ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

গল্প ॥ শক্তি

প্রকাশিত: ২১:১২, ২৮ মে ২০২১

গল্প ॥ শক্তি

কীর্তননাগ বিল তখনই ফোঁস ফোঁস করতে থাকে যখনই এ গ্রামগুলোতে বিয়ের সানাই বেজে উঠে, আবার যখনই কীর্তননাগ বিল যৌবনের উন্মাদনায় ছটফট করতে থাকে তখনই এ গ্রামগুলো বিয়ের উষ্ণতায় উচ্ছল হয়ে উঠে। দুই পাশে দুটি করে চারটি গ্রাম, মাঝখানে বিশাল এক বিল এ কীর্তননাগ। বর্ষায় ভরে উঠে, তলার মাটির দ্যাখা পেতে পেতে সেই কার্তিকের শেষ নাগাদ। শ্রাবণ ফুরিয়ে এলে ভাদ্রের ঝকঝকে দিন আর চকচকে তারা ভরা রাতে এসব গ্রামের ছেলে-মেয়েদের বিয়ে হয়। কালের পরিক্রমায় ইতিহাস হয়ত একদিন সাক্ষ্য দেবে, এ মৌসুমে এ অঞ্চলে বিয়ে একটি ঐতিহ্যই বটে। এ কয় গ্রামে প্রাণের উৎসব বলতে ভরা বিলের বুকে বড় নাও হাঁকিয়ে হৈ হুল্লোড় করতে করতে বর নিয়ে যাওয়া ও কনে নিয়ে আসা- এখনও পর্যন্ত প্রাণের অনেক ভেতরে এটির বসবাস, দ্বিতীয় আর কোনটি ঢোকার সাহস করেনি। এ বিল যে বিপদ-বিপত্তির বাইরে, তা কিন্তু নয়। বিলের ভেতরে একবার ঢুকে পড়লে আশঙ্কা-শঙ্কায় জড়িয়ে ভয়ার্ত হয়ে উঠা সহজ ব্যাপারই বলা চলে; পাশাপাশি নিরাপত্তার রশিতে নিজেকে বেঁধে ফেলা বেশ কঠিনই। লড়াই করার কোন সুযোগ নেই-হাল আর মনোবল ছাড়া। বাতাসের চরিত্র বড়ই বিচিত্র। কখন যে সে দুশ্চরিত্র হয়ে উঠবে, এ খবর কেবল তারই জানা। এ বিলে ঝড় একবার উঠলে ভালই তা-ব হয়। প্রায় প্রতি বছরই দুই-একটা নৌকা ডুবে। এ সময় পর্যন্ত গোটা তিনেক প্রাণ নাশের ঘটনাও ঘটেছে। এডা একটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যে থাকলে কেউ ঠ্যাকাবার পারবে! ঘরের মধ্যেও তো তুই মরব্যার প্যারিস। ঘটনা ঘোটপ্যারই পারে। বিপদের কতা কওয়া য্যাবে? তাই ব্যুলা আনন্দ-ফুরতি বন্দ থ্যাকপে? বিয়া বন্দ হয়া য্যাবে? আমাকেরে বাপ-দাদারা করিছে, আমরাও করমু। বেশিরভাগ মানুষেরই আস্থা, বিশ্বাস, ভাবনা এখানে স্থির হয়ে আছে। লাও তো ডুববেই! ক্যারে ম্যাজি, লাওত চড়ার আগে কওয়া যায় না-নাগরাজ, তুমার বিলের মধ্যে দিয়া আমাকেরে যাওয়া, বাঁচা-মরা তুমার হাতোত, আমাকেরোক তুমি রক্ষা কর! এই এ্যানা কতা কলে কী হয়? শালাকেরে লাও তো ডুববেই। যার যেটি ক্ষমতা- এডা মানা ল্যাগবে। কিছু মানুষের বিশ্বাস এখানে আটকে আছে। নামাজ-কালাম নাই, রাত-দিন ওই চায়ের স্টলোত ব্যোসা ব্যোসা চা-বিড়ি-সিগারেট খাবু আর সিনামা দেকপু- লাও ডুববে না তে কী হোবে! কো, আমাকেরে লাও তো ডুবে না? লাওত ব্যোসাও দোয়া-দরুদ পড়া লাগে। আর তুরা? কী ব্যাবাক আজেবাজে গপ্প আর বিড়ি-সিগারেট! তাছাড়া আরাকটা কারণও তো আছে। হিন্দু নামে বিলের নাম! তুরকেরোক কত ক্যোরা কনু, যেটি যাওয়া লাগে চল যাই, নামডা বদল্যায়্যা ফেলি, তুরা মাতাই তুলিস না! ক্যারে ওই দুই-চার ঘর হিন্দুর জন্যে এ্যাকুনো বিলের নাম হিন্দু থ্যাকপে? এইবার কিন্তু ছাড়মু না আমি! এ বিশ্বাস, এ বক্তব্য গ্রামের সবচেয়ে সম্পদশালী মানুষ আমিন ম-লের, যার পাক্কা একশত বিঘা জমি ডুব মেরে আছে ওই বিলের পানির তলায়। আগামীকাল তার ভাতিজার বিয়ে, বিলের ওপারের গাঁয়ের কন্যার সঙ্গে। আমিন ম-লের অবশ্য এই গরম বক্তব্যের পেছনে একটা গরম অবস্থান আছে। গ্রামের কিছু কিছু সালিশ-বিচার তার হাত দিয়ে সমাধা হয়ে থাকে। দু-একটা অন্যায় বিচার যে সে করে না, তা কিন্তু নয়। রাজনীতির আধুনিক হাওয়া গায়ে লাগার ফলে দুই একজন এই সিংহাসনটা দখল করতে চায়, কিন্তু ওই এম,পি,ইউ,এন,ও,ও,সি’দের তার বাড়িতে যাতায়াতের কারণে মাথাটা অতদূর তুলতে পারে না। নৌকায় উঠার আগে বাড়ির বউদের একবার কাঠগড়ায় দাঁড় করাল আমিন ম-ল। ব্যাটাকেরোক লিয়া আমি ককুনও ভ্যাবি না। তুমাকেরোক লিয়া যত জ্বালা আমার। বড় বউ, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়িছো? হ্যাঁ। মেজ বউ? হ্যাঁ। ছোট বউ? মাথা বাঁ দিকে কাত করল। কতা কবার না চ্যালে কয়ো না, তাই ব্যুলা মাতা ড্যান দিকে কাত করা যায় না? সে এবার ডান দিকে কাত করল। হুঁ, ঠিক আছে। এবার চোখ ঘুরিয়ে আসল মাঝিকে না দেখে আষাঢ়ের মেঘের মতো গর্জন করে উঠল- তুই ক্যারে? তুর বাপ কুন্টে? হঠাৎ করেই সকাল থেকে বাবার পেটে ব্যথা, তাই আমি এসেছি। তুই পারবু? মাঝির বেটা, নৌকার হাল ধরতে না পারলে হবে! এ বিল তো আমি সপ্তাহে তিন দিন এই নৌকা নিয়ে পার হই। নিশ্চিন্তে উঠে পড়েন। কোন সমস্যা হবে না। ভালই তো চ্যাটাং চ্যাটাং ক্যোরা কতা কোস! ল্যাকাপড়াও তো করিস মনে হয়? হ্যাঁ চাচা। বি,এ করছি। ঠিক আছে। আল্লার নাম লিয়া ছেড়া দে। শুনো, লাওত ব্যোসা ব্যাবাকে দোয়া-দরুদ পড়বে। ষাট জন বরযাত্রী নিয়ে নৌকাটি বিলের বুক ফেঁড়ে ছুটে চলছে কনের বাড়ির দিকে। নৌকা চলুক। এ ফাঁকে আমরা বিলটি এক নজর দেখে নিই। মোটামুটি বর্গাকৃতির এ বিল। বাকি দুই প্রান্তে কোন বসতি নেই। পাড় বা কোন রাস্তাও নেই। ওই দুই প্রান্ত দিয়ে ছোটো-খাটো কয়েকটি বলের সঙ্গে মিশে গেছে বিলটি। পানির দৈর্ঘ্য হাত সাতেক হবে। দুই পাড়ের গ্রামের এ শূন্যতা অতিক্রম করতে একটা শ্যালোচালিত নৌকার ঘণ্টা দেড়েক লেগে যায়। বর্ষার ঢলে এ বিল পূর্ণ যৌবনা হয়ে উঠে। বিলটির জন্ম কবে কখন, কেউ বলতে পারে না, এমনকি কীর্তননাগ নাম কেন হলো, সে সম্পর্কেও এরা অজ্ঞাত। তবে একটা লম্বা-চওড়া সাপকে ক্ষীপ্র গতিতে এ বিলটি পার হতে কেউ কেউ দেখেছে। তাদের ধারণা, সেটি নাগরাজ, আর সেই কারণেই এই নাগ। তাহলে কীর্তন? না, কেউ কিচ্ছু জানে না। দেড় ঘণ্টার কিছু সময় বাকি থাকতেই ঠিকঠাক পৌঁছে গেল নৌকাটি। বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষে নববধূকে নিয়ে এরা আবার নৌকায় উঠল। ছোট বৌমা তুমি এইবার বোরকার ঘোমটাডা নামাও, মুক ঢ্যাকা ফ্যালো। জামাইয়ের দুই জন বন্দু উঠিছে লাওত। গাঁয়ের মানুষগুলাক না হয় মানা যায়, এ্যারকেরক লয়। মুখ ঢেকে ফেলল ছোট বউ। বিলের মাঝামাঝিতে ঢোকার পর মুহূর্তেই আকাশ কিছুটা কালো বেশ ধারণ করে গুরুগম্ভীর হয়ে উঠল। বাতাস উঠেছিল। দেখতে দেখতে নিমিষেই তা এক রকম ঝড়ের রূপে আবির্ভূত হলো। শান্ত পানি অশান্ত হয়ে উঠল। ঢেউগুলো সব ফুঁসতে ফুঁসতে এসে নৌকার বাতায় সজোরে আছড়ে পড়তে লাগল। কেঁপে উঠল আমিন ম-ল। শঙ্কায় বুকটা কেমন জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আসল। অনেকটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল- ব্যাবাকে দোয়া-দরুদ পড়ো। আল্লার কাছে জীবন ভিক্কা চাও। মাঝির কাছে এলো। ক্যারে তুই ঝিম ম্যারা আছু ক্যা? কী হোছে? টিমটিম করুচ্ছু ক্যা? মনে হত্তে তুই ব্যাঁচা নাই! তুই এ্যাতো ভয় প্যালে লাও কিভাবে পুঁচপে? আমার তকুনই সন্দে হোছলো, তুই পারবু কি না! বাবা, সুনা তুই শক্ত হ, মুনোত বল আন। আল্লা’র কাছে শক্তি চা। তুই না চ্যালে তো আল্লা এমনি এমনি দেবে না। এই ব্যাবাকে আল্লাক ডাকো। মাঝির এ অসাড়তায় ম-লের ভরসার জায়গাটুকু কাশবনের মতো দুলতে লাগল। ছোট বউ এক ঝলক মুখটা বের করে মাঝির দিকে চেয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। মাঝি জীবিত হয়ে উঠল। নৌকা নাগরাজের মতো ছুটে চলল বিলতলী গ্রামের দিকে।
×