ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

কঠোর হবার বিকল্প নেই এখন

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ৩১ মার্চ ২০২১

কঠোর হবার বিকল্প নেই এখন

ইস্যু খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত জঙ্গীগোষ্ঠী এবার একটা ইস্যু পেয়ে গেছে। আর তার সঠিক ব্যবহার করছে তারা। গত কয়েকদিনের চরম উত্তেজনা আর সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে গেছে বাংলাদেশ। নতুন প্রজন্মের কাছে হরতাল-অবরোধ প্রায় অপরিচিত শব্দ। আমাদের যৌবনের সোনালি দিন তারুণ্যের সুবর্ণকাল কেটেছিল হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও-এর ভেতর। পেছন ফিরে তাকালে দেখি এরশাদ আমল, বেগম জিয়ার আমলে সব সময় লাগাতার হরতাল-অবরোধে জীবন ছিল জড়িত। দিনের পর দিন থেমে যাওয়া জীবন দেশ ও জাতিকে এগোতে দেয়নি। শুধু কি তাই? দেশের মানুষের জীবনও ছিল সব সময় ঝুঁকির মুখে। আজ দেশ শাসনে থাকা আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে তারাও কম হরতাল ডাকেনি। রাজনীতির সেই ক্রান্তিকাল হঠাৎই যেন থেমে গেল। ধারাবাহিক দেশ শাসনে শেখ হাসিনা সম্ভব করে তুললেন হরতাল অবরোধহীন বাংলাদেশ। মাঝে মাঝে যে তার ব্যতিক্রম হয়নি বা হয় না তা নয়। কিন্তু তা এখনও ব্যতিক্রমই। বেশ ক’বছর আগে মতিঝিলে হেফাজতের তা-ব বাদ দিলে দেশের এই সমস্যা মাথাচাড়া দিতে পারেনি। ইস্যু খুঁজে বেড়ানো বিরোধী দল ও উগ্রবাদীরা সুযোগ পাচ্ছিল না। এবার তাদের সামনে এসে পড়ল নতুন সুযোগ। তাও স্বাধীনতা দিবসের মহান দিনে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে গত শুক্রবার বায়তুল মোকাররম এবং সারাদেশে হেফাজতকর্মীসহ সাধারণ মুসল্লিদের ওপর পুলিশের হামলা ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে শনিবার রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলামকে নিয়ন্ত্রণে পুলিশের সঙ্গে মাঠে নামে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন। পুলিশ, হেফাজত এবং ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে কয়েকজন নিহত হয়। পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়। ওপরের খবরগুলো মিডিয়ার। সামাজিক মাধ্যমে এর চাইতেও ভয়াবহ সব খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে এখন যার যা খুশি, যে যেমন ইচ্ছে লিখতে পারে। বলতে পারে। এই অবাধ স্বাধীনতার ব্যবহার অপব্যবহার নির্ভর করে যিনি বা যারা লিখছেন, বলছেন তাদের ওপর। আর সব বিষয়ের মতো আমরা বাঙালীরা এখানেও না মানি নিয়ম-কানুন, না কোন নীতি। ফলে সামাজিক মিডিয়াজুড়ে আতঙ্ক আর ভয়। ভয়ের ব্যাপার দেশের কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক অন্যান্য বারের মতো এবারও এই বিষয়টি নিয়ে পানি ঘোলা করছেন। একটা সহজ সাধারণ বিষয় বুঝতে পারছি না। মোদির আসাটা বিষয় হলে তিনি এলেন ঢাকায়, গেলেন গোপালগঞ্জ, সাতক্ষীরা আর মানুষ মরল কিনা হাটহাজারী আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সারাদেশে যদি দাঙ্গা-হাঙ্গামা হতো তাহলেও বুঝতাম। দু’একটি জায়গায় এমন উত্তেজনা বলে দেয় কারা এর পেছনে আর কি তাদের উদ্দেশ্য। ভারতের যে অসাম্প্রদায়িক ইমেজ, বহুকাল ধরে গান্ধী ও তাঁর পরবর্তী নেতাদের হাত ধরে উঠে আসা ভারতের সেই ইমেজ আজ বাধাগ্রস্ত। বিজেপির সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি এর ইন্ধনদাতা। কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী আর সুধীজনদের কাছে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। উপমহাদেশে অসাম্প্রদাকিতার দায় কি শুধু ভারতের? আমরা বা প্রতিবেশীরা কি সে দেশে মৌলবাদের বিস্তারে অবদান রাখিনি? ভারতের এক পাশে পাকিস্তানে কি আসলেই কোনকালে গণতন্ত্র ছিল বা আছে? সেখানে কি সাম্প্রদায়িকতা নেই? সে দেশের নারীরা কি আসলেই ভাল থাকেন? অথচ পাকিস্তানের জন্য এসব বুদ্ধিজীবী ভক্তিতে গদগদ। তাদের দিলে রহমের স্রোত। আজ যদি ইমরান খান আসতেন আপনারা যারা ভাংচুর করছেন, জনগণের সম্পত্তিতে আগুন দিচ্ছেন, রেল স্টেশন জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, আপনারা কি ইমরান খান এলে একাত্তরের কথা মনে রেখে বাঙালী গণহত্যা, নারী ধর্ষণের জন্য এমন তা-ব করতেন? একবারও বলছি না মোদির ভারতে সবকিছুই ঠিকঠাক। বরং গো মাংসের জন্য যে তান্ডব বা মুসলমানসহ সংখ্যালঘুদের ওপর যে অনাচার তা আতঙ্গের। কিন্তু আপনারা ভুলে গেছেন যে কাজ করে আপনারা রাগ বা প্রতিবাদ দেখাচ্ছেন তার সঙ্গে মূলত ধ্বংস আর দেশবিরোধিতা জড়িয়ে। এর মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদি বা ভারতের কিছু হবে না। সেটা আপনারাও ভাল করে জানেন। আপনাদের মূল টার্গেট আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা। তাই বঙ্গবন্ধুকে ছাড় দেননি আপনারা। বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে আগুন লাগানো বা বাঁশ লাঠি নিয়ে হামলা কেন? কি এর ব্যাখ্যা? বহুদিন থেকে আপনারা চাইছেন শেখ হাসিনার সরকারকে বিপদে ফেলতে। এটা মানি নানা অশান্তি, লুটপাট আর অন্যায় হচ্ছে। তার দায় কি দেশের নিরীহ সংখ্যালঘু নামের গিনিপিগদের, না রেল স্টেশনের নাকি হাটহাজারীর রাস্তার? এগুলোর ওপর আপনাদের কেন এত আক্রোশ? আপনাদের আক্রোশ মূলত বঙ্গবন্ধুর দেশটির ওপর। ভারতবিরোধিতা বাহ্যিক আবরণ মাত্র। এই অন্ধত্ব মানা যায় না। যারা জীবন হারালেন তাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবেন উস্কানিদাতারা? অথচ এরা কেউ জানে না ২০১৫ সালে মোদির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে ছবি তুলে ধন্য হয়েছিল মামুনুল হক। আর সুযোগ পেলে এখনও তাই করবে। আমাদের দুর্ভাগ্য ৫০ বছরেও এই অপরাজনীতি শেষ হয়নি। বরং এখন তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। এর দায় আওয়ামী লীগকেও নিতে হবে। এই দল যে বঙ্গবন্ধুর দল, এই দল যে রাজপথের দল এখন তা বোঝা মুশকিল। এত বড় ঘটনার পরও ব্রাহ্মণবাড়িয়া বা হাটহাজারী মূলত রাজনৈতিক প্রতিরোধহীন। যার কারণ দুটি। প্রথমত, আওয়ামী লীগে এখন আদর্শহীন সুবিধাপ্রত্যাশীদের ভিড়। দ্বিতীয়ত, তাদের রাজনৈতিক শক্তি কেড়ে নিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, ভোটহীন রাজনীতি। অচিরেই এসব দিকে মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হলে দেশের অবস্থা আরও সঙ্গিন হতে বাধ্য। এবার দুর্যোগ কাটাতে পারা মানে কি আগামীবারে তা হবে না? আর সবকিছুর সমাধান কি শেখ হাসিনা একাই দেবেন? নিয়ন্ত্রণ করবে নিয়মিত বাহিনী? মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা উন্নতিতে এমন হবেই। তাই জাগাতে হবে মানুষকে। সে কাজ করে বহুবার পথ দেখানো বাংলাদেশকে জাগাতে পারলেই ধর্মান্ধ গোষ্ঠী পালাবে। আর তা না হলে কি হবে তা ভাবতে ভয় জাগে বৈকি। লেখক : সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক [email protected]
×