একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার/সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার। বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে অর্ধশতক বছর। মুজিববর্ষে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে ঘিরে প্রাণের উৎসবে মেতেছে বাঙালী। বাংলার মানুষের সঙ্গে উৎসবে যোগ দিয়েছেন প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানগণ। সশরীরে আসতে না পারলেও ভিডিও বার্তায় বাংলাদেশ ও বাংলার মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা। বাংলাদেশের এই মাহেন্দ্রক্ষণে বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের জনগণের সঙ্গে সংযুক্তির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এই সংযুক্তি আরও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে বাঙালীকে। বাংলাদেশ এখন বাঙালীর গর্বের ঠিকানা। এক সাগর রক্তে রঞ্জিত হয়েছে বাঙালীর স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী হঠাৎ এদেশের নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালীর ওপর গণহত্যা শুরু করে। পাকিস্তানীদের দীর্ঘ শোষণ-নিপীড়ন-নিষ্পেষণের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আপামর বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশ রক্ষায়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে, ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে, লাখ লাখ মা-বোনের লাঞ্ছনার বিনিময়ে অর্জিত হয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখ--বাংলাদেশ। লাল-সবুজের পতাকা। পাক-হানাদারদের সুসজ্জিত সামরিক প্রস্তুতির বিপরীতে বাঙালীকে লড়তে হয়েছে অসম যুদ্ধ। পাকবাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে তাদের দেশীয় সহযোগী- রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এর ফলে কঠিন থেকে কঠিনতর হয় বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাংলার সূর্যসন্তানরা। বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ ঘটে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বাদ পূর্ণ হয় ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সামাজিকসহ সকল স্তরে ছিল শোচনীয় পরিস্থিতি। দেশের মানুষের জন্য খাদ্যের জোগানসহ ন্যূনতম মৌলিক চাহিদা পূরণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। সে সময় বিশ্বের দরিদ্রতম রাষ্ট্রসমূহের তালিকায় স্থান পায় আমাদের এই স্বদেশ। এমন পরিস্থিতিতে ঘুরে দাঁড়ানোই ছিল প্রধান লক্ষ্য। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে কৃষি ছিল বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত। জিডিপির ৬০ শতাংশ আসতো কৃষি থেকে, ৬ শতাংশ শিল্প খাত থেকে, বাকি ৩৪ শতাংশ আসছিল সেবা খাত থেকে। যা একটি দেশের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে বিরাট অন্তরায়। মানুষের গড় আয়ু ছিল পঞ্চাশের কম, মাতৃমৃত্যুর হার ছিল উর্ধমুখী। উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেতে লাগল জনসংখ্যা। অশিক্ষা, কুসংস্কারে জর্জরিত পুরো দেশ। তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে কটাক্ষ করতেও পিছপা হননি।
সেদিনের ভঙ্গুর পরিস্থিতি থেকে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে অল্প সময়ে। এ ঘুরে দাঁড়ানো শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। ১৯৭২ সালে দেশে ফেরার পর কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি ঘাবড়ে যাননি। দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করেন তিনি। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে চালিয়েছেন কঠোর প্রচেষ্টা। দেশের সম্পদ ও বিদেশী সহায়তার সমন্বয়ে তিন বছরের মাথায় ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। কৃষির পাশাপাশি শিল্প খাতের কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়, শিক্ষার সুযোগ তৈরিসহ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে গৃহীত হয় নানা পদক্ষেপ। ১৯৭৪ সালে গৃহীত হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা।
উন্নয়ন ও স্বাবলম্বন
বিশ্ব মানচিত্রে আজ বাংলাদেশ স্বগৌরবে জায়গা করে নিয়েছে। হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ দেশটি আজ উন্নত দেশের সারিতে আসীন হওয়ার অদম্য যাত্রায়। অনুন্নত বাংলাদেশ রূপান্তরিত হয়েছে এশিয়ার বিস্ময় হিসেবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বহুদেশের রোলমডেল। শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, মানব উন্নয়ন, নারীর অধিকার সকল ক্ষেত্রে এসেছে পরিবর্তন। পাকিস্তান নামক যে দেশটি দীর্ঘ তেইশ বছর বাংলাদেশকে উপনিবেশ বানিয়ে লুণ্ঠন করেছে সম্পদ, উন্নয়ন অগ্রগতিতে সেই পাকিস্তানকেও এখন ছাড়িয়ে গেছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের উন্নয়নচিত্রের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা প্রকাশ করে। তুলনামূলক চিত্র বলছে, বাংলাদেশের মানুষের এখন মাথাপিছু আয় ২০৬৪ মার্কিন ডলার, অন্যদিকে পাকিস্তানীদের ১১৩০, করোনাকালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.২, পাকিস্তানের ০.৪, বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন, পাকিস্তানের ২০.৮, বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২, পাকিস্তানের ৬৭ বছর, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে প্রতি হাজারে ২৫, পাকিস্তানে ৫৯ জন, বাংলাদেশে প্রাথমিক স্তরে বিদ্যালয়ে যায় ৯৮ শতাংশ শিশু, পাকিস্তানে ৭২ শতাংশ, বাংলাদেশে এখন বেসরকারী ব্যাংকের সংখ্যা ৪৪টি, পাকিস্তানে ২২টি। উল্লিখিত চিত্রটি বলছে বাঙালীর ওপর সীমাহীন শোষণ চালানো পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রায় অস্তিত্বের সঙ্কটে রয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে এখন শক্তিশালী এক উদীয়মান ও অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসরমান রাষ্ট্র। ২০২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩.৩৫%, শিল্প খাতের ৫১.৩০% এবং সেবা খাতের অবদান ৫১.৩০ শতাংশ। উন্নত দেশগুলোতে কৃষির তুলনায় অন্যান্য খাতের রয়েছে বিশাল অবদান। যা একটি দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ। মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে পূর্বের তুলনায় কয়েক গুণ। মূল্যস্ফীতির পরিমাণ হয়েছে ৫.৪ শতাংশ যা পূর্বের তুলনায় উন্নতির পথে। দেশে দারিদ্র্যের হার তলানির দিকে। উন্নতির এই ধাপগুলোই বলে দেয় উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে বাংলাদেশ।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
একটি দেশকে সাফল্যে সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিতে পারে শিক্ষা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নারী শিক্ষার হার ছিল কম। বর্তমানে দেশের নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য দশম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই বিতরণ, উপবৃত্তি প্রদানসহ গ্রহণ করা হয়েছে বাস্তবমুখী বিভিন্ন পদক্ষেপ। এছাড়াও অপরিণত বয়সে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া রোধেও গ্রহণ করা হয়েছে পদক্ষেপ। বর্তমানে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪.৪ শতাংশ।
এছাড়া অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এসেছে বিরাট পরিবর্তন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়েছে পূর্বের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। যুদ্ধ পরবর্তী ১৯৭৩- ’৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় ছিল ৩৭২ মিলিয়ন ডলার যা ১০০ গুণ বেড়ে ২০১৮- ’১৯ অর্থবছরে হয়েছে ৪০ বিলিয়ন ডলারে। একই সঙ্গে দেশের রেমিটেন্স বৃদ্ধিতেও এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন পণ্য রফতানিতেও বাংলাদেশ আজ সফল। বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, ওষুধ, চালসহ বিভিন্ন পণ্য রফতানি হয় বিশ্বজুড়ে। গত শতাব্দীতেও বাংলাদেশের রাজস্ব আয় ছিল মাত্র ৫ হাজার কোটি টাকা, এ আয় বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮-’১৯ অর্থবছরে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ
বর্তমানে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এনালগ যুগ থেকে বেরিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে বাংলাদেশের রূপান্তর আমাদের অগ্রসরমানতার প্রতীক। দেশের প্রায় প্রতিটি খাতে লেগেছে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া। দেশের প্রায় সকল জেলা উপজেলায় পৌঁছেছে ইন্টারনেট সুবিধা। ই-ভোটিং, ই-পাসপোর্ট, মোবাইল ব্যাংকিং, মানি ট্রান্সফার, ই-লার্নিং, অনলাইন পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, টেলিমেডিসিনসহ বিভিন্ন আধুনিক সেবা চালু রয়েছে বাংলাদেশে। যা মানুষের সময়, শ্রম ও অর্থের ব্যবহারকে সাশ্রয় করেছে। বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সক্রিয় এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বে তথ্য ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। যোগাযোগ ব্যবস্থায় সাধিত হয়েছে অকল্পনীয় সাফল্য। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশও আজ ঘরে বসেই যোগাযোগ করতে পারছে পুরো বিশ্বের সঙ্গে। দেশে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত খাতে সাধিত হয়েছে অভূতপূর্ব উন্নতি। স্বনির্ভর বাংলাদেশ আজ প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যা বিশ্ববাসীকে অবাক করে দেয়ার মতো এক সাফল্যের ছোঁয়া। চলছে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ। এছাড়া, সারাদেশে সড়ক পথে এসেছে বিরাট সাফল্য। উন্নতির এ ধারাই আজ বাংলাদেশকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে বিশ্ব দরবারে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ বাস্তবে রূপায়িত করছেন তাঁরই সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পূর্ণ বাস্তবায়নই হলো বাঙালীর স্বপ্ন পূরণ এবং পরম পাওয়া।
লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এবং
পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড