ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ৬ পৌষ ১৪৩১

নওগাঁয় বিলুপ্তির পথে ঐতিহাসিক নিদর্শন

মসজিদ মঠ পাশাপাশি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

মসজিদ মঠ পাশাপাশি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

বিশ্বজিৎ মনি ॥ মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি নওগাঁর আত্রাইয়ের তিন গুম্বুজ মসজিদ ও মঠ আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। পুরনো এ মসজিদ ও মঠের স্থাপত্যরীতিতে মোগল ভাবধারার ছাপ সুস্পষ্ট। সৃষ্টি আর ধ্বংসে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। কেউ সৃষ্টিতে আবার কেউ ধ্বংসের খেলায় মত্ত। আবার কারোর দায়িত্বহীনতায় কালের গহব্বরে সমাহিত হচ্ছে ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো। বর্তমান যেমন গুরুত্ববহ সোনালি অতীতও তেমনি অনুপ্রেরণা যোগায়। আমরা বাঙালী, আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক অতীত। বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। এসব ছড়িয়ে থাকা ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত স্থানসমূহ আমাদের সত্তাতে আলোড়ন জাগায়। তেমনি আলোড়ন জাগানো ঐতিহাসিক অতীতবহুল স্থান নওগাঁ জেলাধীন আত্রাই উপজেলার ইসলামগাঁথী গ্রামে অবস্থিত তিন গুম্বুজ মসজিদ ও মঠ। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পূর্বদিকে ঐতিহাসিক গুড়নদীর তীরে গ্রামটি অবস্থিত। ৫নং বিশা ইউনিয়নের জনসংখ্যার দিক দিয়ে একটি বড় গ্রাম এটি। এ গ্রামে রয়েছে শত শত বছর পূর্বের স্থাপনা কারুকার্য খচিত তিন গুম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ ও তৎসংলগ্ন একটি মঠ। আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মোগল সম্্রাটের শাসনামলে নির্মিত এ কীর্তি। জনশ্রুতি রয়েছে রাতারাতি নাকি হঠাৎ করে গড়ে ওঠে এ মসজিদ ও মঠ। তবে এ প্রজন্মে অনেকে তা বিশ্বাস করতে চায় না। জানা গেছে, ওই গ্রাম এক সময় নিভৃত পল্লীর একটি জনবসতি গ্রাম ছিল। এক সময় নৌকার বিকল্প কোন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। সে সময় আজ থেকে কয়েক শ’ বছর আগে গড়ে ওঠে এখানে তিন গম্বুজবিশিষ্ট একটি মসজিদ। মসজিদ সংলগ্ন প্রায় ৪০ ফুট উঁচু চার স্তরের একটি মঠও নির্মাণ করা হয়। মঠটিতে খোদাই করে অঙ্কন করা হয় বিভিন্ন প্রাণীর ছবি। এক সময় এ মঠ এলাকাবাসীর কল্যাণের জন্য বিশ্বকর্মার পক্ষ থেকে নির্মাণ করা হয়েছে ধারণা করে তাতে বিভিন্ন ধরনের মানত মানা হতো। প্রতি বছর মহররম মাসের ১০ তারিখে অর্থাৎ আশুরার দিনে দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে এখানে অর্চনা করত। যুগের পরিবর্তনে এসব কুপ্রথা এখন বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন আর সারা বছরেও দেখা মিলে না কোন মানত সামগ্রীর বা কাশিদ দলের। এদিকে এ মসজিদ ও মঠ কত সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা এলাকার কেউই সঠিকভাবে বলতে পারেন না। শত শত বছর থেকে এটি রয়েছে তারা শুধু এতটুকুই বলতে পারেন। ওই গ্রামের ৭০ উর্ধ বয়সের মোঃ আব্দুস ছাত্তার বলেন, আমরা তো দূরের কথা আমাদের বাপ-দাদারাও বলতে পারেননি এটি কত সনে স্থাপিত হয়েছে। ওই গ্রামের অধিবাসী আত্রাই কলকাকলী মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাজেদুর রহমান বলেন, আমার দাদা ১৯৮০ সালে ১০৩ বছর বয়সে মারা গেছেন। তিনিও বলতে পারেননি এ মসজিদ ও মঠ কোন যুগে স্থাপিত হয়েছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় যতদূর জানা যায়, ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দে মোগল শাসনামলে ইসলাম খাঁ নামে কোন একব্যক্তি এ এলাকার শাসনকার্যে নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামগাঁথী, ইসলামপুরসহ এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি গ্রাম তার নামানুসারেই করা হয়েছে। ধারণা করা হয় তার আমলেই এ মসজিদ ও মঠটি নির্মাণ করা হয়েছে। এসএ ও আরএস খতিয়ান মূলে ৬ শতক জমির ওপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে এ দু’টি স্থাপনা। প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মঠটি তার সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলতে বসেছে। ইতোমধ্যেই মঠের খোদাইকৃত অনেক প্রাণীর ছবি মুছে ফেলা হয়েছে। এ ছাড়াও মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য এটি ভেঙ্গে ফেলার উদ্যোগ নিয়েছেন মহল্লার একটি পক্ষ। আরেক পক্ষ মঠ না ভেঙ্গে তা দর্শনীয় হিসেবে রেখে দিয়ে মসজিদ স্থানান্তর করার পক্ষে। এদিকে এ মঠ বা মসজিদ না ভেঙ্গে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটির সংস্কার করা হলে এই স্থাপনাটি ঘিরে গড়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এই ঐতিহাসিক নির্দশন, বাংলার গৌরব, উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষী ঐতিহাসিক আত্রাইয়ের তিন গুম্বুজ মসজিদ ও মঠ সংস্কারে এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করছেন উপজেলার সচেতন মহল।
×