রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডি ২৭ নম্বর সড়কে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে চলছে পয়ঃনিষ্কাশন নালার কাজ। কাজটি পুরোপুরি শেষ না হলেও এই সড়ক দিয়েই গাড়ি চলাচল করছে। তাই শীতের এই সময়টাতে ধুলায় আচ্ছন্ন থাকে আশপাশের এলাকা। ধুলায় ঢেকে গেছে সড়কের পাশে থাকা গাছের পাতাও। অথচ কাজটি কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি। যত গাড়ি বাড়ছে তত বাড়ছে ধুলার মাত্রাও!
এবার আসা যাক কমলাপুর রেল স্টেশন এলাকা থেকে পীরজঙ্গী মাজার রোড পর্যন্ত সড়কে। গত কয়েক মাস আগে এই সড়কে একটি সেবা সংস্থা কাজ করেছিল। এখন রাস্তার ওপর জমে আছে বালু। সংস্কার হয়নি পুরো রাস্তাটি। দুই লেনের সড়কের একটি লেন ভাঙ্গাচোরা অবস্থা। সড়কটি যেন সারাক্ষণেই ধুলায় আচ্ছন্ন। দিনের পর দিন বাতাসে মিশে যাওয়া ধুলার কারণে রাস্তার দু’পাশে থাকা গাছপালার সবুজ হারিয়ে ধূসর রং ধারণ করেছে।
শান্তিনগর থেকে বাজারবাগ মোড় পর্যন্ত সড়কটি দূর থেকে একেবারেই অন্যরকম। এখানে ধুলা মিশ্রিত ঘন বাতাস। দূর থেকে মনে হবে কুয়াশা ঢাকা সড়ক। কিন্তু কাছে গেলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়। দেখা যায়, সড়কের কিছু স্থানে একটি সেবা সংস্থা কয়েক মাস আগে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ করেছিল। সেসব অংশ পাকা হয়নি। কয়েকটি স্থানে জমিয়ে রাখা মাটি থেকে আরো বেশি ধুলার সৃষ্টি হয়েছে।
একই অবস্থা রাজধানীর মতিঝিল এলাকার সেনা কল্যাণ সংস্থার সামনে থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আসা সড়কটির। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ছয় মাসের বেশি চলছে ধুলার দুর্ভোগ। রাস্তাটি কবে সংস্কার করা হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেননি।
শাহবাগ মোড়ে যেখানে রয়েছে দুটি বড় হাসপাতাল, গুরুতর রোগীদের ভিড়। এখানে শব্দের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা নেই। রাস্তা পারাপারে সাধারণ মানুষকে কানে হাত দিয়ে চলতে দেখা যায়। প্রশ্ন উঠতেই পারে ভেতরে থাকা রোগীদের অবস্থা আসলে কী। শহরজুড়ে খোলা খাবার বিক্রি হচ্ছে দেদার। দূষিত এই খাদ্য মানবদেহে নানা রকম প্রভাব ফেলছে।
রাজধানী ঢাকা ঘুরলে দূষণের এরকম অনেক চিত্র চোখে পড়বে। পরিবেশ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় দুই কোটি মানুষের এই রাজধানী শহরে অন্তত ৩০ রকমের দূষণ চলছে ভয়াবহ মাত্রায়।
বাতাসের মান যাচাইকারী আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে চলতি মাসের প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা দূষণের শীর্ষে উঠে আসছে। দূষণের মাত্রা এত বেশি যে সেটাকে ‘দুর্যোগপূর্ণ’ বলা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’-এর বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী, ২১ জানুয়ারি সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত গড়ে ঢাকা প্রথম অবস্থানে ছিল এবং দূষণের সূচক ৩২৬ পর্যন্ত উঠেছিল। এর আগের দিনও সকাল ৯টায় শীর্ষে ছিল ঢাকা। একই অবস্থা ছিল ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকেও।
বায়ু বিশেষজ্ঞদের মতে, সূচক ৩২৬ মানেই দুর্যোগপূর্ণ। এখনই দূষণ কমাতে পদক্ষেপ না নেয়া হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার নিতে পারে বলেও সতর্ক করেছেন তারা। তবে পরিস্থতির দৃশ্যমান কোন উন্নতি হচ্ছে না। অনেকে বলছেন, সমন্বয়হীনতা ও রাজনৈতিকসহ প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের কারণেই দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রয়োগ করা যাচ্ছে না আইনও। এসব বিষয় সঙ্কটের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সিটি কর্পোরেশনের নতুন নিয়ম অনুযায়ী সন্ধ্যার পর পরই শুরু হয় রাস্তাঘাট পরিষ্কারের কাজ। এতে শহরে দূষণের মাত্রা ও আক্রান্তের সংখ্যা বেশি বাড়ছে। কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় শুরু হয় পরিচ্ছন্ন অভিযান। বড় সড়ক থেকে অলিগলি পর্যন্ত এ কাজ চলায় ধুলার শিকার হতে হয় অফিস থেকে বাসা পৌঁছানো পর্যন্ত।
৩০ রকমের দূষণ নগরে ॥ পরিবেশ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বায়ুদূষণের জন্য ৩০টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণগুলো হচ্ছে, ইটভাঁটি, রাস্তা নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও মেরামত, সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বড় উন্নয়ন প্রকল্প (এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু, মাটি, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, ইটভাঁটির ধোঁয়া, রাস্তায় গৃহস্থালি ও পৌর বর্জ্য স্তুপাকারে রাখা ও বর্জ্য পোড়ানো, ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা অনাবৃত স্থান, ফুটপাথ ও রাস্তার আইল্যান্ডের মাঝের ভাঙ্গা অংশের মাটি ও ধুলা, ফিটনেসবিহীন পরিবহন থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়া, বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারী কলোনির ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, বিভিন্ন মার্কেট, শপিংমল ও বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলে দেয়া, ঢাকা শহরের দূষণপ্রবণ এলাকার ধুলা, হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার ও জনসচেতনতার অভাব।
এর বাইরেও আছে শব্দ দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য দূষণ, উৎপাদনের সময় খাদ্যে ভেজাল মিশানো, উচ্চ মাত্রায় মাইকের ব্যবহার, আলোর দূষণ, মানব বর্জ্য, নির্মাণ কাজে দূষণ ছাড়াও নানা রকম দূষণের চিত্র এখন নগরজুড়ে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ইটভাঁটি বন্ধে অভিযান চলছে। এরপরের অনেক কারণ নিয়ে আমরা সিটি কর্পোরেশন ও বিআরটিএ’র সঙ্গে আলোচনা করেছি। সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে রাস্তার পাশে ময়লা রাখা, ঝাড়ু দেয়া, নির্মাণাধীন ভবনের ময়লা, হাসপাতালের বর্জ্যসহ যাবতীয় আবর্জনা সরানো ও পরিষ্কারের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা আমাদের জানিয়েছে নিয়মিত মনিটরিং করছে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) এবং মেট্রোরেল প্রকল্পকে নিজস্ব উদ্যোগে পানি ছিটানোর অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি যেসব যানবাহন দূষণের জন্য দায়ী সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিআরটিএ’কে বারবার বলছি। আমরা আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-এর যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘কী কী কারণে দূষণ বাড়ছে তা আমরা বিভিন্ন সময়ে জানাচ্ছি। কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তাও বলছি। মন্ত্রণালয়ের সবাই জানে এগুলো। এখন আসল কাজ হচ্ছে দূষণ নিয়ন্ত্রণে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো আদৌ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা মনিটরিং করা। দীর্ঘমেয়াদে যে দূষণের ক্ষতি অনেক বেশি এটা সরকারকে বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ডা. আব্দুল মতিন বলেন, দূষণ কেন হয়, কীভাবে হয়, কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে তা সবাই জানে। তবে শুধু মুখে বললে তো হবে না। এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনও কাজ দেখতে পাই না। মাঝে মাঝে দুয়েকটা অভিযান পরিচালনা করে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। দরকার অনেক বেশি অভিযান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে জানা যায়, বর্তমানে বিশ্বের হাজারো শহর সংস্থাটির স্বাস্থ্যসম্মত শহর নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত। সবশেষে মদিনা শহরটি এই সংস্থাটির স্বীকৃতি পায় বলে সৌদি আরবের সরকারি সংবাদ মাধ্যমের খবরে বলা হয়। এই নেটওয়ার্কের আওতায় শহরগুলোর মেয়র এবং মিউনিসিপ্যালিটি শহরের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
অন্যদিকে বিশ্বের অনেক নেতিবাচকের তালিকায় রয়েছে রাজধানী ঢাকা, যেটির জনঘনত্ব রেকর্ড পরিমাণ। ঢাকার দূষণ নিয়েও কথা হয় নানা সময়ে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছেন, এত বিশাল সংখ্যক মানুষের বাস যে শহরে সেটিকে স্বাস্থ্যসম্মত করে গড়ে তুলতে হলে মহা-পরিকল্পনা দরকার। তিনি প্রতিকারমূলক ও প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দিয়েছেন। তবে ঢাকাকে মদিনার মতো স্বাস্থ্যসম্মত শহরে পরিণত করার জন্য মোটা দাগে ৫টি সমস্যা সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছেন তিনি। বলেন, বায়ু দূষণ- ধুলাবালি, ধোঁয়া ইত্যাদির কারণে ঢাকার বাতাসকে অত্যন্ত দূষিত বলে ধরা হয়। শহরের মধ্যে সারা বছরই নানা ধরনের নির্মাণ কাজ এবং যানবাহন চলাচল করার কারণে বায়ু দূষণ বেশি।
তবে এই দূষণ দূর করা সহজসাধ্য নয় বলে মনে করেন তিনি। কারণ একদিকে যেমন চাইলেই নির্মাণ কাজ বন্ধ করা যায় না, ঠিক তেমনি নির্মাণ কাজ করলেও ধুলা উড়বে না এমন কোন প্রযুক্তিও সহজলভ্য নয়। আর দূষিত বাতাসের কারণে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পানি দূষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজধানী চারদিকের যে পানির উৎস রয়েছে সেগুলো একদিকে যেমন দূষিত, অন্যদিকে এই জলাশয়গুলো নানা ধরনের রোগ-বালাই ছড়িয়ে পড়ে। যার মধ্যে পানিবাহিত নানা রোগ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মশা, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বিস্তার। তবে এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য বলে মনে করেন তিনি।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে এই নগর বিশেষজ্ঞ বলেন, বর্জ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা অনেক পুরনো। যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করেন তাদের যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোন ব্যবস্থা নেই, ঠিক তেমনি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয় যত্রতত্র। পচনশীল, কঠিন কিংবা নবায়নযোগ্য বর্জ্য আলাদাভাবে ব্যবস্থাপনার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয় না।
সবুজ পরিবেশ নিয়ে তিনি বলেন, মানুষের শারীরিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন ব্যায়াম বা হাঁটার জন্য সবুজ পরিবেশ যেমন পার্ক, ফুটপাথ থাকার নিয়ম থাকলেও ঢাকায় এর ব্যবস্থা খুবই কম। শব্দ দূষণ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের নীতিমালা থাকলেও সেগুলোর প্রয়োগ নেই। যার কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।
ডাব্লিউএইচও বলছে, স্বাস্থ্যসম্মত শহর শুধু একটি শহরের স্বাস্থ্যসেবার কাঠামোর ওপর নির্ভর করে না। বরং শহরটির পরিবেশের উন্নয়নের অঙ্গীকার এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের আগ্রহের ওপরও নির্ভর করে। স্বাস্থ্যসম্মত শহরের এই ধারণা স্বাস্থ্য ও সেবার সমতা নিশ্চিতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণমূলক শাসনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
ঢাকার বায়ুর গুণগতমান খারাপ হওয়ায় সরকার বায়ু দূষণের মাত্রা কমাতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মেগা সিটির বায়ু দূষণ কমাতে সরকারের এই পদক্ষেপের কথা জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন।
তিনি বলেন, সড়ক, বিল্ডিং ও মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণ কাজের ফলে সৃষ্ট বায়ু দূষণের মাত্রা কমাতে কিছু নির্দেশনাসহ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সরকার দুই সিটি কর্পোরেশনকে নগরীর সড়কগুলোতে নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছে। ঢাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ইটভাঁটি, রাস্তা নির্মাণ, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্যও বায়ু দূষণের জন্য দায়ী।
শাহাব উদ্দিন বলেন, অনেক বিল্ডিং রাস্তার পাশে নির্মাণ সামগ্রী রেখে তৈরি করা হচ্ছে, যা ধুলাবালির অন্যতম প্রধান উৎস। উন্নত দেশগুলোতে, দূষণ কমাতে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে নির্মাণ কাজ করা হয়। একই নিয়ম বাংলাদেশে থাকলেও কেউ সেটি অনুসরণ করছে না।
তিনি বলেন, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানসমূহ নির্মাণ সামগ্রী অর্থাৎ মাটি ও বালি পরিবহনের সময় এগুলোর একটি অংশ রাস্তার ফেলে যাচ্ছে যা পরবর্তীতে বায়ু দূষণের জন্য বিশেষভাবে ভূমিকা রাখছে। যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা নিক্ষেপ, ড্রেন পরিষ্কার করে ময়লা ড্রেনের পাশে দীর্ঘদিন স্তূপীরণের ফলেও বায়ুু দূষণের সৃষ্টি হচ্ছে।
বায়ু দূষণ এড়াতে ছোট বড় প্রতিটি প্রকল্প কাজে পরিবেশ মেনে চলা উচিত। কাজগুলো এমনভাবে করতে হবে যাতে পরিবেশ দূষণ না হয়। আমরা বায়ু দূষণ রোধে শক্ত অবস্থানে আছি। কোথাও যাতে বায়ু দূষণ না হয় সে বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি বলেন, বায়ু দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতর ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর ও শিল্পঘন শহরে সার্বক্ষণিক বায়ুর গুণগতমান পরিমাপ করা হচ্ছে। এতে দেখা যায় শুস্ক মৌসুমে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। বেশির ভাগ বায়ু দূষণ হয় ঢাকার চারপাশে ইটভাঁটির জন্য। আইনের আওতায় পরিবেশ অধিদফতর দেশে বিদ্যমান ইটভাঁটিগুলোকে জ্বালানি সাশ্রয় ও পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করতে কাজ শুরু করেছে।
তিন ধরনের দূষণ বেশি ॥ দেশে বায়ু দূষণের উৎস নিয়ে গত বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদফতর ও বিশ্ব ব্যাংক। তাতে দেখা যায় যে বায়ু দূষণের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে ইটভাঁটি, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও নির্মাণ কাজ।
বায়ু দূষণের প্রভাব ॥ বায়ু দূষণ প্রকৃতি এবং মানুষের স্বাস্থ্য উভয়ের ওপরই খুব নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা, এ্যালার্জি, হাঁপানির আক্রমণ, কনজাংটিভাইটিস, ব্রঙ্কিয়াল রোগ, ফুসফুস বা ত্বকের ক্যান্সার, দৃষ্টি সমস্যা, শিশুর মানসিক বিকাশে রক্তের সমস্যা, গর্ভবতী মহিলা, শিশু এবং বয়স্ক মহিলারা বায়ু দূষণে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকে ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত শব্দ-দূষণের মাত্রা ৪০-৫০ ডেসিবল হলেও ঢাকা শহরের অনেক রাস্তায় ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবল। কোনো কোনো স্থানে ১১০ ডেসিবলের চেয়ে বেশি যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। পরিবেশ অধিদফতরের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে শব্দের মাত্রা ১৩০ ডেসিবল ছাড়িয়ে গেছে, যা স্বাভাবিকের তুলনায় আড়াই থেকে তিনগুণ বেশি।
শব্দের ভয়াবহতা ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনে ৫৫ ডেসিবল, রাতে ৪৫ ডেসিবল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ৬৫ আর রাতে ৫৫ ডেসিবল; শিল্পাঞ্চলে দিনে ৭৫ ডেসিবল আর রাতে ৬৫ ডেসিবলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। অন্যদিকে হাসপাতাল বা নীরব এলাকায় দিনে ৫০ আর রাতে ৪০ ডেসিবল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত।
বেসরকারী সংস্থা ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ’ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দ পরিমাপ করে দেখেছে। ঢাকায় নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে প্রায় দেড়গুণ বেশি শব্দ সৃষ্টি হয়। জরিপে দেখা গেছে, উত্তরার শাহজালাল এভিনিউতে শব্দ মাত্রা সর্বোচ্চ ৯৩ দশমিক ৫ ডেসিবল, মিরপুর ১-এ সর্বোচ্চ ৯৬ ডেসিবল, পল্লবীতে সর্বোচ্চ ৯১ দশমিক ৫ ডেসিবল, ধানমণ্ডি বালক বিদ্যালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ডেসিবল, ধানমণ্ডি ৫ নম্বর সড়কে সর্বোচ্চ ৯৫ দশমিক ৫, নিউমার্কেটের সামনে ১০৫ দশমিক ১, শাহবাগে সর্বোচ্চ ৯৭ দশমিক ৩ এবং সচিবালয়ের সামনে সর্বোচ্চ ৮৮ ডেসিবল। অর্থাৎ ঢাকা শহরের গড় শব্দমাত্রা ১০০ ডেসিবল যা খুবই আতঙ্কজনক।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ-দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালায় সুস্পষ্ট করে আবাসিক, মিশ্র, বাণিজ্যিক ও শিল্প এলাকা চিহ্নিত করে শব্দের মানমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিধি অনুযায়ী হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপাসনালয়ের সামনে এবং আবাসিক এলাকায় হর্ন বাজানো, মাইকিং করা, সেই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে জোরে শব্দ সৃষ্টি করা আইনত দণ্ডনীয়। এই আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এই আইনের তেমন কোনো প্রয়োগ জনসম্মুখে লক্ষ্য করা যায় না।
সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল, বারডেমসহ দেশের সকল হাসপাতালের আশপাশের রাস্তায় শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদের কাছে খোলা চিঠি লিখেছেন বরেণ্য চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য কামরুল হাসান লিখেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে শাহবাগ চত্বর থেকে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল মোড় পর্যন্ত এবং পর্যায় ক্রমে সারাদেশের সব হাসপাতালের আশপাশের রাস্তায় শব্দ নিয়ন্ত্রণে সম্মানিত আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদের কাছে খোলা চিঠি’। এতে বলা হয় ... আপনি নিশ্চয় জানেন, শাহবাগস্থ দেশের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতাল এবং বারডেম হাসপাতালে প্রচুর রোগী ভর্তি থাকে সারা বছর। অথচ দুঃখের বিষয়, রাস্তায় চলাচলরত যানবাহন ও হর্নের শব্দের জন্য প্রতিটি রোগীকে চব্বিশ ঘণ্টাই বিকট শব্দের শিকার হতে হয়। অথচ অসুস্থতাবস্থায় রোগীর ভালো ঘুমের দরকার’।
নিদ্রাহীনতা অসুস্থতা আরও বাড়িয়ে দেয় একথা উল্লেখ করে খোলা চিঠিতে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই উপাচার্য লিখেছেন, ‘তাছাড়া রোগীরা এমনিতেই মানসিকভাবে পর্যুদস্ত থাকে। এর মধ্যে কান ফাটানো ভয়ঙ্কর শব্দে সব রোগী আরও অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে।
...খোলা চিঠিতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়নের যুগে যান চলাচল আরও বৃদ্ধি পাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এত বড় দুটো হাসপাতালের আশপাশে শব্দদূষণ রোগীদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই শব্দদূষণ থেকে দেশবাসীকে তথা রোগীদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে আপনার জরুরী দৃষ্টি কামনা করছি। আশাকরি, আপনার বিশেষ উদ্যোগে এবার জরুরী গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্যার সমাধান হবে। আপনি অবিলম্বে শাহবাগ এলাকাসহ দেশের সকল হাসপাতালের আশপাশের সড়কগুলোতে শব্দ নিয়ন্ত্রণের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বাধিত করুন।
তার খোলা চিঠির প্রেক্ষিতে অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ বলেন, ...বধিরতা প্রতিরোধ -ঝঐ ২০৩০ নামে বাংলাদেশে আমার শুরু করা একটি প্রকল্প বাস্থবায়নাধীন অবস্থায় পড়ে আছে যা দেখার জন্য কারো গরজ নাই। ২০০৩ সাল থেকে চেষ্টা করে ২০১১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগিতায় চৎবাবহঃরড়হ ড়ভ উবধভহবংং-ঝঐ ২০৩০ ঝঃৎধঃবমু ফড়পঁসবহঃং তৈরি করি যা বাস্তবায়নের জন্য এপেক্স বডি হিসেবে ইএনটি ইনস্টিটিউটের জন্ম হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রতিষ্ঠানটি শুধু একটি হাসপাতাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে বধিরতা প্রতিরোধ সংক্রান্ত কোন কাজ করছে না।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ কর্মী ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি আমেরিকার ল্যাবে পরীক্ষার পর ওয়াসার পানিতে বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। তার মানে হলো এই শহরের পানিতে দূষণ থাকছে। বাতাসে বায়ুমান অনেক সময় বিশে^র মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে। সড়কের চারপাশে পরিচ্ছন্নতার অভাবে দূষণ তো আছেই। হাসপাতাল, স্কুল, আবাসিক এলাকা থেকে শুরু করে সবখানেই শব্দের ভয়াবহতা।
তিনি বলেন, আলোর দূষণের কারণে মানুষের ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে। বিষাক্ত আবর্জনার কারণে দূষিত হচ্ছে মাটিও। নষ্ট হচ্ছে ভূমির জীবন। নদী ও জল দূষণ মিশ্রিত খাদ্য আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। খাদ্যে নির্বিচারে মিশানো হচ্ছে কীটনাশক। অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারে ২০১৭ সালে দেখা গেছে ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া রোগীদের ৬৪ ভাগই কৃষক ভয়াবহ এই রোগে আক্রান্ত। তিনি বলেন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য বাতাস, পানি খাদ্য সবই দূষণের মধ্যে রয়েছে। দূষণ দূর করা না গেলে অসুখ বাড়বে। গড় আয়ু বাড়লেও জীবন মান নিচে নেমে আসবে। বাড়বে অসুস্থতার গড়।