বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আলোচিত রোমাঞ্চকর কিশোর চরিত্র রয়েছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অমর সৃষ্টি শ্রীকান্ত বা কবিগুরুর বলাই, ফটিক ইত্যাদি এরকম আরো চরিত্র রয়েছে। উপন্যাস, গল্পে এসব কিশোর চরিত্র পাঠে মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছে এবং যুগ যুগ ধরে সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে ঠাঁই করে নিয়েছে। মোটকথা এসব চরিত্র কালোত্তীর্ণ হয়েছে। এরকম আরেকটি রোমাঞ্চিত কিশোর চরিত্র মুহাম্মদ জাফর ইকবাল রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ এর রাশেদ নামের চরিত্রটি। উপন্যাসে ‘রাশেদ’ কেন্দ্রীয় চরিত্র। রাশেদ ও তার বন্ধুদের নিয়েই গল্প এগিয়েছে। পুরো গল্পে রাশেদের চরিত্রের সঙ্গে যেসব বৈশিষ্ট্যের মিল রয়েছে তার মধ্যে রয়েছে সাহসিকতা, দেশপ্রেমিক, বন্ধুত্বপরায়ণ, আবেগপ্রবণ, উপস্থিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং একইসঙ্গে রাশেদ প্রচ- মানসিক শক্তি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন। অন্যান্য কিশোর চরিত্রগুলোর থেকে বহুদিক থেকেই রাশেদ চরিত্রটি স্বকীয়। রবীন্দ্রনাথের ফটিকের জন্য যেমন পাঠককুলের হৃদয় আবেগালুপ্ত হয়, রাশেদের জন্যও একই অনুভূতি হয়। রাশেদের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য পাঠকের হৃদয়ে জল আসে। ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ উপন্যাসের গল্প নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেই চলচ্চিত্রেও রাশেদের চরিত্র পূর্ণতা পেয়েছে। রাশেদের পাঠক এবং দর্শক দুই মাধ্যমের রাশেদকেই সমানরূপে গ্রহণ করেছে। গল্পের রাশেদের চরিত্রের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো সহজ-সরলতা এবং সত্য বলার ক্ষমতা। গল্পের শুরুতেই যখন রাশেদ নতুন স্কুলে ভর্তি হয়ে ক্লাসে আসে তখনই স্যারের সঙ্গে এবং বন্ধুদের সঙ্গে তার জীবন সম্পর্কে সত্য কথাগুলো অবলীলায় বলে দিয়েছিল। যেমন- তার নাম যে রাশেদ এটা স্কুল থেকে দেওয়া। আদতে তার নাম ছিল লাড্ডু। যা নিয়ে প্রথমে ক্লাসের সবাই হেসে উঠেছিল। আবার রাশেদের বাবা যে ‘পাগল কিসিমের’ তা অবলীলায় বলে দিয়েছিল। ঐ বয়সেই রাশেদ দেশের রাজনীতির গতি প্রকৃতি সম্পর্কে সব খোঁজখবর রাখতো। এসব নিয়ে সে তার বাবার সঙ্গেও আলোচনা করতো। গল্পে রাশেদ ও তার বন্ধুরা যে কয়েকবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং স্থানীয় রাজাকারকে হেনস্তা করে তা সবই রাশেদের বুদ্ধিতেই হয়েছে। রাশেদ চরিত্রটি শুরু থেকেই পাঠককে নিজের দিকে টানতে সক্ষম যা একটি চরিত্রের বড় বৈশিষ্ট্য। গল্পের রাশেদ মাতৃ¯েœহ থেকে বঞ্চিত এবং বাবা থাকলেও বাবার সাহচর্য খুব একটা পায়নি। মোটামুটি ছন্নছাড়া বাধনহীন জীবনেই পাঠকরা তাকে পায়। তার চারিত্রিক গুণ দিয়ে সে সহজেই নতুন স্কুলের বন্ধুদের কাছে টানতে পেরেছিল। তারা কয়েকজনের একটি দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা একসঙ্গেই কাজ করেছে। বাধনহীন পরিবেশে বড় হয়ে উঠলেও দেশ তাকে গভীরভাবে ভাবাতো। বন্ধুদের বর্ণনামতে রাশেদ শ্যামলা রঙের এবং তার চোখ দুটো ভাবুক। আপাতদৃষ্টিতে রাশেদকে দেখতে সাধারণ মনে হলেও বাস্তবিকপক্ষে রাশেদ এক অসাধারণ ছেলে ছিল। প্রতিবাদ করা ছিল রাশেদের স্বভাবজাত। নতুন স্কুলে এসেই দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তার সহপাঠী কাদেরের সঙ্গে। তাদের ভেতর হাতাহাতিও হয়। যদিও কাদের ছিল তার থেকে বড় এবং শক্তিশালী। কিন্তু রাশেদকে অন্যায়ভাবে আক্রমণ করায় রাশেদ একটুও ভয় না পেয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল। আবার একদিন গভীর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রাশেদ যখন এই কাদেরকেই মুক্তিযোদ্ধারূপে আবিষ্কার করে তখন তাকে জড়িয়ে ধরে সেই আবেগময় স্মৃতি পাঠকের চোখের কোণেও জল এনে দেয়।
মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে আসার পর রাশেদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়। রাশেদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি অর্থাৎ তাদের স্কুলের একটা মানচিত্র তার বন্ধুদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে সেটা সে এবং তার বন্ধু দুজন দিতে যায়। আর সে রাতেই কাদেরের সঙ্গে তার দেখা হয়। একটা কিশোর কতটা সাহসী হলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বড়দের সঙ্গে মশাল মিছিলে অংশ নেয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী শহরে আসলে তা দেখার জন্য ছুটে যায় যখন শহরের বেশিরভাগ মানুষই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে ছিল সেই সময়। রাশেদের সামনেই সেদিন গুলি করে মেরেছিল পাকিস্তানের দুই দালালকে। এতটুকু বয়সে এই দৃশ্য দেখার মতো শক্তি খুব কম চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে। অথচ রাশেদ ছিল একদম সাধারণ একজন। সাধারণের মধ্যেই এক অনন্য সাধারণ চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। রাশেদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা যে বড়দের থেকে কম ছিল না তারও প্রমাণ মেলে উপন্যাসের বর্ণনায়। পশ্চিম পাকিস্তান যে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না সেটা রাশেদের বয়সী একটা কিশোরও বুঝতে পেরেছিল। ওরা যে কেবল আমাদের শোষণ করেই বেঁচে রয়েছে এই গভীর অনুভূতি রাশেদের মধ্যে ছিল। রাজাকার আজরফ আলীকে খোলা রাস্তায় সবার সামনে যেভাবে নাস্তানাবুদ করে রাশেদ তা যেমন রাশেদের সাহসিকতার প্রমাণ দেয় অন্যদিকে পাঠককে আনন্দও দেয়। উপন্যাসে রাশেদ যে দুইবার অস্ত্র হাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে তা আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা শফিক এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। প্রথমবার শফিকের গায়ে যখন গুলি লাগে তখন আবার যখন সেখান থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তখন তাকে উদ্ধার করতে যায় তখন। এ সময় রাশেদের সঙ্গে তার বন্ধুরা ছিল। পুরো গল্পেই রাশেদ ও তার বন্ধুরা ছিল দুর্দান্ত। গল্পের শেষে রাশেদ রাজাকারদের হাতে ধরা পড়ে যায়। রাশেদের ব্যাগে পাওয়া যায় গ্রেনেড। রাজাকাররা যখন তাকে মেরে ফেলার জন্য হাত পা বেঁধে দাঁড় করায় তখন তার মধ্যে একটুও মৃত্যুভয় ছিল না। ছিল দেশের জন্য মমতা। এই দেশটাকে আর কোনোদিন দেখা হবে না বলে ছিল মন খারাপ করা অনুভূতি। যে অনুভূতি পাঠকের চোখ ভিজিয়ে দেয়। রাশেদের মতো সাহসী যোদ্ধারা কোনোদিন ভয় পায় না।