জীবনের বাস্তব চিত্র নিয়ে বারোটি গল্প লিখেছেন নাজনীন স্বপ্না। শেষ থেকে শুরু, অন্ধকারের পথে, অপরাজিতা, একলাই, অধরা, অনন্তের পথে, বিলম্বিত বাসর, নির্ঘুম, বান্ধবী, অনুরাধা, গল্প নয়, শাদা শাড়ি - মোট এই বারোটি শিরোনামে বারোটি গল্প। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে লাবণ্যের সাথে হয় জাহিদের প্রেম। কিন্তু বাড়ির মানুষরা বিত্তশালী এক ধনীর দুলালের সাথে লাবণ্যের বিয়ে ঠিক করে। লাবণ্য কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নেয় আর জাহিদ কবি হেলাল হাফিজের মতো একাকীত্বের জীবন বেছে নেয়, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করে আর বিয়ে করবে না। পরে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। দু’বছর পর বরিশালে বানারীপাড়া কলেজে নতুন চাকরি নিয়ে জাহিদ আসে। সেখানের বাসায় লাবণ্যের উপস্থিতি। সে-ও একই কলেজে ছ’মাস ধরে চাকরি করছে। তার হবু স্বামীটি ক্রসফায়ারে মারা যায়, এরপর সে-ও বিয়ে করেনি। কলেজে যোগ দিয়ে বাসায় এসে দুপুরের ভাত-ঘুমের পর জেগে দেখে ড্রাইংরুমে লাবণ্য বসে। তারপর চার চোখের মিলন। শুরুর গল্পটি ‘শেষ থেকে শুরু’ এই। এর পর অন্য এগারোটি গল্প নগর সভ্যতার বিভিন্ন পরিবেশের গল্প।
গল্পগুলো রাবীন্দ্রীক সংজ্ঞায় ছোট গল্পের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিচিত্রভাবে এগিয়ে গেছে। তবে শেষের গল্পটি ‘গল্প নয়’ গল্পের আদলে পড়ে বলে মনে হয় না। গল্পের ভেতর সন, তারিখ যেভাবে লেখা, সেভাবে গল্প লেখা হয় না সচরাচর। এটি লেখকের (লেখিকার) জীবনের একটি অংশ বলে ধরে নেয়া যায়। ‘অন্ধকারের পথে’ গল্পটিতে উঠে আসে এক গ্রাম্য সহজ সরল মেয়ে পরী শহরে এসে শৈশব থেকে বেড়ে উঠতে গিয়ে প্রথম গৃহস্বামীর কাছে সম্ভ্রমহানীর শিকার হয়। পরে আশ্রয়নেয়া চাচার খায়েশের শিকার হয়। এভাবে যখন সে বুঝতে পারে তার জীবনের কোন মূল্য নেই তখন সে পুরো সোসাইটি লেডি ন্যান্সি হয়ে যায়। নগরের সমাজ সেবক, সমাজপতিদের রাতের থেকে অজ¯্র অর্থের বান্ডিলের মালিক হয়ে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে বিলাসী জীবনযাত্রা শুরু করে।
এভাবে প্রায় সব গল্পই চলতে শুরু করে। গল্পগুলোতে কঠিন কোন বর্ণনার ঘনঘটা নেই। খুবই সাদাসিধা বাক্যে ঘটনা বলার দক্ষতা সহজেই পাঠকের কাছে আবেদন রাখে। লেখকের প্রথম গল্পের বই হিসেবে এ দক্ষতা আমাদের কাছে তাঁর যোগ্যতার দাবী রাখে।
‘একলাই’ আর একটি বিচিত্র গল্প। পথের টোকাইকে নিঃসন্তান ¯িœগ্ধা ছেলের মতো ভালবাসে। একদিন সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে বাড়ি এনে রাখবে, বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেবে। পরদিন ছেলেটির আড্ডাস্থলে গিয়ে খোঁজ নেয়। কিছু পরে দেখে কাছেই সড়কে তার রক্তাক্ত দেহ। গাড়ি চাপা দিয়ে চলে গেছে।
আমাদের মহানগরগুলোর নিত্যদিনের ঘটে যাওয়া অনেক সাধারণ ঘটনাই এ বইয়ে গল্প হয়ে উঠেছে। অতিলৌকিকতা নেই। আশা করা যায়, এভাবে লিখতে লিখতে হয়ত লেখক একদিন অনেক বড় কথাশিল্পী হয়ে উঠবেন।
তবে ভাষায় এবং বানানে বেশ যতœহীনতার ছাপ দেখা যায়। বইয়ের প্রথম ফ্ল্যাপের লেখক নিজের পরিচিতি লিখেছেন “শক্তিমান কথাসাহিত্যিক এবং জেষ্ঠ্য সাংবাদিক”। এভাবে কেউ নিজের পরিচিতি জাহির করে এমনটি সচরাচর দেখা যায় না। এখানে জ্যেষ্ঠ বানানকে ভুল লেখা হয়েছে। এখানে ‘গল্পের মানুষগুলোর ভেঙেপরা আর ওঠে দাঁড়াবার . . . ’ স্থানে দু’টো ত্রুটি দেখা যায়। ভেঙেপড়া স্থানে লেখা হয়েছে ‘ভেঙেপরা’ এবং ‘ওঠে দাঁড়াবার’ স্থানে হবে ‘উঠে দাঁড়াবার’। এমনটি গল্পলেখকও অনেক স্থানে ‘ওঠে’ লিখেছেন যেখানে হবে ‘উঠে’। “ডাক্তার বলেছেন, বাকিটা বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠবে।” (পৃষ্ঠা-৮১)। “কে একজন এসে খবর দিলো পালকি এসেছে। চার বেয়ারার পালকি।” (পৃষ্ঠা-৯১)। কথাটি হলো বেহারা যারা পালকি কাঁধে বহন করে। এ ভুলটি ৯২ পৃষ্ঠাতেও আছে। তবে ‘কিংবা’ স্থানে ‘কিম্বা’ এবং ‘সংবরণ’ স্থানে ‘সম্বরণ’ ব্যাকরণসিদ্ধ, আগে এভাবে অনেকেই লিখতেন। বিষয়টি আমার কাছে বেশ কৌতুহলুদ্দীপক লেগেছে।
বইটি মুদ্রণে কোন ত্রুটি নেই তবে ভেতরের ক্যানভাসে স্তবক বিন্যাসে আরো রুচিবান হতে হবে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। সুন্দর। মানোন্নত।
গল্পগুলোর ংঁস ঁঢ় তুলে ধরে। ইডেন বিশ^বিদ্যালয় কলেজের রসায়নের স্নাতকোত্তর নাজনীন স্বপ্না আমাদের আগামী দিনে আরো সুন্দর ংযড়ৎঃ ভরপঃরড়হং, ভরপঃরড়হং উপহার দেবেন।