ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

নৌকাজীবন ॥ এক অসামান্য জীবনকথা

প্রকাশিত: ০০:৫১, ৩০ এপ্রিল ২০২১

নৌকাজীবন ॥ এক অসামান্য জীবনকথা

মানুষের একান্ত একটি জীবন থাকে, কিন্তু সে-জীবনকথা লিপিবদ্ধ করার তাগিদ বা প্রয়োজন নাও থাকতে পারে। সমাজের দশজনের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেবার মতো জীবনাভিজ্ঞতা না থাকলে সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। আবার যে-জীবন ধারণ করে ইতিহাসের উপকরণ, হয়ে ওঠে বিস্ময়কর সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী, সে-জীবনকথা আড়ালে থাকাটাও প্রত্যাশিত হতে পারে না। তার লিখন ও প্রকাশ প্রয়োজন দেশেরই স্বার্থে; কেননা কাল থেকে কালান্তরে মানুষ তা থেকে হতে পারে সঞ্জীবীত, উপকৃত। নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান নিগার সুলতানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, নিজে সঙ্গীতশিল্পী হয়েও সর্বদাই থেকেছেন প্রচারবিমুখতায়, পাদপ্রদীপের আড়ালে। নিজেকে বরং একজন জননী ও গৃহিণী হিসেবেই পরিচয় দিয়ে সুখী থেকেছেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর সমসাময়িক ও ঘনিষ্ঠ সহচর পিতার (রাজনীতিবিদ এ কে এম শামসুজ্জোহা) উচ্চশিক্ষিতা কন্যা হিসেবে বহু ঘটনার সাক্ষী নিগার সুলতানার মোহন দায়িত্ব যে রয়েছে পরোক্ষে রচিত হয়ে চলা ইতিহাসের অধ্যায়গুলো আলোয় নিয়ে আসার, সেটি তিনি পরিণত বয়সে এসে উপলব্ধি করলেন। মুক্তিযোদ্ধাকন্যা প্রকৌশলী রাসনার উপর্যুপরি তাগাদা, সরাসরি শ্রমদান নৌকা জীবনকে পাঠক সমীপে উপস্থিত করেছে। সেকথা লেখক কৃতজ্ঞচিত্তে উল্লেখও করেছেন। চিরসংগ্রামী ভাষাসৈনিক কবি নাগিনা জোহা লেখকের মা। আত্মজার ওপর জননীর প্রভাবটিও অপ্রকাশ্য থাকেনি, বরং বিশেষ অনুরাগ সগৌরবে প্রকাশিত। এ গ্রন্থের নেপথ্য প্রেরণাও ছিলেন তিনি। প্রচারবিমুখ দেশপ্রেমিক বাবার কাছ থেকে শোনা কথাগুলো এবং নিজস্ব পর্যবেক্ষণ মিশিয়ে তৈরি নোটগুলোর প্রথম পাঠক তো ছিলেন মা-ই। তাঁর বাবা-মায়ের বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন দুই স্বনামধন্য রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। জীবনকথার নাম নৌকাজীবন, কিছুটা বিস্ময়ই জাগায়। এ কী দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির নির্বাচনের প্রতীকের প্রতিই দৃকপাত? যেহেতু রাজনীতিক পরিবারের একজন তিনি। কিন্তু ভুল ভেঙে যায় এই কথাগুলো পড়ে। লিখেছেন: ‘হাসিনা এ ডটার্স টেল’ ফিল্ম দেখে, আর বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত জীবনী পড়ে আমার যে নতুন আত্মোপলব্ধি হয়েছে, সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে লেখাপড়া করে সংসার ধর্মকর্মে বিশেষজ্ঞ সেজে এ কী হলো আমার জীবন! কী নাম দেব এই জীবনের! অনেকটা না ভেবেই এই বইয়ের নাম দিলাম নৌকাজীবন, গোপালগঞ্জ আর নারায়ণগঞ্জের নৌকাযাত্রা।’ জীবন তো এক দীর্ঘ যাত্রারই নাম, যার থাকে যাত্রাপথের আনন্দ। কিন্তু সংগ্রাম, কষ্ট আর বিষাদে ভরা যদি হয় সেই যাত্রা? এ তো জীবনেরই অংশ, যেমন রয়েছে বর্ণাঢ্য উত্তরাধিকার। জীবনীলেখক নিগার সুলতানার দাদা খান সাহেব ওসমান ব্রিটিশ ভারতে সাপ্তাহিক সবুজ বাংলা প্রকাশ করতেন, যেখানে রবীন্দ্রনাথও লিখতেন। পত্রিকাটির প্রশংসা করে কবিগুরু চিঠিও পাঠিয়েছিলেন, যেটি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পর আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। মুসলিম সমাজের পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের লেখা নিয়ে অনেক তথ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। ‘নৌকা পরিবার’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে উল্লেখ রয়েছে। বঙ্গবন্ধু নদীপথে গোপালগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জ হয়ে নারায়ণগঞ্জে এসে মিটিং করতেন এই বাড়িতে এসে। আগেই উল্লিখিত হয়েছে নিগারের পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আমরা মুন্সীগঞ্জে নেমে মীর কাদিম হেঁটে আসলাম। সেখানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার একটু পূর্বে নৌকায় নারায়ণগঞ্জে রওয়ানা করলাম। সন্ধ্যার পরে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছে রিক্সা নিয়ে সোজা খান সাহেবের বাড়িতে পৌঁছালাম। জোহা সাহেব (নিগারের পিতা) খবর পায় নাই, তার ছোট ভাই মোস্তফা সরোয়ার তখন স্কুলের ছাত্র। আমাকে জানত। তাড়াতাড়ি জোহা সাহেবকে খবর দিয়ে আনল। আমরা ভিতরের রুমে বসে চা-নাশতা খেলাম। খান সাহেবের বাড়ি (নিগারে দাদাবাড়ি) ছিল আমাদের আস্তানা। ক্লান্ত হয়ে এখানে গেলেই যে কোন কর্মীর খাবার ও থাকার ব্যবস্থা হতো। ভদ্রলোকের ব্যবসা-বাণিজ্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু প্রাণটা ছিল অনেক বড়। জোহা সাহেব এসেই ট্যাক্সি ভাড়া করে আনল, আমাদের তুলে দিল।’ বাইতুল আমান ও হিরামহল নিয়ে দু’কথা না বললেই নয়। নিগার জানাচ্ছেন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত নারায়ণগঞ্জের এই বায়তুল আমান থেকেই (লেখকের দাদাবাড়ি)। এখানে রাজনৈতিক গোপন সভায় কে না আসতেন, সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধু, আতাউর রহমান পর্যন্ত। খান সাহেবের পুত্র জোহা সাহেব বিয়ে করলে কাছাকাছি হিরামহল নামে একটি বাড়ি বানিয়ে দিলেন পিতা। পরবর্তীকালে এই হিরামহলই হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল। গ্রন্থের বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো অধ্যায়গুলো হলো ‘বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে ওসমান পরিবার’, ‘নারায়ণগঞ্জের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা’, ‘৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্সে আমি’, ‘আমাদের আগরতলা যাত্রা ১৯৭১’, ‘১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ আব্বা ও মুজিব চাচি’, ‘ইন্দিরা গান্ধীর শাড়ি’, ‘কলেজস্মৃতি : খুকু আপা ও রোজি’, নাকফুল’ প্রভৃতি। জীবনী গ্রন্থের অপরিহার্য অংশ হলো আলোকচিত্রমালা, যা বিবরণী ছাড়াই সময়ের বয়ান। বাহাত্তরে হাজীগঞ্জ বোরখোল সংলগ্ন মাঠে বঙ্গবন্ধু, ইন্দিরা গান্ধী ও নিগারের পিতার ছবিটি সৌন্দর্যম-িত ঐতিহাসিক এক ছবি। আর বিষাদে মন ছেয়ে যায় পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের ঠিক আগের দিন নিগারের বড় ভাই নাসিম ওসমানের বিয়েতে শেখ কামালের হাস্যোজ্জ্বল ছবিটির দকে তাকালে। ওই একই বছরে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে শেখ ফজলুল হক মণি ও নিগারের পিতার প্রাণবন্ত ছবিটি দেখলেও অভিন্ন অনুভূতি হবে পাঠকের। ওসমান পরিবারের পারিবারিক আলোকচিত্রমালার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু পরিবারের ছবিগুলো অবলোকন করলে অনুধাবন করা যায় দুই পরিবারের মধ্যে প্রীতিময় সম্পর্কের স্বরূপ। নৌকাজীবন নামের এই অসাধারণ জীবনীটি একদিকে যেমন ধারণ করেছে এদেশের ইতিহাসের মহানায়কের আংশিক প্রতিকৃতিকে, তেমনি উপস্থাপিত হয়েছে স্বদেশের তাৎপর্যপূর্ণ সময়ের খণ্ড খণ্ড অসামান্য চিত্র; পাশাপাশি একটি নিবেদিতপ্রাণ পরিবারের ত্যাগ, নিবেদন ও একান্ত ঘরোয়া কথাও উঠে এসেছে সারল্যমাখা অথচ সুগভীর ব্যাঞ্জনাঋদ্ধ লেখনীতে। নিগার সুলতানা তাঁর মায়ের সাহিত্যকৃতির কিছু নিদর্শনও সংযুক্ত করেছেন বইয়ে, সেইসঙ্গে মায়ের লেখা ‘বঙ্গবন্ধু না জন্মালে দেশটা পেতাম না’ শীর্ষক মূল্যবান নিবন্ধটির সন্নিবেশনও প্রাসঙ্গিক ও মূল্যবান। মায়ের কবিতা পড়ে প্রণব মুখার্জির লেখা চিঠিটি গ্রন্থের মূল্যবান অংশ। পাঠকের হয়তো কিছুটা অতৃপ্তিই থেকে যাবে তাঁর পিতার স্মৃতিচারণ আরও ব্যাপক না হওয়ায়। তারপরও সব মিলিয়ে একথা আমার নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে, যিনি কখনোই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এমন একজন ব্যক্তির পক্ষে ইতিহাসসমৃদ্ধ অকপট বয়ানে চিরচেনা মানুষগুলোর ছবি আঁকায় ব্রতী হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জীবনীগ্রন্থ এভাবেই ভাবীকালের কাছে জমা রাখে যাপিত জীবনের নানা বাঁক ও সম্ভার। যার সৌরভ হয়তো কখনোই পাওয়া সম্ভব হতো না সাহস ও শক্তি নিয়ে জীবনীকার উদ্যোগী না হলে। সে কারণে অবশ্যই তিনি সাধুবাদযোগ্য। নৌকাজীবন গ্রন্থটির প্রকাশক ইঞ্জিনিয়ার রাসনা (ইজি- ফিল্ম অ্যান্ড পাবলিকেশন্স), প্রচ্ছদচিত্র অনিমা চলন পপীপের। বইটির পরিবেশক বাংলাবাজারের ঢাকা টাউন লাইব্রেরি। কাঁটাবন কনকর্ডের ‘প্রকৃতি’ বইঘর বইটির আরেকটি প্রাপ্তিস্থান।
×