অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দীর্ঘ আট বছর পর বাংলাদেশ থেকে আবারও তৈরি পোশাক কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ব্র্যান্ড ওয়াল্ট ডিজনি। এর ফলে মহামারি করোনাভাইরাসের মধ্যেও ইতিবাচক ধারায় থাকা বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে আরও ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার যোগ হবে বলে আশা করছেন পোশাকশিল্পের মালিকরা।
পোশাকশিল্পের মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আট বছর আগেই ওয়াল্ট ডিজনি বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৫০ কোটি ডলারের পোশাক নিত। এই দীর্ঘ সময়ে তাদের চাহিদা অনেক বেড়েছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোতে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ভালোর দিকে। সেসব বাজারে পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। সব মিলিয়ে নতুন এই পরিস্থিতিতে ওয়াল্ট ডিজনি আমাদের কাছ থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক কিনবে বলে প্রত্যাশা করছি।
এ বিষয়টি বাংলাদেশের পোশাক খাতের সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল করবে বলেও আশা করেন বিজিএমইএর নেতা। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, এটি বিশ্বের ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক উজ্জ্বল করবে। বিশ্বের অন্য বড় বড় ক্রেতাও এখন পণ্য কিনবে। আমাদের পোশাকের দাম বাড়ানো নিয়ে যে দেনদরবার করছি, সেখানেও আমরা আরও জোর দিতে পারব।’
১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ওয়াল্ট ডিজনির বিক্রয়কেন্দ্র বর্তমানে তিন শতাধিক। প্রতিষ্ঠানটি নারী-পুরুষের পাশাপাশি বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি করে। এ ছাড়া বাচ্চাদের খেলনাসহ নানা ধরনের পণ্যসামগ্রী বিক্রির জন্য জনপ্রিয় ডিজনি। তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন এবং রাসা প্লাজা ধসের ঘটনার পর ২০১৩ সালে ওয়াল্ট ডিজনি বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশ থেকে আবারও পোশাক কেনার বিষয়টি ওয়াল্ট ডিজনি এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে না বললেও তা নিশ্চিত করেছেন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেছেন, ‘ওয়াল্ট ডিজনির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রমমান নিরীক্ষা বিবেচনায় নিয়ে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানটি তার অনুমোদিত সোর্সিং দেশের তালিকায় আবার বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।’
তিনি বলেন, ‘ওয়াল্ট ডিজনির ফিরে আসাটা আমাদের পোশাকশিল্পের জন্য সুখবর। কারণ, সম্প্রতি ভারত থেকে প্রচুর পোশাক আমদানি করত তারা। মিয়ানমারের সঙ্গেও ব্যবসা শুরু করেছিল। ফলে আশা করছি, আমাদের উদ্যোক্তারাও ওয়াল্ট ডিজনি থেকে শিগগিরই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্রয়াদেশ পাবেন।’
তিনি বলেন, ‘এই করোনা মহামারির মধ্যেও আমরা যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে উৎপাদন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ক্রেতাদের কাছে পোশাক তুলে দিচ্ছি। এতে আমাদের সুনাম আরও বেড়েছে।’
২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালে সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মপরিবেশ নিয়ে ক্রেতা দেশগুলোর মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয়। বিদেশি অনেক সংগঠন বাংলাদেশি পোশাক বর্জনের ডাক দেয়।
তার পরিপ্রেক্ষিতে কারখানা পরিদর্শনে ইউরোপীয় ২২৮টি ক্রেতার সমন্বয়ে গঠিত হয় অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি পায়। আর একই লক্ষ্যে গঠিত আমেরিকার ক্রেতাদের জোট পরিচিতি পায় অ্যালায়েন্স নামে। পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর সহযোগিতায় রিমেডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল (আরসিসি) গঠন করে সরকার।
এরপর বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে ব্যাপকভিত্তিক সংস্কার কাজ শুরু হয়। কারখানার অবকাঠামো উন্নয়ন, আগুন থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা, শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে বাস্তবায়ন করা হয় বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা। এর বাইরে বিভিন্ন দাতা সংস্থার উদ্যোগে শ্রমিকদের কর্মদক্ষতার উন্নয়নে প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
এ ছাড়া মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর উদ্যোগে উচ্চমূল্যের পণ্য উৎপাদন, পোশাকপণ্যের ভ্যালু সংযোজন ও পণ্যের বহুমুখীকরণেও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে, যাতে বিনিয়োগ হয়েছে বিপুল অঙ্কের টাকা।
ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে কারখানার নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশের সুনাম বেড়েছে। হংকংভিত্তিক সাপ্লাই চেইন কমপ্লায়েন্স সল্যুশনস প্রোভাইডার, ‘কিউআইএমএ’ তাদের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ‘ইথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং’ দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিজিএমইএ বলছে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানার অবস্থান বাংলাদেশেই। বাংলাদেশের ১৪৪টি কারখানা ইউএসজিবিসির লিড গ্রিন সনদ পেয়েছে, যার মধ্যে ৪১টি প্লাটিনাম স্তরের।
মহামারির মধ্যেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। সদ্য শেষ হওয়া ২০২০-২১ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ৩ হাজার ৫১৮ কোটি (৩৫.১৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি।
ফারুক হাসান বলেন, ‘আমরা যতটুকু খবর পেয়েছি, অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। আমরা আশা করছি, অর্থবছর শেষে ১৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হবে। মহামারির এই কঠিন সময়ে এটা একটা বড় সাফল্য বলে আমি মনে করি। সরকারের প্রণোদনা আমাদের এ ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে।’
মহামারি শুরুর আগেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। সে সময় বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪০০ কোটি বা ৩৪ বিলিয়ন ডলারের মতো, যা বিশ্বের মোট পোশাক রপ্তানির ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।