ক্রমেই করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। প্রতিদিনই হুহু করে বাড়ছে নতুন রোগীর সংখ্যা। এরই মধ্যে আক্রান্তের হিসাবে অন্যান্য জেলাকে ছাড়িয়ে শীর্ষে অবস্থান করছে ঢাকা। শুধুমাত্র একদিনে আক্রান্ত ৭ হাজারের বেশি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, মে মাসে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমরা। যদি আমরা এখনই সবকিছু বন্ধ করে দিতে না পারি তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে বলে মতামত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। লকডাউন সফল করতে সরকার কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। আমাদের দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। দিন যত গড়াচ্ছে, সারাদেশের সব জেলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ভাইরাসটি। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন হাজার হাজার করোনা রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। হাসপাতালগুলোতে বিপুলসংখ্যক করোনা রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সরা।। স্বাস্থ্য সরঞ্জামের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
জনগণকে সচেতন করতে সবধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এলাকায় এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। এদিকে মুভমেন্ট পাস ছাড়া চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অনেকে তা মেনে চলছেন না। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে এমন তথ্য ছড়াচ্ছেন, যা বিভ্রান্তিকর। দেশব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধের অংশ হিসেবে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে অনেকক্ষেত্রে। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেক দায়িত্বশীল নাগরিকও আইন মেনে চলছেন না। পুলিশ বা ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনে বাধা দিচ্ছেন। অনেকক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাকবিত-ায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। বাজারে মানুষের উপচেপড়া ভিড় এবং সেখানে সামাজিক দূরত্বের কোন বালাই নেই। অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। সরকারী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকান খুলে ব্যবসা করছে অনেক ব্যবসায়ী। ক্রেতা-বিক্রেতা কারও মুখে মাস্ক নেই। রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে আগের মতোই ভিড় এবং আড্ডা চলছে।
সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮ অনুযায়ী কেউ ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে বাধা দিলে বা নির্দেশ পালনে অসম্মতি জানালে তাকে ৩ মাস কারাদন্ড, অনুর্ধ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেয়া যাবে। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮-এর শাস্তিমূলক ধারা রয়েছে। আইনের ধারা-২৫-এ বলা হয়েছে, দায়িত্ব পালনে বাধা ও নির্দেশ পালনে অসম্মতি জানালে অপরাধ হবে। ২৫-এর (১) অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি ক. মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে বাধা দেন বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, এবং খ. সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূলের উদ্দেশ্যে মহাপরিচালক, সিভিল সার্জন বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশ পালনে অসম্মতি জানান, তবে ওই ব্যক্তির অনুরূপ কাজ দন্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইনের ধারা ২৫ এর (২) অনুযায়ী যদি কোন ব্যক্তি (এই ধারার) উপধারা (১)-এর অধীন অপরাধ করেন, তবে তিনি অনুর্ধ ৩ (তিন) মাস কারাদন্ডে, বা অনুর্ধ ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদন্ডে, বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। ধারা-২৬ : মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেয়ার অপরাধ ও দন্ড ১. যদি কোন ব্যক্তি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা থাকার পরও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেন, তাহলে ওই ব্যক্তির অনুরূপ কাজ অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
বর্তমানে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮ এর বিভিন্ন ধারা, উপধারায় বর্ণিত আইনগুলো প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। বিশ্বের আক্রান্ত প্রায় সব দেশ এখন করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে পুরো দেশ লকডাউন করে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন মেয়াদে এই লকডাউন বর্ধিত করা হচ্ছে এবং লকডাউন সফল করতে আইনের প্রয়োগ করা হচ্ছে। নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রতি অনেক দায়িত্বের মধ্যে একটি অন্যতম দায়িত্ব হচ্ছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং আইন মেনে চলা। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে প্রতিটি নাগরিকের সহযোগিতা ও সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সকল নাগরিকের উচিত আইনগুলো মেনে চলা এবং সেই সঙ্গে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করা। পরিচয়পত্র, মুভমেন্ট পাস ইত্যাদি চাওয়া মাত্র প্রদর্শন করা। মাস্ক পরিধান করা এবং সব ধরনের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা।
লেখক : সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী এবং সহকারী পরিচালক ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট