ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

হাওড়ের দুর্যোগ ‘হিট শক’

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ১৩ এপ্রিল ২০২১

হাওড়ের দুর্যোগ ‘হিট শক’

আমি হাওড়ের মানুষ। তাই হাওড়াঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে আমার পরিচিতি আশৈশবকাল থেকে। দীর্ঘ ২৬ বছরের সাংবাদিক জীবনে হাওড়ের বন্যা, আগাম বন্যা, টর্নেডো, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি দুর্যোগ নিয়ে রিপোর্ট করেছি পত্রিকায়। কিন্তু গত কয়েকদিন আগে ‘হিট শক’ এর যে রিপোর্ট করেছি- তা এর আগে কখনও করতে হয়নি। এটি হাওড়ের এক নতুন দুর্যোগ। হাওড়ের চাষীরা এ ধরনের দুর্যোগ আগে কখনও দেখেননি। যদিও বিষয়টি পত্র-পত্রিকায় ফলাও খুব কমই হয়েছে। গত ৪ এপ্রিল রাতে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চলের বোরো ফসল হিট শকে আক্রান্ত হয়। সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হাওড়ের বিভিন্ন এলাকায় এক ধরনের তপ্ত হাওয়া বয়ে যায়। তবে ওই রাতে চাষীরা কোন ক্ষয়ক্ষতি টের পাননি। পরদিন রোদ ওঠার পর তারা জমিতে গিয়ে দেখেন, যেসব জমির বোরো ধান গাছে সবেমাত্র ফুল বের হচ্ছিল (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) অথবা চালে রূপান্তরিত হচ্ছিল (মিল্কিং স্টেজ) সেসব ধানগাছের শীষ ক্রমশ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গাছের কচিপাতাগুলো মরে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ধান চিটায় পরিণত হচ্ছে। দু’দিনের রোদের পর বিষয়টি আরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সবুজ হাওড়গুলো ক্রমশ সাদা অথবা ধূসর রঙের হাওড়ে পরিণত হয়। সঙ্গত কারণেই এক ধরনের হাহাকার পড়ে যায় হাওড় এলাকা জুড়ে। সরেজমিনে ঘুরে দেখেছি, কোন কোন জমির ধানগাছে এখন আর ধান বলতে কিছু নেই। শুধু চিটা আর চিটা। এতদিনে যে গাছগুলো ধানের ভারে মাথা নুয়ে থাকার কথা ছিল সেগুলো এখন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোন কোন জমিতে ধান কাটার জন্য আর কাঁচিই ধরতে হবে না চাষীদের। পরদিন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধি দল ক্ষতিগ্রস্ত হাওড়াঞ্চল পরিদর্শন করে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের নিশ্চিত করেছেন, এটি ‘হিট শক’। দীর্ঘক্ষণ তপ্ত বাতাস প্রবাহের কারণেই এমনটি ঘটেছে। তবে যেসব ধান ইতোমধ্যে চালে পরিণত হয়েছে সেগুলোর খুব একটা ক্ষতি হয়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্রি-ধান ২৯ ও হাইব্রীড জাতের। কারণ, এ ধানগুলো একটু দেরিতে ফলে। কিন্তু উৎপাদন বেশি হওয়ার কারণে হাওড়ের বেশিরভাগ চাষী এ জাতগুলোই বেশি আবাদ করেন। কৃষি বিভাগের হিসাবে নেত্রকোনার খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ, কেন্দুয়া, আটপাড়া, বারহাট্টা ও দুর্গাপুর- এ সাত উপজেলার অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমি হিট শকে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জে আক্রান্ত হয়েছে আরও ২৬ হাজার হেক্টর জমি। বিপুল এই জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শুধু নেত্রকোনাতেই অন্তত ৮৬ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন ধান কম উৎপাদন হবে এবার। যার প্রভাব পড়বে জেলার বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার ওপর। শুধু তাই না, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে হাওড়ের হাজার হাজার বোরো চাষীর সাংসারিক জীবনেও। কারণ, হাওড়াঞ্চল মূলত একফসলি এলাকা। বোরো ছাড়া আর কোন ফসল হয় না সেখানে। তাই হাওড়ের চাষীদের জীবন-জীবিকা, ভরণপোষণ, সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা, যুবতী মেয়ের বিয়ে- সব কিছু নির্ভর করে একমাত্র এ ফসলের ওপর। এমন পরিস্থিতিতে এই হিট শকের কারণ খোঁজা এখন জরুরী। আমরা জানি, হাওড়েও জলবায়ু পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। হাওড়ের নদী-নালা, বিল-ঝিল দিন দিন ভরাট হয়ে যাচ্ছে। কমে গেছে হাওড়ের পরিবেশবান্ধব গাছপালাও। ঘটে যাওয়া হিট শক এসবের বিরূপ প্রভাব কি-না তা গবেষণা করে দেখা প্রয়োজন। কেননা, ভবিষ্যতেও এ ধরনের দুর্যোগ হতে পারে। তাই এ ব্যাপারে চাষীদের আগাম সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের করণীয় সম্পর্কেও দিকনির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এর পাশাপাশি আরেকটি বড় প্রয়োজন হচ্ছে- ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের পুনর্বাসন করা। ঠিকমতো পুনর্বাসন করা না গেলে এই বিপুল পরিমাণ ক্ষতিগ্রস্ত চাষী সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না। বেড়ে যাবে দারিদ্র্য। কারণ, কৃষিই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস। অন্যদিকে হাওড়ের চাষীরা সাধারণত ধার-দেনা করে জমি আবাদ করেন। ফসল ঘরে তোলার পর তারা দেনা শোধ করেন। এবার অনেকের দেনা শোধ করা অসম্ভব হয়ে যাবে। আমরা জানি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হাওড়ের চাষীদের নিত্যসঙ্গী। প্রায়বছর সেখানে আগাম বন্যা, খরা ও শিলাবৃষ্টি হয়। একবার ফসল মার গেলে সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের কয়েক বছর লেগে যায়। সর্বশেষ ২০১৭ সালের আগাম বন্যা হাওড়ের বোরো চাষীদের মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়। প্রায় শতভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যায় তখন। সে ধকলই এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি অনেক চাষী। এর ওপর এই ‘হিট শক’ নামক নতুন দুর্যোগ তাদের আরেকবার যেন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরেজমিনে হাওড়াঞ্চল পরিদর্শনকালে দেখেছি এবং জেনেছি, বিষয়টি ভয়াবহ চিন্তার উদ্রেক করেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ মানুষদের। ভবিষ্যত নিয়ে এক ধরনের দুর্ভাবনায় পড়ে গেছেন তারা। আবার ২০১৭ সালের মতো এবারও সরকার পাশে দাঁড়াবে- এমন আশায় বুকও বাঁধছেন অনেকে। তারা জানিয়েছেন, ২০১৭ সালের আগাম বন্যায় ফসলহানির পর সরকার কৃষক পরিবারগুলোকে ১০ টাকা কেজি চাল, আর্থিক প্রণোদনা, বিনামূল্যে বীজ ও সারসহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। এবারও তেমনটি আশা করছেন তারা। স্থানীয় মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, এমপি এবং প্রশাসনের কর্তারাও অবশ্য ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় গিয়ে এসব ব্যাপারে আশ্বস্ত করছেন চাষীদের। নিঃসন্দেহে এটি আশার দিক। হাওড়ের বাসিন্দা এবং গণমাধ্যকর্মী হিসেবে আমি নিজেও মনে করি, এই ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের সরকারীভাবে পর্যাপ্ত সহযোগিতা দেয়া প্রয়োজন। প্রয়োজন তাদের কাছে গিয়ে মানসিক সাহস জোগানো। কারণ, তারাই আমাদের খাদ্যের জোগানদাতা। দেশের এক পঞ্চমাংস ধান উৎপাদিত হয় হাওড়ের এই চাষীদের হাত দিয়ে। কাজেই দেশের প্রতি তাদের অবদান অনেক। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, হিট শকে ক্ষতিগ্রস্ত চাষীদের সংখ্যা খুব বড় নয়। এদের পাশে দাঁড়ানোর মতো সক্ষমতা আমাদের সরকারের আছে। আশা করি, চাষীদের এই ফরিয়াদ নিশ্চয়ই সরকারের কান পর্যন্ত পৌঁছবে। লেখক : সাংবাদিক [email protected]
×