ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বাংলাদেশের কৃষিতে আসছে আমেরিকার সুপার ফুড কিনোয়া শস্যদানা

প্রকাশিত: ২০:২৪, ২৪ মার্চ ২০২১

বাংলাদেশের কৃষিতে আসছে আমেরিকার সুপার ফুড কিনোয়া শস্যদানা

নিজস্ব সংবাদদাতা, লালমনিরহাট ॥ প্রথমবারের মত লালমনিরহাট জেলায় সুপার ফুড উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় পুষ্টিগুনে সমৃদ্ধি ফসলশস্য দানা কিনোয়া এই দেশের মাটি ও আবহাওয়ায় মাঠ পর্যায়ের তৃণমূলের কৃষক চাষ কওে সাফল্য পেয়েছে। এই ফসল ধান জাতি শস্য চাষের চেয়েও লাভ জনক। বাংলাদেশে কৃষিতে এসেছে বৈচিত্র্যতা। আগামীতে বিশ্ব কৃষি অর্থনীতিতে বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্নে দেখাচ্ছে কিনোয়া ফসলের উৎপাদন। উত্তরাঞ্চলের এক সময় ব্যাপক আকারে সাথি ফসল হিসেবে কাউন জাতীয় শস্যদানা (চীনা কাউন) ব্যাপক আকারে চাষ হতো। এখন তেমন চাষ হয়না। তবে কালে ভাদ্রে চরের জমিতে এখনো কেউ কেউ চরের ফসল হিসেবে কাউন চাষ করে থাকে। কাউন চাষ বিলুপ্ত প্রায়। কিনোয়া কাউনের মতন দেখতে। কিন্তু এই কাউনে খাদ্য গুন তেমন নেই। বিপরীত চিত্র কিনোয়ার ক্ষেত্রে । কিনোয়া উচ্চমান সম্পূর্ণ পুষ্টিকর খাদ্য। যাহা মানবদেহের কল্যাণমূলক ক্যালোরি যুক্ত দানাদার খাবার। এটা ভাত, রুটির বিকল্প হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকার, উত্তর আমেরিকা, চিনে এমন কি পাশের দেশ ভারতের মানুষ খায়। ভারতের নামিদামী রেষ্ট্ররেন্ট গুলোতে জনপ্রিয় খাবারের তালিকায় স্থান কওে নিয়েছে কিনোয়া। এটি উত্তর আমেরিকার ফসল। শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ ৫ বছর ধরে কিনোয়া জাতের ফসল নিয়ে গবেষণা করেছে। সেই গবেষণার পর মাঠ পর্যায়ে এবছর প্রথম কিনোয়ার চাষ হয়েছে বাংলাদেশে। সারাদেশে ৫টি পরীক্ষামূলক প্লটে মাঠ পর্যায়ে তৃণমূল কৃষকে দিয়ে কিনোয়া চাষ শুর হয়েছে। নতুন এই ফসলের চাষ হয়েছে লালমনিরহাটে দুটি, কুড়িগ্রামে এক টি ও পটুয়াখালীতে দুইটি প্লটে । লালমনিরহাট ও কুড়িগ্রামের তিন টি কিনোয়া চাষের প্লটে কিনোয়া চাষ হয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ জমিতে। কিনোয়ার ফলন হয়েছে আশানুরুপ। উৎপাদন কৃষক আশা করছে বাম্পার। এই ফসল চাষ অত্যন্ত লাভজনক। কিনোয়া ফসরের শস্য দানার রং তিন ধরণের হয়ে থাকে সাদা, লাল ও কালো। লালমনিরহাট সদর উপজেলার চিনিপাড়া গ্রামের কৃষক ইসরাইল হোসেন(৫৫) জানান, কিনোয়া ফসল সম্পর্কে তার কোন পূর্বে থারণা ছিলনা। দেশের প্রচরিত কৃষি ফসল চাষ করে আসছিলেন। একটি বেসরকারি কোম্পানীর কৃষিবিদ ইকবাল হাসান এই কিনোয়া লাভজনক ফসল হিসেবে চাষের পরামর্শে দেয়। তার পরামর্শে ২৫ শতাংশ জমিতে কিনোয়া চাষ করেছে। কিনোয়া চাষে খরচ হয়েছে প্রায় ১৩ হাজার টাকা। ২৫ শতাংশ জমিতে প্রায় ৮০-৯০ কেজি কিনোয়া শস্য দানা জাতীয় ফসল উৎপাদন হবে। কৃষিবিদ ইকবাল হাসান বীজ সহায়তা দিয়ে ছিল। মাঠ পর্যায়ে ফসলের চাষ পদ্ধতি দেখিয়ে ছিল। এই কিনোয়া চাষে কোন রাসায়নিক সারের ব্যবহার করা হয়নি। শুধুমাত্র জৈব সার ব্যবহার করে আশানুরুপ কিনোয়া চাষে সাফল্য পেয়েছি। তবে স্থানীয় বাজারে কিনোয়া জাতীয় ফসলের কোন গ্রাহক নেই। তাই রাজারজাত করণে আছে নানা প্রতিবদ্বকতা। সরকার বাজার জাত করণে সহায়তা দিলে আগামীতে কয়েক গুন বেশি জমিতে কিনোয়া ফসল চাষ করার আগ্রহ আছে। এটা একটি লাভজনক অর্থকারি ফসল। কিনোয়া চাষে মাঠ পর্যায়ে কৃষককে সম্পৃক্ততা করা গেলে কেউ বিষ ফসল তামাক চাষ করতে আগ্রগী হবেনা। তামাকের চেয়েও কয়েক গুন লাভজনক ফসল। বিদেশে এই শস্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মাটি বেলে-দোআঁশ যুক্ত মাটি। শীতের সময় আবহাওয়াও কিনোয়া ফসল চাষের উপযোগী থাকে। তাই কিনোয়া চাষে সাফল্যে এসেছে। এখন জনপ্রিয় করা গেলে এই ফসল কৃষিকে বিশ্বে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনৈতিকে মর্যাদার আসনে বসাবে। কৃষি ঘুরে দাঁড়াবে। বেসরকারি কোম্পানীর কৃষিবিদ ইকবাল হাসান, কিনোয়া চাষ করতে প্রতি শতাংশ জমিতে খরচ হয় আনুমানিক প্রায় ৫-৬ শত টাকা। কিনোয়া ফসল উৎপাদন হয় (শস্যদানা) উৎপাদন হয় প্রায় ৪-৬ কেজি। ব্যক্তিগত ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে মাঠ পর্যায়ে তৃণমূলের তিন জন কৃষককে কিনোয়া চাষে আগ্রহী করে তুলেছি। এই তিন জন কৃষক ছিল কিনোয়া চাষের পাইলট প্রজেক্ট । উৎপাদন খুবেই (ফলাফল) সন্তোষজনক পেয়েছি। কিনোয়ার আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। উউরোপ, আমেরিকা ও চিনের মানুষের ক্যালোরি জাতীয় প্রধান পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য কিনোয়া শস্য দানা। বাংলাদেশে এখনো সেই ভাবে মার্কেট বা বাজার গড়ে উঠেনি। বাংলাদেশে রাজধানী ঢাকাসহ বড় শহর গুলোতে কিনোয়ার চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশে ভোক্তাদের অগ্রিম চাহিদা দিয়ে আমদানিকৃত প্রতিকেজি কিনোয়া কিনতে হচ্ছে ১৬০০ টাকা দরে। ঢাকা শের-ই- বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেনট অব এগ্রোনমী’র প্রফেসর ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস জানান, কিনোয়া হলো হাউ প্রোটিন সম্পন্ন খাবার। এটিকে সুপার ফুডও্ বলা হয়। কিনোয়াতে অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে এবং লাইসিন সমৃদ্ধ, যা সারা শরীর জুড়ে স্বাস্থ্যকর টিস্যু বৃদ্ধিকে সহায়তা করে। কিনোয়া আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন ই, পটাসিয়াম এবং ফাইবারের একটি উৎকৃষ্ট উৎস। রান্না করা হলে এর দানাগুলি আকারে চারগুণ হয়ে যায়। দানা গুলো প্রায় স্বচ্ছ হয়ে যায়। প্রফেসর ড. পরিকমল কান্তি বিশ্বাস আরো জানান, ৫ বছর গবেষণার পর পাইলটিং করতে মাঠ পর্যায়ে কিনোয়া চাষ তৃণমূলে পর্যায়ের কৃষকদেও দ্বারা শুরু করেছি। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশে কিনোয়া চাষের অনুমোদন দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তাদের আবেদনের ভিত্তিতে এই অনুমোদন দেয়া হয়েছে। খড়া প্রবন ও লবনাক্ত প্রবন দুই ধরণের জমিতে কিনোয়া চাষ সম্ভব। নভেম্বরের মাঝামাঝি এই ফসল চাষ শুরু করতে হয়। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে মাঝামাঝি সময় সফল ঘরে তোলা যায়। খাদ্য চাগিদা মেটাতে উৎপাদিত কিনোয়া বিদেশে রপ্তানি করা যেতে পারে। কৃষি অর্থনৈতিক ভাবে দেশকে এগুতে হলে কিনোয়া চাষের মাধ্যমে কৃষক বৈদেশিক মুদ্রার্জন সম্ভব। কৃষিও বৈদেশিক মুদ্রা খাতে ব্যাপক অপদান রাখতে পারে। শর্করা, প্রোটিন, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর সুপারফুড কিনোয়া-১ জাত উদ্ভাবন করেছে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কৃষিতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. পরিমল কান্তি বিশ্বাস। যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। কিনোয়া দানা পুষ্টি সমৃদ্ধতার কারণে অন্যতম সুপার ফুড হিসেবে স্বীকৃত। আমেরিকার এই ফসল সম্পর্কে শেরে বাংলা কৃষি গবেষণার গবেষণা পত্রে জানাযায়, সাউ কিনোয়া-১ ((ঝঅট-ছঁরহড়ধ-১) বাংলালাদেশে চাষ হচ্ছে। এটি নতুন জাত। জাতটির নিবন্ধ নম্বর ০৫(৪৬)-০১/২০২০। খরা ও লবনাক্ত অঞ্চলসহ সারাদেশে রবি মৌসুমে এ ফসলটি চাষ করা সম্ভব হবে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ন দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সেক্ষেত্রে খরা ও লবনাক্ততা সহনশীল ফসল হিসেবে সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতে পারে নতুন ফসল সাউ কিনোয়া-১। কিনোয়া বৈজ্ঞানিক নাম ঈযবহড়ঢ়ড়ফরঁস য়ঁরহড়ধ ফসলটি অসধৎধহঃযধপবধব পরিবারভূক্ত একটি দানাশস্য। এতে রয়েছে ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রণ, জিংক, কপার, ফসফরাস, পটাশিয়াম এবং ম্যাঙানিজ। রয়েছে সকল প্রকার প্রয়োজনীয় এমাইনো এসিড। ফসলটির পুষ্টি সমৃদ্ধতার কারণে খ্রীষ্টপূর্ব ৫ হাজার বছর পূর্ব থেকেই ল্যাটিন আমেরিকাভূক্ত দেশে দানা, ফ্লেক্স, পাস্তা, রুটি, বিস্কুট, বেভারেজ হিসেবে কিনোয়া ব্যবহার করে আসছে। বর্তমানে উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালী, সুইডেন, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, চীন, থাইল্যান্ড, ভারতসহ ৯৫ টিরও অধিক দেশে কিনোয়া চাষাবাদ হচ্ছে। এসব দেশের পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে। মানুষ এখন কম খাবার খেতে আগ্রহী। একই ভাবে পুষ্টিকর খাদ্য চায়। কিনোয়া মানবদেহের ওজনহ্রাসে ভুমিকা রাখে। কিনোয়া ফসলের সশ্যদানার রং তিন ধরণের হয়ে থাকে। সাদা, লাল ও কালো। খাবর হিসেবে খুবেই সুসাদ ও মিষ্ট।
×