ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

দেশ রূপান্তরে তারুণ্যের শক্তি অপরিহার্য

প্রকাশিত: ২১:০১, ১৪ মার্চ ২০২১

দেশ রূপান্তরে তারুণ্যের শক্তি অপরিহার্য

বিশ্বজুড়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এগিয়ে চলার তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাময় বিশ্বে টিকে থাকতে হলে তরুণ সমাজকে এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে। তাদের মধ্যে যে অফুরন্ত সম্ভাবনা ও সুপ্ত সৃজনী শক্তি রয়েছে তা জাগিয়ে তুলতে হবে। এর জন্য চাই জ্ঞানভিত্তিক গুণগত শিক্ষা, যার আলো তাদের অন্তরকে আলোকিত করবে, সম্ভাবনা ও সুপ্তশক্তিকে উন্মোচিত করবে, আত্মবিশ্বাসী ও কর্মোদ্যোগী করে তুলবে। আমরা জানি, জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান সৃজনী শক্তিকে পরিপুষ্ট করে, উন্নয়নের সিঁড়িকে করে মজবুত। জ্ঞানান্বেষণের প্রবল ইচ্ছা একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের জন্ম দেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চর্চা যেমন অর্থনৈতিক উন্নতির ভিত তৈরি করে, তেমনই নৈতিক শিক্ষা সভ্যতা ও সুশাসনের ভিতকে শক্তিশালী করে। জ্ঞানার্জনের ফলে তরুণরা নীতি-নৈতিকতায়, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠবে। তারা তখন তাদের পছন্দনীয় কর্মক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ নিতে পারবে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মী, ব্যবস্থাপক ও উদ্যোক্তা হিসেবে ছড়িয়ে পড়বে। উন্নয়নের বহুমুখী খাতগুলো তারুণ্যের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠবে। দেশে এখন তরুণ সমাজের খুবই দুঃসময় চলছে। তাদের মধ্যে অনেক ঘাটতি ও হতাশা বিরাজ করছে। গুণগত শিক্ষায় পশ্চাৎপদতা, জ্ঞান ও প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার অভাব, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দুর্বলতা, অপুষ্টি, চাকরি ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, এসব সমস্যা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনার দ্বারকে রুদ্ধ করে রেখেছে। আমাদের দেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ। কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অর্জিত প্রবৃদ্ধিই প্রমাণ করে এ দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা। কিন্তু বর্তমান সময়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে করোনাভাইরাস যেন হঠাৎ আসা ঝড়ের মতো সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। শিগগিরই পুনরুদ্ধারের আশা অতিক্ষীণ। নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতির ওপর। তবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে শুধু করোনাভাইরাস নয়, ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যার আঘাতেও অর্থনীতি বিপর্যস্ত। বাংলাদেশ তিনটি ধাক্কা সামলেও সামনে এগিয়েছে। এটা টিকে থাকার পুরনো সক্ষমতার প্রমাণ। করোনায় অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব পড়ায় দারিদ্র্য বেড়েছে। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা ব্র্যাক ও পিপিআরসি বলছে, জুলাই শেষে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ছিল ২০ শতাংশ। অন্যদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) তথ্যমতে, দারিদ্র্যের হার এখন ৩৫ শতাংশ। সর্বশেষ ২০২১ সালে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের জরিপ অনুযায়ী, করোনার প্রভাবে দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। পাশাপাশি দেশে আয়বৈষম্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৫২ পয়েন্ট, যা ২০১৬ সালে ছিল দশমিক ৪৮ পয়েন্ট। বৈষম্য ক্রমাগত বাড়ছে। এটা মোটেও ভাল লক্ষণ নয়। কোভিডের আগে দারিদ্র্যবিমোচনে বাংলাদেশ বেশ ভাল করছিল; কিন্তু কোভিডের ধাক্কায় সে অবস্থা আর নেই। করোনাভাইরাসের ধাক্কায় এখন মানুষের আয় কমে গেছে। বহু মানুষ নতুন করে বেকার হচ্ছে। আগের বেকার সমস্যা তো রয়েছেই। গত দেড় দশকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। প্রবৃদ্ধি বাড়লেও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি দিন দিনই কমছে। সর্বশেষ প্রকাশিত শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, ২০১৩-১৭ সাল এই চার বছরে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ২৭ লাখ। অর্থাৎ বছরে গড়ে পৌনে সাত লাখ নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর ২২ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে। জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে যত লোক চাকরি বা কাজ করেন তাদের মধ্যে ৬০ দশমিক ৯ শতাংশ আত্মনিয়োজিত। গৃহস্থালি পর্যায়ে কাজ করেন ২০ দশমিক ৮ শতাংশ এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত কিংবা স্থানীয় সরকার পর্যায়ে কাজ করেন মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। আর এনজিওতে আছেন দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ। কোভিড-১৯-এর কারণে দেশের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছেন। জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ আসে এই অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রায় দুই কোটি নারী-পুরুষ এই খাতে কাজ করেন এবং গত ৫ বছরে গড়ে ১০৫ দশমিক ৭ শতাংশের বেশি নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) বলছে, করোনার কারণে শুধু পোশাক খাতে তিন লাখের মতো কর্মী কাজ হারিয়েছেন। যাদের শিগগিরই কাজ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। অপরদিকে আইএলও বলছে, করোনা মহামারীর কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২৪ দশমিক ৮ শতাংশই বেকার হয়েছেন। করোনার কারণে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন চাকরি প্রত্যাশী তরুণরা। জীবন ও জীবিকার লড়াইয়ে আজ তারা পুরোপুরি হতাশায় নিমজ্জিত। অনিশ্চিত ভবিষ্যত জীবন যেন তাদের দিন দিন অস্থির করে তুলছে। বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ তরুণ। তরুণরাই একটি দেশের প্রধান চালিকাশক্তি ও ভবিষ্যত নির্মাতা। তাই এই বিশাল জনগোষ্ঠী কর্মবিমুখ রেখে কখনোই দেশে টেকসই অর্থনীতি আশা করা যায় না। এই মহামারীতে দেশের অর্থনৈতিক সাফল্য ধরে রাখতে তথা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য কর্মসৃজনমূলক কর্মসূচী নিতে হবে। দেশের অভ্যন্তরে বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরি করতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য যে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার সুফল সবাই পাচ্ছে না। বিশেষ করে এসএমই খাতের উদ্যোক্তা প্যাকেজের সুবিধা নিতে পারছেন না। অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকও সহযোগিতা করছে না। এসব বিষয়ে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের তরুণদের অদক্ষ ও সস্তা শ্রমের বাজার থেকে বের হয়ে নিজেদের দক্ষ, জ্ঞান-বিজ্ঞানসমৃদ্ধ, স্মার্ট জাতিতে পরিণত হতে হবে। এজন্য প্রচলিত শিক্ষার পাশাপাশি বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিক, যুগোপযোগী আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদামাফিক শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে একটা বিষয়ই অপরিবর্তনীয় আর সেটা হলো পরিবর্তন। এবং এই পরিবর্তনের হাত ধরেই পৃথিবীর এত অগ্রগতি। এই পরিবর্তিত বাস্তবতায় অথবা নিউ নরমাল লাইফে যে দেশ যত দ্রুত খাপ খাওয়াতে পারবে, তাদের অর্থনীতিও তত দ্রুত পুনরুদ্ধার হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মানবসভ্যতায় প্রতিটি বিপর্যয়ই কোন না কোন সুযোগ নিয়ে আসে। সেই সুযোগটিই সবার আগে তরুণদের উদ্ভাবনী জ্ঞান দিয়ে খুঁজে বের করতে হবে। নতুন আইডিয়ার ওপর ভর করেই পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে। ফেসবুকের নিজস্ব কোন কন্টেন্ট নেই, আলিবাবার কোন পণ্য নেই, কোন গাড়ি নেই উবারের। তার পরও এগুলো মাল্টি বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি। সারা বিশ্বে আজ হাইটেক ব্যবসা-বাণিজ্যের জয়জয়কার। তাই তরুণদের পুরনো ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে নতুন নতুন আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বিশ্বে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ করে গড়ে তুলতে হবে। তরুণদের লেগে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সামনের এই পরিবর্তিত পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে দক্ষতা দিয়ে টিকে থাকতে হবে। হতাশা কখনই সফলতা বয়ে আনে না। হাল ছাড়া যাবে না। জাতির নেতৃত্ব দিতে হবে তরুণদেরই। পৃথিবীতে আজ যত উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ সব এই তরুণদের হাত ধরেই। তাই তারা দেশ ও জাতিকে উপহার দিবে একটি শান্তি ও সৌহার্দ্যময় পরিবেশ। বিশ্বের বুকে দেশকে একটি মর্যাদাশীল আসনে প্রতিষ্ঠিত করবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতির ফলে পরিবর্তনের হাওয়া বইছে সর্বত্র। এ পরিবর্তন যেমন একদিকে কল্যাণ বয়ে আনছে, অন্যদিকে বিপর্যয়ও ডেকে আনছে। পরিবেশ দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, বিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার, নব্য আধিপত্যবাদী আগ্রাসন, জঙ্গীবাদ, প্রাণঘাতী রোগ-ব্যাধি ইত্যাদি নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে পৃথিবীর মানুষ। মানুষের ভোগবাদী প্রবণতা প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদকে উজাড় করে দিচ্ছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির দৌরাত্ম্যে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য পাহাড়সম রূপ ধারণ করছে। এক শ্রেণীর মানুষের হাতে সম্পদের পাহাড় জমছে, অন্যদিকে অগণিত দরিদ্র ও বুভূক্ষ মানুষের হাহাকারে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হবে তরুণ সমাজকে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও নতুন ধ্যান ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে নতুন রূপরেখা তৈরি করবে তরুণেরা। অতীত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে নিজেদের বুদ্ধি বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিবে, নেতৃত্ব দিবে এবং এগিয়ে যাবে তারা। তরুণরা আমাদের দেশের জন্য এক অসীম শক্তি। সেই শক্তি দেশের উন্নয়নের জন্য, সঠিক পথে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য। সর্বোপরি তারাই বাংলাদেশকে একটি সমৃদ্ধিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। তাদেরও সেভাবেই গড়ে তুলতে হবে। তবেই তাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ একদিন উন্নত বিশ্বের কাতারে স্থান করে নিতে সক্ষম হবে। লেখক : শিক্ষাবিদ [email protected]
×