ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১

হুমায়ুন আজাদের কিশোর কবিতা

প্রকাশিত: ০০:৫০, ৩০ এপ্রিল ২০২১

হুমায়ুন আজাদের কিশোর কবিতা

হুমায়ুন আজাদ- এক বহুমুখী প্রতিভার নাম। নানা বিশেষণে তাকে বিশেষায়িত করা হয়। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করেছেন। কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, কিশোর সাহিত্য- তিনি রচনা করেছেন। ছিলেন ভাষাবিজ্ঞানী। কলামও লিখেছিলেন এক সময়। তিনি লিখেছেন প্রথার বিরুদ্ধে। তাঁর অভীষ্ট ছিল সৌন্দর্য সৃষ্টি করা। জীবিতাবস্থায় তিনি ছিলেন আলোচিত, তুমুল সমালোচিত। সেই আলোচনা, সমালোচনা এখনও বহমান। সেটা থাকবেই। কেননা, সাহিত্যে তিনি যেমন সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, তেমনি নাড়া দিতে চেয়েছেন চিন্তার কূপম-ূকতাকে। আক্রমণ করতে চেয়েছেন সমাজের বুকে যেসব চিন্তা-চেতনা জগদ্দলের মতো চেপে বসে আছে- তাকে। স্বভাবতই যারা ব্যক্তি সুবিধা হাসিলের জন্য সমাজের অগ্রগতিকে রোধ করতে চায়, তাদের চোখের কাঁটা ছিলেন হুমায়ূন আজাদ। যাক, সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। হুমায়ুন আজাদের প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়, তাঁর কিশোর সাহিত্যে নিয়ে ততটা আলোচনা হয় না। যদিও তাঁর কিশোর সাহিত্যের পরিমাণ যৎসামান্য। মোট আটটি বই তিনি লিখেছেন কিশোরদের উদ্দেশ করে। তার মধ্যে তিনটি উপন্যাস; একটি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস; একটি বাংলা ভাষার ইতিহাস; একটি প্রবন্ধ-গল্প-কবিতার মিশ্র সঙ্কলন, একটি কিশোর কবিতার বই এবং আরেকটি ইংরেজিতে লেখা বাংলাদেশের পচিতিমূলক বই। তবুও তা দিয়ে হুমায়ুন আজাদকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। বইয়ের সংখ্যা বা লেখার পরিমাপ দিয়ে যে একজন সাহিত্যিকে বিচার করা যায় না, তাকে বিচার করতে হয় রচনা উৎকর্ষ দিয়ে- তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হুমায়ুন আজাদের কিশোর সাহিত্যে। হুমায়ুন আজাদ দেশকে কতটা ভালবাসতেন, দেশের নৈসর্গিক সৌন্দর্য তাকে কতটা মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সৌন্দর্য অন্বেষণে তিনি যে মৃগহরিণের মতো ছুটতেন, তারই শিল্পসম্মত ভাষ্য তাঁর কিশোর কবিতা। যদিও তাঁর কিশোর কবিতার সংখ্যা খুবই কম। মাত্র পঁচিশটি। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত ‘বুক পকেটে জোনাকিপোকা’ বইতে প্রবন্ধ ও গল্পের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে মাত্র সাতটি কবিতা। এ ছাড়া তাঁর একমাত্র কিশোর কবিতার বই ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’ বইতে ছিল আঠারোটি কবিতা। ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৩ সালে। ‘বুক পকেটে জোনাকিপোকা’ বইয়ে প্রবন্ধ এবং গল্পের সঙ্গে যে সাতটি কিশোর কবিতা রয়েছে, তার প্রথমটি হলো ‘কখনো আমি’। কবিতাটিতে স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে। তিনি লিখেছেন- ‘কখনো আমি স্বপ্ন দেখি যদি স্বপ্ন দেখব একটি বিশাল নদী।’ একটি বিশাল নদী দেখার কারণ, কবি চান যেন একজন কিশোর বা কিশোরী নিজের মধ্যে বিশালতাকে ধারণ করুক। হয়ে উঠুক নিসর্গের মতো সুন্দর। প্রথম স্তবকের শেষ দুই লাইন তারই সাক্ষ্যবাহী- ‘আকাশ ছুঁয়ে উঠছে কেবল ঢেউ আমি ছাড়া চারদিকে নেই কেউ।’ দ্বিতীয় স্তবকে পাই এক সুদূরপ্রেমী কিশোরকে। যে কিশোর কাউকে যদি ডাকে, একটি সুদূর কোমল পাখিকেই ডাকবে। সেই পাখির ডানায় বনের ছবি আঁকা, চোখে ভোরের রবি জ¦লে। অর্থাৎ পাখি অজানাকে জানাবে, নিয়ে আসবে নতুন দিন পৃথিবী জুড়ে। কেমন হবে সেই সুন্দর পৃথিবী? কবি লিখেছেন- ‘আকাশ কাঁপে পাখির গলার সুরে। বৃষ্টি নামে সব পৃথিবী জুড়ে।’ স্বরবৃত্তে ছন্দে লেখা এই কবিতায় হুমায়ুন আজাদ দারুণভাবে কিশোর মনের কল্পনা এবং ইচ্ছাকে অর্থাৎ কিশোরমনস্তত্ত্বকে তুলে ধরেছেন। কিংবা অন্যভাবে বলা যায়, কিশোর মনের সুপ্তস্বপ্নকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন; দেখাতে চেয়েছেন বিশালত্ব অর্জন করার স্বপ্ন; অজানাকে জয় করার স্বপ্ন; পৃথিবীকে সুন্দর করে গড়ে তোলার স্বপ্ন। প্রসঙ্গত কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাত ভাই চম্পা’ কবিতার প্রথম ভাইয়ের ইচ্ছের কথা মনে পড়ে। প্রথম ভাই ‘সকাল বেলার পাখি হতে চেয়েছিল।’ যদিও কবিতাটি আমাদের কাছে ‘খোকার সাধ’ নামে পরিচিত। ‘বুক পকেটে জোনাকিপোকা’র দ্বিতীয় কবিতার শিরোনাম ‘শুভেচ্ছা’। এই কবিতাটি হুমায়ুন আজাদের বহুল পঠিত, বহুল পরিচিত একটি কিশোর কবিতা। যা মানচিত্রের সীমানা অতিক্রম করে ওপার বাংলার বাচিকশিল্পীদের কণ্ঠেও পৌঁছে গেছে। কবিতাটি পাঠ করলে মনে হয়, গ্রামের কিশোর তার পরিচিত গ্রাম ছেড়ে, প্রকৃতি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। তাই তার প্রিয় সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে বলছে, ভাল থাকার জন্য। ফুল, বুকল, আকাশের মেঘ, তারা, চর, ছোট কুঁড়ে ঘর, চিল, রাখালের বাঁশি, কুমড়, ঘাস, রোদ, মাঘের কোকিল, বক, আড়িয়ল বিল অর্থাৎ তার দৈনন্দিন জীবন যাদের সঙ্গে কেটেছে, তাদের সবার জন্য সে শুভ কামনা রেখে যাচ্ছে। ছয়মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে লেখা এই কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে জড়িয়ে আছে বিষাদ, আশ্চর্য মায়া। এ বিষাদ গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নাগরিক হয়ে ওঠার বিষাদ। শুধু তাই নয়, যখন পাঠ করি- ‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো। ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো। ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা ভালো থেকো পাখি, সবুজ পাতারা ভালো থেকো চর, ছোটো কুঁড়েঘর, ভালো থেকো। ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।’ তখন বুকের মধ্যে কেমন এক স্মৃতিকাতরতা জেগে ওঠে। কবিতাটির গঠনশৈলী, ছন্দের ব্যবহারেও হুমায়ুন আজাদ মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। কবিতাটি যদি আমরা চারলাইন চারলাইন করে এর নির্মাণ প্রকৌশল লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব, প্রথম এবং দ্বিতীয় লাইনে রয়েছে মধ্যানুপ্রাস। প্রথম লাইনের সঙ্গে দ্বিতীয় লাইনের অন্ত্যানুপ্রাস বা অন্ত্যমিল। তৃতীয় এবং চতুর্থ লাইনে কোন মধ্যানুপ্রাস ব্যবহৃত হয়নি কিন্তু তৃতীয় লাইনের সঙ্গে চতুর্থ লাইনের অন্ত্যমিল রয়েছে। পর্ববিন্যাসেও রয়েছে বৈচিত্র্য। প্রথম ও দ্বিতীয় লাইনে ছয়মাত্রার দুটি পূর্ণপর্ব এবং চারমাত্রার অপূর্ণ পর্ব। তৃতীয় চতুর্থ লাইনে কোন অপূর্ণ পর্ব নেই। ছয়মাত্রার দুটো পূর্ণপর্ব রয়েছে। কবিতার শেষ লাইনে পাই চারমাত্রার তিনটি পর্ব। শেষ লাইনে চারমাত্রার পর্ব হওয়ায় একটি হাহাকারের ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে, বিদায়ের বিধুরতা তৈরি হয়েছে । প্রতি লাইনে ছয়, ছয়, চার বা ছয়, ছয় মাত্রা পড়তে পড়তে যখন শেষ লাইনে শুধু চার মাত্রার পর্ব পাই মনে হয় এতক্ষণ যে চার পাশের জিনিসকে শুভ কামনা জানাচ্ছিল, সে এখন অনেক দূরে চলে গেছে, শুধু দূর থেকে ভেসে আসছে তার ‘ভালো থেকো’ শুভ কামনাময় কথাগুচ্ছ অথবা বলা যায়, সে চলে গেলেও প্রকৃতির প্রতি তার যে ভালবাসা, সেটি এখনও ধ্বনিত, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাক্য গঠনের ক্ষেত্রেও আমরা বিশেষ একটি ঢং লক্ষ্য করি। প্রথম লাইন একটি বাক্য, দ্বিতীয় লাইন একটি বাক্য। কিন্তু তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম লাইন মিলে তৈরি হয়েছে একটি বাক্য। তারপর ষষ্ঠ লাইন একটি বাক্য। তারপর সপ্তম, অষ্টম, এবং নবম লাইন মিলিয়ে একটি বাক্য। এভাবে আবার এক লাইনের একটি বাক্য এবং তারপরে তিনটি লাইন মিলিয়ে একটি বাক্য তৈরি করেছেন। এভাবে সতেরোতম লাইন পর্যন্ত বিন্যস্ত হয়েছে। আঠারো এবং উনিশতম লাইন দুটো বাক্য। বলা চলে শব্দলঙ্কার, ছন্দের ব্যবহার করে কবিতার অবয়বে যেমন শৈল্পিকতা দান করেছেন, তেমনি অর্থালঙ্কারের ব্যবহারে কবিতাটি হয়ে উঠেছে দ্যুতিময়। তৃতীয় কবিতা ‘স্বপ্ন’ স্বরবৃত্ত ছন্দে লেখা ত্রিপদী। এই কবিতাতেও কিশোর মনের স্বপ্নকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তবে আমরা ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখি, কবি তাকে স্বপ্ন বলতে নারাজ। পৃথিবীকে সুন্দর করতে, স্বপ্নকে রক্ষা করার জন্য জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার কথাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘অন্য সবাই ঘুমিয়ে প’ড়ে স্বপ্ন দ্যাখে ঘুমের ঘোরে মাথা রেখে মেঘে, কেবল আমি একলা আমি সকাল সন্ধ্যা দিবসযামি স্বপ্ন দেখি জেগে।’ ‘ধুয়ে দিলো মৌলির জামাটা’ কবিতায় আষাঢ় মাসের আকাশকে মৌলির জামার সাথে তুলনা করেছেন। মৌলি যেমন সারাদিন খেলা করার ফলে নীলজামাটা ময়লা জমে কালো হয়ে গেছে, তেমনি নীল আকাশও ময়লা জমে কালো হয়ে গেছে, তার লাল সূর্যটাকে দেখা যায় না। বৃষ্টি হওয়ার পর যেমন আকাশ আবার পূর্বের সেই নীল রং খুঁজে পায়, তেমনি মৌলির জামা ধুয়ে দিলেও সেই নীল ফিরে আসে। কবিতায় আষাঢ় মাসের আকাশের সাথে মৌলির জামা একাকার হয়ে উঠেছে কবির লেখনীর মাধ্যমে। ‘ফাগুন মাস’ কবিতায় উঠে এসেছে বসন্তে প্রকৃতির উন্মাতাল রূপ এবং মহান একুশের ঘটনার কথা। শুধু তাই নয়, এই ফাগুন মাস এলেই মনে হয় মাতৃভাষার জন্য হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের কথা, মনে হয়, আবার না জানি তারা কোন দায়বদ্ধতা পালন করতে গিয়ে কোথাও হারিয়ে যায়। তাই কবিতার শেষ দুই লাইনে পাই- ‘বুকের ভেতর ফাগুন পোষে ভয়- তার খোকাদের আবার কী যে হয়!’ ‘দোকানি’ কবিতায় হুমায়ুন আজাদ অদ্ভুত সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন স্বপ্নের জগত। যেখানে দোকানদার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করেন না। বিক্রি করেন চাঁদের আলো, রোদের ঘ্রাণ প্রভৃতি। শিশু-কিশোরদের যে রূপকথার জগত, সে জগত তিনি এই কবিতায় তৈরি করেছেন। সেই সাথে কবিতার জগত কেমন হবে তারই সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দিয়েছেন এখানে। কবিতার জগত আর বাস্তব জগত যে এক নয়, আলাদা- তাই ফুটে উঠেছে এখানে। ‘ইঁদুরের লেজ’ একটি নকশা জাতীয় কবিতা। অর্থাৎ হুমায়ুন আজাদ পঙ্ক্তি, শব্দ এমন ভাবে ভেঙ্গে বিন্যস্ত করেছেন যার ফলে পুরো কবিতার অবয়বে একটি ইঁদুরের লেজের ছবি ফুটে উঠেছে। কবিতায় স্বরবৃত্ত ছন্দের নিখুঁত ব্যবহারের ফলে পড়তে কোন সমস্যা হয় না। ছন্দের স্রোতেই পর্বের পর পর্ব ঠিকঠাক মতো অতিক্রম করে নিয়ে যায়। তা ছাড়া অন্ত্যমিল, অন্তর্মিল, মধ্যমিলের কারণে কবিতাটি হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য একই সাথে শ্রুতিমধুর। ‘বুক পকেটে জোনাকিপোকা’ শেষ কবিতা ‘স্বপ্নের ভুবন’। একটি দীর্ঘ কবিতা। পূর্বোক্ত কবিতায় স্বপ্ন এসেছে ভবিষ্যতকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ আগামী সময়ের চাওয়া পাওয়াগুলো সেখানে ফুটে উঠেছে। কিন্তু এ কবিতায় কবির স্বপ্নের ভুবন হলো অতীত। তাঁর বাল্যকাল। যে বাল্যকালকে তিনি ভুলতে পারেন না, ভুলতে পারে না ফেলে আসা দিনকে। মূলত কোনো বিবেকবান মানুষই তার অতীতকে কখনো ভুলে যেতে পারে না। সবার জীবনেই বাল্যকাল এক স্বর্ণযুগ। শৈশব- কৈশোরের স্মৃতিচারণ মনের ঘরে অন্যরকম এক আবেশ ছড়ায়। এ কবিতায় তিনি অতীতের, বাল্যকালের স্মৃতিচারণ করেছেন। বর্তমানকে ভুলে থাকার জন্য তিনি স্মৃতিচারণ করেন, বাল্যকালে তথা তাঁর স্বপ্নের ভুবনে ডুবে যান। কবি লিখেছেন- ‘প্রতিদিন সকলকে ফাঁকি দিয়ে আমি মনে মনে গোপনে হারিয়ে যাই বাল্যকালে, স্বপ্নের ভুবনে।’ ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’ বইয়ে মোট আঠারোটি ছোট ছোট কবিতা রয়েছে। এখানেও তাঁর স্বপ্ন, স্মৃতি, ফেলে আসা গ্রাম কবিতার উপজীব্য হয়ে উঠেছে। বইটির শুরু কবিতা ‘তোমরা যারা’। একটি অসম্পূর্ণ বাক্য নিয়ে এ কবিতা। এ কবিতায় ‘তোমরা যারা’ বকুল তলায় যায়, বিনিসুতোয় মালা গাঁথে, নদীর পারে কাশের বনে হাঁটে, মেঘের সাথে যাদের মন ওড়ে, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে তারা কী?- এই কথাটি অনুক্ত রেখেছেন কবি। হয়তো কবির বাসনা এই বইটি সেইসব কিশোরের জন্য যারা প্রকৃতির একান্ত আপন, স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে ব্যাকরণের পুস্তকের তলায় যাদের চিন্তা এখনো শৃঙ্খলায়িত হয়নি। এই বইয়ে কবি স্বপ্নকে কোনো সীমানায় আবদ্ধ করেননি। ইচ্ছে মতো বাড়তে দিয়েছেন, উড়তে দিয়েছেন। যেমন বইয়ের নাম কবিতা ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’ কবিতায় লিখেছেন- ‘পুব আকাশে আজ অন্ধকারে রয়েছে ফুটে একটি গন্ধরাজ।’ আমরা জানি সন্ধ্যার আকাশে গন্ধরাজ ফোটে না। এখানে কবি চাঁদকে গন্ধরাজ ফুলের সাথে তুলনা করেছেন। কিন্তু বাক্যে উপমান অর্থাৎ চাঁদকে মুছে দেয়ার ফলে উপমাটি একটি চমৎকার চিত্রকল্পে পরিণত হয়েছে এবং এটি কোন কষ্টার্জিত চিত্রকল্প নয়, সহজেই চিত্রকল্পের সৌন্দর্য মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ‘কোন সে পাখি’ কবিতায় মনকে ভাসিয়ে দিয়েছেন অজানা সৌন্দর্যে গহীন সাগরে। তিনি লিখেছেন- ‘কোন সে পাখি ডাকে কোন সে গাছের ফাঁকে? তাকে আমি দেখতে পাই না তাকে আমি দেখতে চাই না তবু সে আমার বুকটি ভ’রে রাখে।’ এখানে অচেনা পাখি, অচেনা গাছে ডাকলেও সেই পাখির ডাকে কবির মন ভরে ওঠে। এ জন্য তাকে দেখতে হয় না। চিনতে হয় না। ‘বই’ কবিতায় তিনি বইকে অভিহিত করেছেন স্বপ্নের বাহন হিসেবে। বই মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। অন্ধাকারে আলো জ¦ালে। বই নিয়ে আসতে পারে নতুন দিন। বই মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। তাই বলেছেন- ‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ¦লে, বইয়ের পাতা স্বপ্ন বলে। যে-বই জুড়ে সূর্য ওঠে পাতায় পাতায় গোলাপ ফোটে সে বই তুমি পড়বে।’ তবে কিছু কিছু বই আছে যা মানুষকে ভুল পথে ধাবিত করে। চিন্তা-চেতনার অগ্রসরতার পক্ষে বাধা সৃষ্টি করে, তিনি সেই বই পড়তে নিষেধ করেছেন। বলেছেন- ‘যে-বই তোমাকে অন্ধ করে যে-বই তোমাকে বন্ধ করে সে-বই তুমি ধরবে না।’ মানুষ প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতির কোলে তার বেড়ে ওঠা, বিকাশিত হওয়া। প্রকৃতি যদি কোন কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূলত সেই ক্ষতির স্বীকার হয় মানুষই। প্রকৃতির অনিষ্ট করে মানুষ ভাল থাকতে পারে না। ভাল থাকা সম্ভব নয়। প্রকৃতির পরিবর্তনে বালক মন তাই হাহাকার করে ওঠে। বলে ওঠে- ‘বকুল তুমি ভালো নেই? মুকুল তুমি ভালো নেই? মৌমাছিরা ভালো নেই? এটা কেমন দিন এলো। (বকুল তুমি) এই বইয়ের প্রতিটি পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে উঠে এসেছে ঘাসের কথা, হিজলের কথা, পাখ-পাখালির কথা, বিল, পদ্ম, নদী তথা প্রকৃতির কথা, নিসর্গের কথা। বাংলার নিসর্গ বাক্সময় হয়ে উঠেছে বইয়ের প্রতিটি কবিতায়। বাংলার সৌন্দর্যের আধার তার প্রকৃতি। গ্রাম বাংলার সৌন্দর্যের লীলাভূমি, সরলতার প্রতিমা। ষড়ঋতুর মনোমুগ্ধকর চিত্র শুধু গ্রামেই দেখা সম্ভব, গ্রামেই যথার্থ অনুধাবন করা সম্ভব ঘুঘুর ডাকের মাধুর্য, বৈশাখের ঝড়ের সৌন্দর্য, ভাটিয়ালি গানের মূর্ছনাকে। তাই হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন- ‘গ্রামের শেষে সবুজ বিল দুপুরে ওড়ে শঙ্খচিল পুব পুকুরে জলের তলে শরপুঁটিদের প্রদীপ জ¦লে কদম দেখবে বর্ষাকালে তাহলে যেয়ো রাড়িখালে। কোথায় তুমি যেতে চাও? রাড়িখাল না কামারগাঁও?’ রাড়িখাল বা কামারগাঁও এখানে সমস্ত বাংলার গ্রামের প্রতিভূ। পূর্বেই বলা হয়েছে, গ্রামের সৌন্দর্য মানেই বাংলা সৌন্দর্য। বাংলা নিসর্গকে শহরে পাওয়া যাবে না। বাংলা মায়ের অপরূপ রূপটি দেখতে হলে গ্রামেই যেতে হবে। শহরে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েও হুমায়ুন আজাদ সে কথা ভুলে যাননি। তাই তাঁর কবিতা, উপন্যাসে এমনকি কিশোর কবিতা বা কিশোর সাহিত্যে বারবার গ্রামবাংলার ছবি এঁকেছেন, বার বার চিত্রায়িত করেছেন তাঁর জন্মভূমি রাড়িখালকে। মন এবং মননে সাহায্যে হুমায়ুন আজাদ তাঁর কিশোর কবিতায় সে সৌন্দর্য নির্মাণ করেছেন, যে স্বপ্ন নির্মাণ করেছেন, গ্রামের যে সৌন্দর্য বিনির্মাণ করেছেন, তা মন না ছুঁয়ে পারে না।
×