জনকণ্ঠ রিপোর্ট ॥ নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের কোন আলামত মেলেনি। এমনকি ঘটনাস্থলে বিস্ফোরকের কোন ধরনের আলামতও পাওয়া যায়নি। যদিও ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। মসজিদের ভেতরে তিতাস গ্যাসের লাইনের লিকেজ থেকে গ্যাস জমে। আর জমে থাকা গ্যাসে বিদ্যুতের শর্টসার্কিট হলে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। এতে ৩১ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি দগ্ধ হয়ে মারা যান। এখনও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে রয়েছেন পাঁচজন। একজনের অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। বাড়িতেই তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে প্রাথমিকভাবে এমনটাই মনে করছে এ সংক্রান্ত ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি।
শনিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সিআইডির তদন্ত দল। তারা ঘটনাস্থল থেকে আরও কিছু আলামত সংগ্রহ করে। পরিদর্শন শেষে সিআইডির ডিআইজি মাইনুল হাসান জানান, প্রাথমিক তদন্তে গ্যাস পাইপলাইনের লিকেজ থেকে অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মসজিদে দুটি বিদ্যুতের লাইন ছিল। তার মধ্যে একটি বৈধ এবং একটি অপরটি অবৈধ। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এছাড়া মসজিদটি যেখানে নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে কোন ত্রুটি আছে কিনা তা তদন্ত করা হচ্ছে। তারা মামলাটি পেশাগত সর্বোচ্চ দক্ষতা দিয়ে তদন্ত করছেন। যারা এমন ঘটনার জন্য দোষী হিসেবে তদন্তে প্রমাণিত হবে তাদের আইনের আওতায় এনে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
তিনি আরও জানান, ঘটনার পর থেকেই সিআইডি পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। ঘটনার পর পরই অনেক আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডির ক্রাইম সিন বিভাগ। সেসব আলামত ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় লোকজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুততার সঙ্গে ঘটনার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়া হবে। এ ঘটনায় গঠিত পাঁচটি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনও সিআইডি সংগ্রহ করবে। এরপরই সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেবে।
পরিদর্শনের সময় সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন, সিআইডি পুলিশ নারায়ণঞ্জের বিশেষ পুলিশ সুপার নাসির উদ্দিন, সহকারী পুলিশ সুপার মোঃ হারুন-অর-রশিদ, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক বাবুল হোসেনসহ সিআইডি পুলিশের কর্মকর্তারা।
সিআইডির ডিআইজি মাইনুল হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রাথমিক তদন্ত মোতাবেক ধারণা করা হচ্ছে, মসজিদের কাছ দিয়ে যাওয়া তিতাস গ্যাসের লাইনে লিকেজ ছিল। সেই লিকেজ দিয়ে তিতাস গ্যাস মসজিদে জমে। আবদ্ধ করে মিথেন জমে থাকলে তা বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে এমনিতেই বিস্ফোরকের মতো কাজ করে। ধরতে গেলে বিস্ফোরকই হয়ে যায়। ঘটনার আগে মসজিদে বিদ্যুত চলে গিয়েছিল। মিনেট পাঁচেক পর বিদ্যুত আসে। বিদ্যুত আসার পর বৈধ লাইনটির সঙ্গে সংযোগ ঠিকমতো কাজ করে। কিন্তু বিপত্তি দেখা দেয়, অবৈধ বিদ্যুতের লাইনটিতে। লাইনটির সঙ্গে মসজিদের যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সংযুক্ত ছিল আর ওইসব সরঞ্জাম চলতে যে পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন তা সরবরাহ করতে পারেনি অবৈধ লাইনটি। ওই সময় ভোল্টেজ টানার কারণে কাটআউটে স্পার্ক করে বা বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়। আর তখনই পুরো মসজিদের ভেতরে থাকা গ্যাসে আগুন লেগে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি ঘটে। তবে ঘটনাস্থলে কোন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। এমনকি কোন বিস্ফোরকেরও আলামত মেলেনি। আগুন লেগে যাওয়ার কারণে ফ্যান ও এসিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র তাপে বাঁকা হয়ে বিকল হয়ে পড়েছে। বিস্ফোরণ হলে মসজিদের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়ার কথা। সেটি হয়নি। ফলে ঘটনাস্থলে বিস্ফোরণ হয়নি, ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাত হোসাইনও এমনটা জানিয়েছেন জনকণ্ঠকে। বলেছেন, জমে থাকা গ্যাস থেকেই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়ে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মোঃ মঞ্জরুল হাফিজও জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, মসজিদের জমে থাকা তিতাস গ্যাসে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট হয়ে অগ্নিকান্ডে হতাহতের ঘটনাটি ঘটেছে। ইতোমধ্যেই তারা দুর্ঘটনার এমন কারণ উল্লেখ করে একটি তদন্ত প্রতিবেদন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন।
গত ৪ সেপ্টেম্বর এশার ফরজ নামাজ আদায়ের পর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম তল্লা এলাকায় বাইতুস সালাত জামে মসজিদে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ ৪০ জনের মধ্যে ৩৭ জনকেই ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন এ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এখন পর্যন্ত ৩১ জন মারা গেছেন। পাঁচজন এখনও জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। একজনকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে।