজা ম-প পরিদর্শন করে আর গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নিতাই রায় চৌধুরীকে দুই পাশে বসিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করে অসাম্প্রদায়িকতার কথা মুখে আওড়ালেই বিএনপিকে অসাম্প্রদায়িক দল বলে প্রমাণ করা যায় না। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা ও ৩ নবেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে শাহ আজিজুর রহমান, মশিউর রহমান যাদু মিঞার মতো বহু স্বাধীনতাবিরোধী ও উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীকে নিয়ে প্রথমে জাগদল পরে বিএনপি নামক দলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেককে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে দলে ভেড়ান। শাহ আজিজুর রহমানকে করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী আর মশিউর রহমান যাদু মিঞাকে করেন সিনিয়র মন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা অসাম্প্রদায়িকতাকে ধারণ করে ১৯৭২ সালে ৪ নবেম্বর অনুমোদিত হয় বাংলাদেশের সংবিধান। বিএনপি নামক দলটিই সেই সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে বাংলাদেশকে আবারও পাকিস্তানী কায়দায় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করে। আরেক জেনারেল হোসেন মুহম্মদ এরশাদ আরও এক ধাপ এগিয়ে সাম্প্রদায়িকতার শেষ পেরেকটি মারেন সংবিধানে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এ জমিনে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার সমান অধিকার। একথাটি বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। এজন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় বলতেন, ‘রাজনীতিতে যারা সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে, যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের অন্তর ছোট। যে মানুষকে ভালবাসে সে কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। আপনারা যারা মুসলমান তারা জানেন যে, খোদা যিনি আছেন তিনি রাব্বুল আলামীন– রাব্বুল মুসেলমীন নন। হিন্দু হোক, খ্রীস্টান হোক, মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক সমস্ত মানুষ তার কাছে সমান।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলতেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে– কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নেই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে– কারও বাধা দেয়ার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রীস্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে– তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না।’ অধিকার থেকে কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে বঞ্চিত করার সমর্থন ইসলাম দেয় বলে আমার জানা নেই। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই শতাধিক নিয়োগ দিলেও কেবল অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ হবার কারণে অনেক মেধাবী ছাত্র বঞ্চিত হয় নিয়োগ পাওয়া থেকে। এমন চিত্র প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিল বললে ভুল হবে না। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল প্রফেসর জাফর ইকবাল তার সিএসই বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য থাকার কারণে নিয়োগ পান চন্দন কুমার কর্মকার। আমাদের গণিত বিভাগে চন্দ্রানী নাগ, অথচ তার নিয়োগ ঠেকাতে নিয়োগ বোর্ডের বিশেষজ্ঞ সদস্য একজন সজ্জন ব্যক্তি প্রফেসর মুনিবুর রহমান চৌধুরী স্যারকে তার মেয়াদ শেষ হবার আগেই সিন্ডিকেটে বাদ দিয়ে অন্যজনকে নেয়া হয়েছিল। কেননা, তিনি মেধার মূল্যায়ন করতেন। চন্দ্রানী নাগের মাস্টার্সে সিজিপিএ ছিল চারের মধ্যে চার। সে ছিল সবচেয়ে যোগ্যতম প্রার্থী। আমি বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সেই নিয়োগ বোর্ডের সদস্য ছিলাম। তার নিয়োগে আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (দায়িত্বপ্রাপ্ত) থাকাকালীন অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমি যত নিয়োগ দিয়েছি, তার মূল্যায়ন করবেন আমার সহকর্মীরা। কাজেই দেশের সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে বিএনপির অসাম্প্রদায়িক সাজার চেষ্টা করা সত্যিই হাস্যকর। ২০ অক্টোবর ২০২১ লেখক : উপাচার্য, নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×