ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল আইন থাকবে তবে

প্রকাশিত: ২১:০০, ১১ মার্চ ২০২১

ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল আইন থাকবে তবে

বর্তমান যুগ তো ডিজিটাল যুগ অর্থাৎ তথ্য প্রযুক্তির এবং বিজ্ঞানের যুগ, ইন্টারনেটের যুগ। এই যে কয়েক বছর আগে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে একশ’ মিলিয়ন ডলার হ্যাকাররা চুরি করল তা তো ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় সংঘটিত অপরাধ। এর বিচার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেই হওয়ার কথা। যদিও নিউ ইয়র্কের আদালতে বাংলাদেশ এ অর্থ ফিরে পাবার জন্য মামলা করেছে। তাছাড়াও এটিএম বুথ থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের অর্থ চুরিও ডিজিটাল অপরাধ। এ অপরাধের পাশে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদিতে ব্যক্তি মানুষকে নানাভাবে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছে নানা অপরাধী। জঙ্গী- জেহাদীদের নানা রকম ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ব্যক্তি মানুষের প্রতি ঘৃণা, হিংসাত্মক হত্যার উস্কানিমূলক প্রচারণা তো অবশ্যই ডিজিটাল অপরাধ, যার বিচার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হতে হবে- এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বলা হচ্ছে- আমেরিকার ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়া ডিজিটাল কৌশল অবলম্বন করে ট্রাম্পকে জিতিয়ে দিয়েছিল! এটা নানাভাবে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক ভোটারদের প্রচারণার ফাঁদে ফেলে ট্রাম্পের ভোট বৃদ্ধি করেছিল বলে বলা হয়। এমনকি পর্নো ছবি তৈরিতে কিশোর-কিশোরী, বালিকাদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। কেউ কেউ ফেসবুকে পরিচিত হয়ে প্রেম করছে, দেখা করতে গেলে তরুণীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কেউ কেউ ধর্ষিতা হয়ে খুনও হচ্ছে। আরেকটি বদমায়েশি করা হয়েছে সংখ্যালঘু নিরীহ স্বল্প শিক্ষিতের নামে মিথ্যা ফেসবুক এ্যাকাউন্ট খুলে তার নামে ইসলামের নবীর প্রতি অবমাননামূলক উক্তি, মন্তব্য ছড়িয়ে দিয়ে সংখ্যালঘু বৌদ্ধ, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপাসনালয় থেকে বসতবাড়ি, গোলার ধান লুট, ভাংচুর করা, অগ্নিসংযোগ করা এবং মেয়েদের ধর্ষণ করার মতো অনেক অপরাধ করা হয়েছে। এগুলো তথাকথিত মৌলবাদী জেহাদীরা পরিকল্পিতভাবে দেশ ও সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে করেছিল। তাদের অনেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ আহমদীয়াদের বিরুদ্ধে, হিন্দু-বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিচারের আওতায় আসে। তবে বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কিছু অতি উৎসাহী র‌্যাব-পুলিশ সদস্য সাধারণ কিছু অনলাইনে মন্তব্যকারী লেখক, কার্টুন-চিত্র শিল্পীদের, নিরীহ লোকসঙ্গীত গায়ক-গায়িকাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে গ্রেফতার করছে এবং আলবদরীয় স্টাইলে সাদা পোশাকে, ওয়ারেন্ট ছাড়া হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে কোন কারণ না জানিয়ে দৈহিক নির্যাতন করে কয়েকদিন পর আদালতে তুলছে। এসব অপঘটনা যারাই করুক, তারা আর যাই হোক, সরকার বা সরকার প্রধানের শুভাকাক্সক্ষী তো নয়ই, বরং প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি বিনষ্টে কাজ করছে, ঠিক যখন প্রধানমন্ত্রী দেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার অনুমোদন লাভ করেছেন। যদি তাই হয়, তাহলে তারা তারেকের লোক নয়, তার প্রমাণ কি? তারেক অপরাধে দণ্ডিত হলেও সে বা তাদের পরিবার বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। তারা অর্থাৎ খালেদা-তারেকের ঘনিষ্ঠ মিত্র জামায়াত-মৌলবাদী জঙ্গীদের আবারও নতুনভাবে বাংলা ভাইয়ের মতো উত্থান ঘটানোর চেষ্টা চলছে। এটি বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। বিএনপির জন্য বর্তমান সময়ে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি বড় সুযোগ এসেছিল। দলটি দণ্ডিতদের বাদ দিয়ে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধপন্থী নেতা-নেত্রীদের নেতৃত্বে একটি প্রকৃত দেশপ্রেমিক মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল হিসেবে অপরাজনীতি-জঙ্গীজেহাদী-যুদ্ধাপরাধীদের বর্জন করে পৃথিবীর অন্য দেশের বিরোধী দলের মতো রাজনীতি করতে পারত। তারেকের অপকৌশলের অপরাজনীতি মানতে গিয়ে নির্বাচন কমিশন এবং নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা চেষ্টা না চালিয়ে প্রকৃত ভোটের জন্য রাজনীতি চর্চা বিএনপির জন্য প্রয়োজন ছিল। এটা ঠিক জিয়া, খালেদা, তারেক এরা- ভোটের রাজনীতিকে চিরকাল অপছন্দ করেছে। তারা সব সময় সেনাবাহিনী বা শক্তি প্রয়োগ করে ক্ষমতায় গেছে এবং সেই স্বৈর পদ্ধতিতেই তারা আস্থাশীল। সম্ভব হলে তারা এখন ’৭৩, ’৭৪, ’৭৫-এর মতো বঙ্গবন্ধু কন্যা ও তাদের স্বজনদের চরিত্র হননের কল্পকাহিনী তৈরি করায় মেতে উঠত। কিন্তু জনগণের সৌভাগ্য, এখন ২০২০-২১-এ দেশকে সব ক্ষেত্রে যখন বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পথে বঙ্গবন্ধু কন্যা পরিচালিত করে গৌরবময় সফলতা অর্জন করেছেন, যখন মনুষ সরকারের কাছ থেকে সবরকম সেবা সহজে লাভ করে জীবন মান উন্নয়ন করছে, তখন নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জনগণ তাদের স্বার্থেই ভোট দেবে। বিএনপি প্রার্থীকে কেন ভোট দেবে? এখন তারেকের শেখানো বুলি, ভোট আগেই হয়ে গেছে, বিএনপিপন্থী ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে যেতে দেয়া হয়নি, কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, পোলিং এজেন্টকে বের করে দেয়া হয়েছে- এই সব অভিযোগ বারবার করতে করতে অভিযোগগুলোর ধার মুছে গেছে। এখন আওয়ামী লীগকে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনে ঠেলে দিতে তারেক নির্দেশ দিয়েছে। তাই এখন সুযোগ এসেছে জাতীয় পার্টির। সরকার জাতীয় পার্টিকে, এমনকি বিশেষ বিশেষ ইউনিয়নে সিপিবি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির বেশ কিছু স্থানীয় ভাল নেতাকে ছাড় দিয়ে রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করতে পারে। আমার মনে হয়, এতে নির্বাচন গুণ্ডামি মুক্ত হবে এবং শেষে জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে। যা হোক, আমার বক্তব্য হচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়েকশ’ মৌলবাদী জেহাদী ঘৃণা প্রচারকের গ্রেফতার হওয়ার কথা। এরপর জঙ্গীরা গ্রেফতার হবে যারা নিরীহ মানুষ হত্যা করে বেহেশতে যাবার অলীক স্বপ্ন প্রচার করছে। তাছাড়া পর্নো ছবি তৈরি, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য যারা ছড়াচ্ছে, তাদের গ্রেফতার করতে হবে। মুশতাক আহমদ তো দেশে কুমির প্রজনন কেন্দ্রটির প্রথম উদ্ভাবক-প্রতিষ্ঠাতা, যেটি পরে তার হাত ছাড়া হয়ে যায়। জানতে পেরেছি, খুবই অমায়িক সজ্জন মানুষ, তার দ্বারা কোন ঘৃণা প্রচারণা মন্তব্য যারা তাকে চেনেন তারা বলেন- অসম্ভব। সরকারের কাজ বা নীতির বিরোধী সমালোচনা-মন্তব্য করার অধিকার সবার আছে। সরকারবিরোধী মন্তব্য কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। গত কদিন আগেই তো ভারতের একটি উচ্চ আদালত এ রায় দিয়েছে যা উরংংবহঃ এবং ঝবফরঃরড়হ এর পার্থক্যকে খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছে। আর কার্টুন তো চিত্রশিল্পের একটি বিভাগ। যে যত বুদ্ধিদীপ্ত কার্টুন আঁকতে পারে, সে তত বিমূর্ত চিন্তায় পারদর্শী। পুরো বিশ্ব ‘টম এ্যান্ড জেরী’ বা ‘মিঃ বিন’ কে উপভোগ করে। আমার এ মুহূর্তে মনে পড়ছে একটি অতি সুন্দর কার্টুন, এটা ’৯৬-এর সম্ভবত। কার্টুনের এক চরিত্র শেখ হাসিনা নৌকা বোঝাই করে ধান নিয়ে যাচ্ছেন, আর তীরে দাঁড়িয়ে বেজার মুখে খালেদা জিয়া হতাশ হয়ে বসে আছে! অতি সুন্দর কার্টুন, কোন বাক্য ব্যয় না করে ’৯৬ এর নির্বাচনে শেখ হাসিনার জয়কে প্রকাশ করেছেন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য। এখনো চোখে ভাসে কার্টুনটি। জাতিকে বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে সমালোচনার উর্ধে রাখতে হবে। এটি রাষ্ট্রীয় নীতি। এটি কেউ ভাংবে না, ভাংলে শাস্তি পেতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের প্রধান সমালোচনার উর্ধে থাকবেন। অন্য সবাই সরকার থেকে শুরু করে মন্ত্রী-সাংসদ, স্থানীয় নেতা, ব্যবসায়ী, সব শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্তিসঙ্গত সমালোচনার পাত্র। সব দেশে সরকার প্রধানেরা কার্টুনিস্টদের লক্ষ্যবস্তু হন- এটি বিশেষ করে র‌্যাব-পুলিশকে জানতে হবে। এবার শোনা যাচ্ছে, কোন অপরাধের আগে তদন্ত হবে, তদন্তের আগে গ্রেফতার করা যাবে না- এমন একটি নীতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সংযুক্ত হবে, যা আমাদের আশ্বস্ত করেছে। তবে, ছয়বার জামিন আবেদন বাতিল, বিচারহীন দশ মাস জেলে আটক- এসব তো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লঙ্ঘন। সেগুলোর জন্য দায়ী-দোষীদের বিচার নিশ্চয় হবে। তাছাড়া দৈহিক নির্যাতন যার বর্ণনা পড়ে আশ্চর্য হচ্ছি কেননা জঙ্গীদেরও দৈহিক নির্যাতন করার কোন ঘটনা শুনিনি। খুনী-দাঙ্গাবাজ ডাকাতদের মতোই কি শিক্ষিত, শুধু সরকারের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারীর ওপর দৈহিক নির্যাতন, হ্যান্ডকাফ, হাত বাঁধা, চোখ বাঁধা, মারধর এসব করা যায়? এতে অঙ্গহানি হলে চিকিৎসাও হবে না? যাদের অঙ্গ হানি হয়েছে, সরকার তাদের ক্ষতি পূরণ দেবে তো? আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি- উরংংবহঃ কখনোই ঝবফরঃরড়হ নয়। ভিন্ন মত আর রাষ্ট্রদ্রোহ এক নয়। সবশেষে, দেশের রাজনীতিকে স্বচ্ছ, দেশপ্রেম ভিত্তিক করে দেশকে শত্রুমুক্ত করার সময় এসেছে। খুবই উল্লেখযোগ্য তথ্য জানলাম যে, শিক্ষাকে মুখস্থ বিদ্যার হাত থেকে রক্ষা করে প্রকৃত শিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে নাকি শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি করে কাজ শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে আমরা ’৮০ এর দশকে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেছিলাম এবং সক্রিয় শিখনের জন্য নানারকম কাজ করে শেখার মতো পাঠ্যবই রচনা করেছিলাম। শিক্ষক প্রশিক্ষণও হয়েছিল বছরব্যাপী। ঐ সময় প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীতে নমনীয় প্রমোশন নীতি এবং ধারাবাহিক মূল্যায়ন এর কৌশলও প্রণীত হয়। শিশু শ্রেণীকে আইনী ভিত্তি দেয়া হয়। কথা হচ্ছে, এসব কিছুর লক্ষ্য কিন্তু শিক্ষার্থীর নিজস্ব চিন্তা করার দক্ষতা আয়ত্ত করা, অর্থাৎ ঈৎরঃরপধষ ঃযরহশরহম ংশরষষ মানে সমালোচনামূলক ব্যাখ্যা, দোষত্রুটি, ভাল-মন্দ শনাক্ত করতে পারার দক্ষতা যা সবশেষে শিক্ষার্থীর নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সম্ভব করবে। এতে অস্বস্তি লাগার কিছু নেই। এটিই শিক্ষার্থীদের শিক্ষার গন্তব্য। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা পাঠ্য বিষয় পাঠ করে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা ব্যবহার করে সেই ভাবনা প্রকাশের দক্ষতা অর্জন করবে। লেখক : শিক্ষাবিদ
×