ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

বাল্যবিয়ে বন্ধ হলে নারী নির্যাতন কমবে

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাল্যবিয়ে বন্ধ হলে নারী নির্যাতন কমবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বাল্যবিয়ে বন্ধ হলে নারী নির্যাতনের হার কমে যাবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা।“বাল্যবিয়ের কারণ, প্রভাব ও প্রতিরোধের উপায়” নিয়ে ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলায় ইউনিসেফ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় বুধবার ভোলার চরফ্যাশনে এক এ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বাল্যবিয়ে নিয়ে কোস্ট ট্রাস্ট কর্তৃক পরিচালিত গবেষণার তথ্যসমূহ উপস্থাপন করেন গবেষক ইকবাল উদ্দিন। গবেষণায় মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতাকে বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। কোস্ট ট্রাস্টের সহকারি পরিচালক রাশিদা বেগমের সঞ্চালনায় এ সভার সভাপতি ছিলেন চরফ্যাশন উপজেলা মহিলা ও শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। প্রধান অতিথি ছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন আখন। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আকলিমা বেগম লিলি, উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মামুন হোসেন ও উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) রিপন বিশ্বাস। শুভেচ্ছ বক্তব্য প্রদান করেন প্রকল্প ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান। জয়নাল আবেদিন আখন বলেন, কাজী-ইমামদের সচেতনতাই বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে পারে। তিনি কাজীর নমিনিদের মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা বন্ধ করতে আহবান জানান। আকলিমা বেগম লিলি বলেন, বাল্যবিয়ের শিকার নারীরা ঠিক মতো সংসার সামলাতে পারে না। তাই অনেক সময় তাদের প্রতি নির্যাতন হয়। বাল্যবিয়ে বন্ধ হলে নারীর প্রতি নির্যাতনের হার অনেক কমে যাবে। রিপন বিশ্বাস বলেন বাল্যবিয়ে বন্ধে গ্রামে গ্রামে উঠান বৈঠক করতে হবে এবং স্কুলগুলোতে মেয়েদের নিয়ে সচেতনতা সভা করতে হবে। রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন বাল্যবিয়ের শিকার নারীদের উপর নির্যাতনের কারণে অধিকাংশ মামলা হয়। বাল্যবিয়ে বন্ধ হলে এ মামলার হার কমে যাবে। গবেষণায় জেলার প্রতিটি উপজেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। উত্তরদাতাদের মধ্যে নারী ছিলেন ৫৭.১ শতাংশ এবং পুরুষ ৪২.৯ শতাংশ। কেন ভোলায় বাল্যবিয়ের হার বেশি এবং জীবনে এর প্রভাব জানতে কোস্ট ট্রাস্ট ২৫ অক্টোবর-৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ এই গবেষণা করে। গবেষণায় দেখা যায়, বাল্যবিয়ের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে প্রেম-ভালোবাসাকে দায়ী বলে মনে করেন ৬৩.৬ শতাংশ উত্তরদাতা। এর সাথে নিরাপত্তাজনিত কারণও জড়িত বলে জানান ৪১.৬ শতাংশ। এছাড়া ছেলে-মেয়েরা যে কোন সময় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে তাই পারিবারিক সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া হয় বলে মত দেন ৪১ শতাংশ। ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দেয়া হয় বলে মনে করেন ৪৭.৮ শতাংশ। অসচেতনতার কথা বলেছেন ৪৪.৯ শতাংশ এবং দারিদ্র্যতা এর কারণ বলে উল্লেখ করেছেন ৫০.৯ শতাংশ উত্তরদাতা। গবেষণায় দেখা গেছে যে ৩৭.৮ শতাংশ উত্তরদাতরই ধারণা নেই ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু আর ১৫-১৭ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে হওয়াকে অনেকই শিশু বিয়ে বলে মানতে নারাজ। তাছাড়া শিশুবিয়ে দিলেও পিতা-মাতা বা আত্মীয়-স্বজন প্রকাশ্যে সেটি স্বীকার করতে চান না। বাল্যবিয়ে বৃদ্ধির ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব আছে বলেছেন ২১.৭ শতাংশ, নাই বলেছেন ৩৯.৫ শতাংশ এবং জানি না বলেছেন ৩৮.৭ শতাংশ উত্তরদাতা। দরিদ্র পরিবারগুলোতে বাল্যবিয়ের হার বেশি বলে মত দিয়েছেন ৭৬.৪ শতাংশ উত্তরদাতা। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশি বলেছেন ২৯.১ শতাংশ এবং ধনী পরিবারে বেশি বলেছেন ২.৩ শতাংশ উত্তরদাতা। আর শিক্ষার ধাপ বিবেচনায় দেখা গেছে ৫ম শ্রেণি শেষ করার পর মেয়ে শিশুদের বিয়ে হয়ে যায় বলেছেন ১৯.১ শতাংশ উত্তরদাতা। ৮ম শ্রেণি শেষ করার পর হয় বলেছেন ৬৭.৩ শতাংশ। মাধ্যমিক শেষ করার পর হয় বলেছেন ১০ শতাংশ এবং উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করার পর হয় বলেছেন ১.৩ শতাংশ। বিয়ের ক্ষেত্রে অধিকাংশ মানুষই যৌতুক দেয়/নেয় বলে মত দিয়েছেন ৬০ শতাংশ উত্তরদাতা। এলাকায় বাল্যবিয়ে হলে তা প্রতিরোধ করেন বলে জানিয়েছেন ২৭.৯ শতাংশ উত্তরদাতা, করেন না বলেছেন ৪১ শতাংশ, কখনও কখনও করেন বলেছেন ২৪.৩ শতাংশ এবং অন্যরা করে যেমন পুলিশ, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির লোকজন ইত্যাদি বলেছেন ৬.৮ শতাংশ। এছাড়া স্থানীয় মেম্বার- চেয়ারম্যানরা শিশু বিয়ে প্রতিরোধে ভালো ভূমিকা রাখেন বলেছেন ২৫.৯ শতাংশ, মাঝে মাঝে ভূমিকা রাখেন বলেছেন ৪০.৮ শতাংশ, কোন ভূমিকা রাখেন না বলেছেন ১৩.৪ শতাংশ এবং তারা ভোটের হিসেব করেন বলেছেন ৮.৯ শতাংশ উত্তরদাতা। এছাড়া শিশুবিয়ে বন্ধে সরকারি হটলাইন নাম্বারের কথাও জানেন না বলেছেন ৫৪.৫ শতাংশ উত্তরদাতা। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি গুরুত্বারোপ করে আরো কয়েকটি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো: ইউনিয়ন পরিষদকে বাল্যবিয়ে বন্ধে আরো সক্রিয় করা, গ্রামে গ্রামে কমিটি গঠন করা । মেয়েদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। করোনাকালীন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিদ্যালয়গুলো সীমিত আকারে খুলে দেয়া। মেয়েদের শিক্ষার প্রসারে মাধ্যমিক স্তরে ৮০ শতাংশ মেয়েকে উপবৃত্তির আওতায় আনা। উপবৃত্তির অর্থ খুব সামান্য, এটি বৃদ্ধি করা। বাল্যবিয়ে বন্ধে হটলাইন নাম্বারগুলো সকলকে জানানো। ভূয়া জন্ম নিবন্ধন রোধ করা। কাজী, ইমাম, পুরোহিতদের বাল্যবিয়ে না পড়ানো ইত্যাদি। সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়াদুদ মিয়া, মোঃ সিরাজ উদ্দীন, মোঃ জামাল উদ্দীন, আশরাফুল আলম, আব্দুস সালাম হাওলাদার, মোঃ হোসেন মিয়া। আরো ছিলেন খালেদা বেগম, মোঃ মনির হোসেন, জামাল উদ্দীন, মিনহাজুল ইসলাম, আব্দুল মানড়বান, সিপু ফরাজি, সামছুন নহার প্রমুখ।
×