ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

রণেশ মৈত্র

মুশতাকের মৃত্যু ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

প্রকাশিত: ২০:৫৯, ১৪ মার্চ ২০২১

মুশতাকের মৃত্যু ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো লেখক মুশতাকের খবরে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ভর্তি ছিল। মূল খবর ছিল মুশতাকের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে। তথাকথিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে। এই আইনের সমালোচনা বহুদিন থেকেই চলে আসছে। আবার এর প্রয়োগও চলছে সমানতালে। আইনের সর্বশেষ ও মর্মান্তিক শিকার লেখক মুশতাক। তাকে শুধু গ্রেফতার করাই হলো না, প্রায় এক বছর ঐ আইনে শুধু আটকই রাখা হলো না, তার মৃত্যুও ঘটল ঐ আটকের পরিণতিতে আটকাবস্থায়ই। মুশতাকের চিকিৎসা হয়েছে উপযুক্তভাবে- সরকার এমন দাবি করলেও তা সত্যের অপলাপ মাত্র। মৃত্যুর পরে তাকে বাইরের হাসপাতালে নেয়া হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। এ এক মর্মান্তিক পরিহাস একজন লেখকের জীবন নিয়ে। সমগ্র বাংলাদেশ মুশতাকের গ্রেফতার ও তার মৃত্যুর ঘটনার প্রতিবাদে সোচ্চার। ছাত্র-যুবাদের উদ্যোগে শুরু, ক্রমে পথে নামছেন অন্যান্য পেশাজীবীও। কিন্তু সরকার এখনও প্রায় নির্বিকার। গণদাবির মুখে জেলা প্রশাসন একটি দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন করলেও লোকে কিন্তু এই পদক্ষেপকে ‘লোক দেখানো’ বলেই মন্তব্য করেছেন। এ কথা জানা, এই তদন্তের রিপোর্ট কোনদিন জনসচক্ষে প্রকাশ করা হবে না। যেমন করা হয়নি অতীতের কোন তদন্ত কমিশনের প্রদত্ত রিপোর্টও। অভিজ্ঞতা আরও বলে, যদিবা কিছু ত্রুটি খুঁজে পায়ও কমিশন তবে তা হবে একজন ডেপুটি জেলার বা জেলার বা সুপারিনটেন্ডেন্টের ‘গাফিলতি’। তার প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ শাস্তিটা ও.এস.ডি করে কিছুদিনের মধ্যে তাকে বা তাদেরকে অন্যত্র বদলি এবং কিছুকাল পর পদোন্নতি। এমনটাই দেখে আসছি সেই ইংরেজ আমল থেকে। কিন্তু মৃত্যু যখন ঘটেই গেল তখন নির্যাতনের চাইতে ‘ডিজিটাল হত্যা’ বলতেই সম্ভবত মৃত্যুর চেহারাটি সবার সামনে খোলাসা হয়। প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ মুশতাককে গ্রেফতার, কারাগারে তাকে হত্যা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামক কুখ্যাত কালাকানুনটি বাতিলের দাবিতে শক্তিশালী আন্দোলন সমগ্র জাতির অকুণ্ঠ নৈতিক সমর্থন পেয়েছে। এ আন্দোলনের উত্তাপ, তার আগুন কখনও কখনও স্তিমিত মনে হলেও ধিকিধিকি তা জ্বলতেই থাকবে, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণকারী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত। তার আগে ঘটতে পারে গণবিস্ফোরণ। অতীত সে শিক্ষাও দেয়। বাংলাদেশের জন্ম কাহিনী অজানা নেই কারও। ২৩ বছর ধরে পাকিস্তান বাঙালীদের যেভাবে মূক ও বধির করে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল, ১৪৪ ধারা, কার্ফু, জেল-জুলুম, চিন্তা-কর্ম-লেখা-মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করে স্বৈরশাসন কায়েম করেছিল, শত নির্যাতন সহ্য করেও মানুষ ঐ কালাকানুনগুলো মেনে নেয়নি, কি আওয়ামী লীগ, কি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কি ছাত্র ইউনিয়ন, কি ছাত্রলীগ। সে সময়ের সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ঐ কালাকানুনগুলো বাতিল দাবি করেছে। দাবি করেছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। সেই দাবিতে ধারাবাহিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মনোরঞ্জন ধর, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহম্মদ প্রমুখ। আরও অসংখ্য নেতা-কর্মীর নাম করা যাবে যাঁরা ঐ আন্দোলনে নির্ভীক ও বিপুল অবদান রেখেছিলেন। সবারই জানা এবং অতীত ইতিহাস বলে ঐ ধারাবাহিক আন্দোলনের পথ ধরেই বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্রভাবে শামিল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কোটি কোটি বাঙালীর সক্রিয় সমর্থনে, লাখ লাখ মানুষের জীবনাহুতির বিনিময়ে এক সমুদ্র রক্ত ঢেলে দিয়ে, কঠিন মূল্য দিয়ে দেশ-বিদেশের নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থনে অর্জিত এই সাফল্য- এই স্বপ্নের বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে মানুষের কণ্ঠরোধ করা? কখনই তা দেশের মানুষ মেনে নেবে না। সরকারকে ভুল বার্তা দিচ্ছে এই কালো আইনের সমর্থকরা। অবশ্যই সকলের কাম্য রাষ্ট্রদ্রোহীদের শাস্তি দিতে হবে। তার জন্য প্রচলিত আইনগুলোই যথেষ্ট। তারপরেও এই আইন। কেন? কার স্বার্থে? কার বিরুদ্ধে? বাংলাদেশে রাষ্ট্রদ্রোহী কারা? সবাই জানি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম প্রমুখ ধর্মের নামে রাজনীতি করছে যারা। জানি বাংলাদেশের শত্রু তারা যারা সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধতা প্রচার করে। যারা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান-আদিবাসী-নারী-পুরুষের বিভেদ ও বৈষম্য সৃষ্টি করে তারা। বাংলাদেশের শত্রুর তালিকায় আরও রয়েছে যারা মন্দির ভাঙ্গে, মূর্তি ভাঙ্গে, মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করে, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টি করে, সংঘাত সৃষ্টি করে, নারী-পুুরুষের সমঅধিকারের বিরোধিতা করে, নানাবিধ শিল্পকর্ম-ভাস্কর্য ভাঙ্গে, তার নির্মাণের বিরোধিতা করে, যারা বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের বিরোধিতা করে, দাবি করে সাম্প্রদায়িক শিক্ষা ব্যবস্থার, যারা বাংলাদেশের বাহাত্তরের সংবিধানে বর্ণিত চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে বিকলাঙ্গ করে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজনকে সমর্থন করে তারা। কিন্তু এই যে অপরাধ ও অপরাধীদের তালিকা ওপরে দেয়া হলো সেই তালিকার ভিত্তিতে এ যাবত কারও বিরুদ্ধে কি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগ করা হয়েছে? পরিসংখ্যান বলে, একটিও না। কোন মিথ্যা গুজব সৃষ্টিকারীদের কি এ যাবত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা, বিচার করা, শাস্তি দেয়া হয়েছে? হয়নি, এটাই সত্য। বরং এ যাবত যারা ঐ আইনে গ্রেফতার হয়েছেন তারা লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক প্রমুখ। আরও গ্রেফতার করা হয়েছে যারা সাম্প্রদায়িকতার শিকার, যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব রটনা হয়েছে তারা। মিথ্যা গুজব রটিয়ে যাদের বাড়ি পোড়ানো হয়েছে সেই অগ্নিসংযোগকারীরা নয়, বরং যারা ক্ষতিগ্রস্ত নিরীহ নিরপরাধ মানুষ তারাই। মসজিদ থেকে মাইকে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে যাদেরকে ফেসবুকে মিথ্যা পোস্ট দেয়ার প্রচার করে লাখো লোক নিমিষে সমবেত করে যার বিরুদ্ধে গুজব ছড়াল তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। কিন্তু একটি ঘটনাও নেই ঐ মিথ্যা গুজব রটনাকারী কাউকে গ্রেফতারের। ঐ গুজব প্রচার করে যারা অজস্র মানুষের অবৈধ জমায়েত সৃষ্টি করে গ্রামের নিরীহ মানুষের বাড়িঘর লুটপাট করাল, যারা নিরীহ মানুষের বাড়িঘর ভাঙচুর বা তাতে অগ্নিসংযোগ করল সেই প্রকৃত অপরাধীদের কারও গায়ে এতটুকুও আঁচড় লাগেনি আজতক। আইনটি এবং তার প্রয়োগ দেখতে দেখতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে দেশের সকল গণমাধ্যম। একচেটিয়া সরকারী প্রচার-প্রচারণাই হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রতি অঘোষিতভাবে বাধ্যতামূলক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বলে দিবারাত মুখে ফেনা তুলে ফেললেও বাস্তবে প্রদর্শিত কার্যকলাপ তার ধারে-কাছেও নেই। কথা না বাড়িয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে, সমস্ত চেতনা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিল চাই। একই সঙ্গে এই আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে এ যাবত যারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদেরকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক। আটকাবস্থায় মৃত্যুর দায় পুরোপুরি সরকারের। তাই তাদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে এবং আইনটি বাতিল করে যাত্রা শুরু হোক স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে। লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক [email protected]
×