ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

জান্নাতুন নিসা

বইমেলার বিচ্ছিন্ন ভাবনা

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ৪ এপ্রিল ২০২১

বইমেলার বিচ্ছিন্ন ভাবনা

বাঙালী জাতি সংস্কৃতির পূর্ণচ্ছটায় পৃথিবীর বুকে সমুজ্জ্বল হয়েছে নিজেদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে। আমাদের যত আন্দোলন, সংগ্রাম, ইতিহাস, ঐতিহ্য তা সৃষ্টি হয়েছে কেবলই সাংস্কৃতিক জাগরণের মধ্য দিয়ে। বায়ান্ন থেকে একাত্তর আমাদের জীবনের প্রতিটি দিনে, পক্ষে, মাসে ফিরে ফিরে আসে। আমাদের যেমন রয়েছে বিজয়ের মাস, তেমনি রয়েছে শোকের মাস। আর স্বাধীনতার মাস পেরোনোর আগেই ফাগুনছোঁয়া আগুনে পাই ভাষার মাস। যে মাসকে কেন্দ্র করে আয়োজিত হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। বইমেলা সাংস্কৃতিক জাগরণে অনন্য ভূমিকা রাখছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষার প্রতি আবেগ এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ হয়ে অমর একুশে বইমেলা রূপ নিয়েছে বাঙালীর প্রাণের মেলায়, সর্বজনীন মহোৎসবে। বইমেলা তো কেবল মেলা নয়, বাঙালীর আবেগ জড়ানো এক আলোকিত আহ্বান। যে আহ্বানে বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী প্রতিটি মানুষ আন্দোলিত হয়, উদ্বুদ্ধ হয়, নবোদ্যমে ভাষার প্রতি ভালবাসায় নিজেকে সিক্ত করে নেয়। ২০২১ মানে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণ। এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা পেয়েছি আমাদের আকাক্সিক্ষত মুজিববর্ষ। ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিটি বাঙালীর আনন্দোৎসবের জয়যাত্রা হয়ে ওঠার কথা। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে আমাদের সব আয়োজনই অনেকটা থমকে যায়। মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে এবার অমর একুশে বইমেলা আয়োজন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয়। ভার্চুয়ালি বইমেলা আয়োজনের কথার পরে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে সরাসরি তবে পিছিয়ে মার্চে বইমেলা আয়োজনের অনুমতি পায় বাংলা একাডেমি। অবশেষে দুয়ার খোলে প্রতীক্ষিত বইমেলার। বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলার’ উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘আমার দেখা নয়াচীন-এর ইংরেজী অনুবাদের মোড়ক উন্মোচন করেন তিনি। সেইসঙ্গে ১০ জন সাহিত্যিককে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার দেয়া হয়। এ বছর বইমেলা উৎসর্গ করা হয় মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি। মেলার মূল ভাবনা ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী’। প্রায় ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় এবারের বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১০৭টি প্রতিষ্ঠানকে ১৫৪টি ইউনিট এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৪৩৩টি প্রতিষ্ঠানকে ৬৮০টি ইউনিটসহ মোট ৫৪০টি প্রতিষ্ঠানকে ৮৩৪টি ইউনিট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মেলায় আছে ৩৩টি প্যাভিলিয়ন। লিটল ম্যাগাজিন চত্বর স্থানান্তরিত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূল মেলা প্রাঙ্গণে। সেখানে ১৩৫টি লিটলম্যাগকে স্টল বরাদ্দের পাশাপাশি ৫টি উন্মুক্ত স্টলসহ ১৪০টি স্টল দেয়া হয়েছে। বাংলা একাডেমিসহ মেলায় অংশ নেয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বইমেলায় বই বিক্রি করছে ২৫ শতাংশ ছাড়ে। এ তো গেল নিয়মের বেড়াজালে আটকানো খবরের কথা। এবার আসা যাক, ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২১’-এর বর্তমান স্বরূপে। বাঙালীর আবেগকে ভালবেসেই বোধকরি শত কষ্টের মধ্যেও বাংলা একাডেমি বাজেটকে মূল্য দিয়ে আয়োজন করছে বইমেলা, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার! কিন্তু যতটা বিস্তৃত জায়গা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার নামে, তার সিকিভাগও পূর্ণ হয়নি। সামাজিক দূরত্ব রক্ষা লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে বইমেলা প্রাঙ্গণে। প্রবেশ পথে স্যানিটাইজার দৃশ্যমান হলেও হাত ধোয়ার ব্যবস্থা দৃশ্যপটে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাস্ক পরিধান করে আর্চওয়ে হয়ে ভেতরে প্রবেশ করছেন দর্শনার্থীরা। সেখানে থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে তাপমাত্রা মাপা, হাত স্যানিটাইজ করতে হচ্ছে। মাস্ক পরে সবাই মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছেন ঠিকই, তারপর মাস্ক চলে যাচ্ছে পকেটে। এক্ষেত্রে মেলা কর্তৃপক্ষের কিছুই করার নেই। কারণ আমরা সচেতন না হলে কি আর করার থাকে। তবে গত বুধবার এক সপ্তাহে চলমান বইমেলার পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করে মেলা সম্পর্কে বেশকিছু নতুন সিদ্ধান্ত নেয় মেলা কর্তৃপক্ষ। বইমেলায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রবেশ বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি এদিন থেকে শুরু হয় ‘মাস্ক নেই, বই বিক্রি নেই’ কর্মসূচী। স্টল বিন্যাসের কথা তো শুরু থেকেই এমন যে মধ্যমণি প্যাভিলিয়ন, আর স্পন্সরের পাঁয়তারায় বিকাশময় মেলা। বিকাশের ছড়াছড়িতে মুজিববর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সৌন্দর্যবর্ধনের দৃশ্য অবলোকনে অনেকটাই ভাটা পড়ছে। তবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য বই সংগ্রহের কার্যক্রমে মেলায় তাদের ৫টি বুথ অনন্য। এদিকে প্রায় প্রতি দুই ইউনিটের মাঝে এক ইউনিট যা দেখতে কতটা গ্রহণযোগ্য বুঝতেই পারছি আমরা। এখনও কাঠ, পেরেক, হাতুড়ির ঠুকঠাক শব্দে এগিয়ে চলছে বইমেলা। অনেক স্টল এখনও খালি। গ্রন্থ উন্মোচনের আশপাশের বেশকিছু স্টল ফাঁকা পড়ে আছে। এসব কিসের স্টল কিংবা স্টলের মালিক কে বা কারা, কি হবে স্টলগুলোর তা মেলা কর্তৃপক্ষই ভাল বলতে পারবেন। এতে করে মেলার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে বৈ কিছু নয়! অথচ বরাদ্দকৃত অনেক স্টলমালিকই ইউনিট বাড়িয়ে চেয়ে না পাওয়ায় হতাশ হয়েছেন। ভিড় এড়াতে এবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্ব দিকে নতুন প্রবেশ পথ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রত্যেক প্রবেশ পথে সুরক্ষিত ছাউনি থাকার কথা, যাতে বৃষ্টি ও ঝড়ের মধ্যে মানুষ আশ্রয় নিতে পারেন। মেলার দশম দিন পেরোলেও তা এখনও নির্মাণাধীন। তবে বিশেষ দিনগুলোতে লেখক, সাংবাদিক, প্রকাশক, বাংলা একাডেমির ফেলো এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য প্রবেশের বিশেষ ব্যবস্থা থাকার কথা বলা হলেও এখনও তার খবর বলা মুশকিল। এবার বইমেলার নিরাপত্তায় পরিবর্তন আনা হয়েছে- মোবাইল প্যাট্রল, ফুট প্যাট্রল থাকছে। বইমেলায় সাদা পোশাকে ব্যবস্থাপনা; সিসিটিভি, আর্চওয়ে; গোয়েন্দা সংস্থা ও ডিবির টিম আছে। মহামারীর কারণে শিশুচত্বর থাকলেও ‘শিশুপ্রহর’ নেই। এদিকে বিভিন্ন সংগঠন, যারা কিছু বই প্রকাশের নামে প্রকাশনা হিসেবে মেলায় অবস্থান করছেন, প্রকাশকদের পাশাপাশি। সেখানে যতটা না বই কেন্দ্রিক আবেগের প্রকাশ, তারচেয়ে বহুগুণ অযাচিত আড্ডা। সেক্ষেত্রে যা অবাক করছে- স্টলে এবং স্টলের বাইরে ধূমপানের মহড়া; অথচ কর্তাব্যক্তিদের কোন ভ্রুক্ষেপই নেই যেন। লিটলম্যাগ চত্বর ঘিরে যা হলো তার অবসান অবশ্য হয়েছে। মেলা প্রাঙ্গণের ধুলোময়তাকে ঠেকাতে নেই পর্যাপ্ত পানি ছিঁটানোর ব্যবস্থা। ফুচকা, চটপটি, বিরিয়ানি থেকে শুরু করে চা-কফির মতো বিভিন্ন খাবারের স্টলের বাহারি আমেজে আমরা মুগ্ধ অথচ দগ্ধ হয়ে ভাবছি, এতকিছু রাখার ব্যবস্থা করলেও আমাদের বইমেলা প্রাঙ্গণে ময়লা ফেলার ঝুড়ি রাখার ব্যবস্থাটি নিতে বরাবরই মেলা কর্তৃপক্ষ উদাসীন থাকছেন কেন! নিরাপত্তায় নজরদারি কেমন যেন চোখ বুজে আছে, তাই এবার স্টলে চুরির বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে ইতোমধ্যে। আলোর স্বল্পতাও লক্ষণীয়। ভাষা সংস্কৃতির উৎসমূল। স্বীয় সংস্কৃতির আকর বাংলা ভাষাকে দুঃখের আল্পনামাখা গুঞ্জরণ থেকে মুক্ত করতে রাত্রির দরোজায় আঘাতে-আঘাতে বেদনাকে আলিঙ্গন করতে পিছপা হয়নি বাঙালী জাতি। আধিপত্যবাদী সাম্রাজ্যবাদের অন্যায়কে একরাশ বারুদ বুকে রক্তের বিনিময়ে প্রতিহত করেছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা। নিয়ে এসেছে মা-কে মা বলার অধিকার। সেই সুবাদে আমরা বাঙালী জাতি পেয়েছি আমাদের চেতনার উৎস-অমর একুশ, বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি। সৃষ্টির শুরু থেকেই গর্বিত মশালের টগবগে চঞ্চলতায় বাসন্তী খাঁচা মেলে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি এগিয়ে চলেছে। তাই বুঝি পৃথিবীর প্রতিটি জাতির মতোই বাঙালীও স্বমহিমায় প্রস্ফুটিত করেছে আপন সংস্কৃতির চিত্রপট। আমাদের মতো এতটা ঋদ্ধ সংস্কৃতিচর্চার বলয় পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার। আমরা বেঁচে হয়তো থাকব, কিন্তু জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মাঝে বইমেলা আর কখনোই ফিরে পাব না। তাই অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে মহামারীর এই ক্রান্তিকালীন সময়েও বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘অমর একুশে বইমেলা -২০২১’ আমাদের লেখক-পাঠক-প্রকাশকের জন্য আন্দোলিত আবেদন। লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীনেত্রী [email protected]
×