ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

গত এক সপ্তাহ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ

প্রকাশিত: ১৪:২১, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০

গত এক সপ্তাহ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে ইলিশ

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ গভীর সাগরে গত এক সপ্তাহ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ছে রূপালী ইলিশ। প্রতিদিন হাজার হাজার মণ ইলিশ নিয়ে শত শত ট্রলার আসছে বরিশাল, পটুয়াখালী ও বরগুনার মোকামে। ফলে সাগরের ইলিশে সয়লাব হয়ে গেছে দক্ষিণাঞ্চলের মোকামগুলো। বরিশাল নগরীর পোর্টরোডের বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ইলিশের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় পূর্বের চেয়ে মোকামে পাইকারী দাম কমতে শুরু করেছে। এছাড়া ইলিশের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় কর্মচাঞ্চল্যতা বেড়ে গেছে জেলে, ব্যবসায়ী, আড়তদারসহ সশ্লিষ্টদের। ব্যবসায়ীরা জানান, ইলিশ রফতানির সুবিধা থাকলে মোকামে আমদানি হওয়া ইলিশ সংরক্ষণে বেগ পেতে হতোনা। তাদের মতে, শুধু সাগরের ইলিশেই এখন চাহিদার ওপরে আমদানি হয়েছে। তারা আরও জানান, গতবছর এ সময়ে আটশ’ থেকে এক হাজার মণ ইলিশ মাছ এসেছে নগরীর পোর্টরোডের বেসরকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। সেখানে গত এক সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মণ ইলিশ আসছে এ মোকামে। এরমধ্যে একদিনেই এ মোকামে ছয়শ’ মন ইলিশ এসেছে। আর এ কারণেই মোকামগুলোতে সাগরের ইলিশের দরপতন হতে শুরু করলেও বরিশালের খুচরা বাজারে তার কোন প্রভাব পরেনি। প্রতিদিন সাগর থেকে জেলেরা ট্রলারভর্তি করে ইলিশ মাছ নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের ইলিশ মোকামে ফেরার কারণে জেলেদের হাক ডাকে মুখর হয়ে উঠেছে এসব মোকামগুলো। সাগরে প্রচুর ইলিশ ধরা পরায় জেলেদের পাশাপাশি হাসি ফুটেছে ট্রলার মালিক ও আড়ৎদারদের মুখেও। সাগর থেকে আসা প্রতিটি ফিশিংবোটের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার লাখ টাকা। আজ বুধবার ভোরে নগরীর পোর্ট রোডের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, মাছ ধরার ট্রলার ভর্তি ইলিশ নিয়ে পারে ভিড়ছেন জেলেরা। মাছ ভর্তি ট্রলার পাড়ে ভেড়ার সাথে সাথে শুরু হয় জেলেদের হাঁক ডাক। তারপর চলে বিকিকিনি। ভোজন রসিকরাও ভোরে চলে আসেন মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। খুচরা বাজারে ইলিশের দাম একটু বেশি হলেও পছন্দের মাছটি ক্রয় করে বাড়ি ফিরছেন শৌখিন ক্রেতারা। সূত্রমতে, সবেমাত্র রুপালি ইলিশের দেখা শুরু হলেও করোনার চাঁপে দিশেহারা সাধারণ মানুষ এখনও ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে পারেননি। পাইকারী মোকামে ইলিশের দাম আগের তুলনায় অনেকটা কম হলেও এখনও খুচরা বাজারে তার কোন প্রভাব পরেনি। অথচ ইতোমধ্যে ইলিশ নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে নেমেছে শক্তিশালী একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্র। তারা অতিমুনাফার লোভে ইলিশ রফতানির ফন্দি এটেছে। ইতোমধ্যে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা নানা সেক্টরে লবিং ও তদবির শুরু করেছেন। তবে এই মুহুর্তে ইলিশ রফতানির কোনো প্রস্তাব দেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে বিভাগীয় মৎস্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। সূত্রে আরও জানা গেছে, হঠাৎ ইলিশের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় পাইকারী বাজারে দরপতন হতে শুরু করলেও তীব্র বরফ ও জ্বালানি সংকটে পরেছেন আড়তদার ও জেলেরা। ইলিশ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনের অর্ধেক বরফও পাওয়া যাচ্ছেনা। যাওবা পাওয়া যাচ্ছে তা পূর্বের প্রতি ক্যান বরফ ১২০ টাকা দামের স্থলে বর্তমানে ৩৫০ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। অপরদিকে অভ্যন্তরীণ নদীর ইলিশের আমদানি কম থাকায় সেগুলোর দাম এখনও কিছুটা বেশি। যদিও কয়েকদিন পরে নদীতেও প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে এবং এর ধারাবাহিকতা ডিমওয়ালা ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞার আগ পর্যন্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন মৎস্য দফতরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক মোঃ আনিছুর রহমান। বরিশাল জেলা মৎস্য আড়তদার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নীরব হোসেন টুটুল জনকণ্ঠকে বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে নগরীর পোর্ট রোডের মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে এতো পরিমাণ ইলিশ আসছে, যে এখন রাখার জায়গা নেই। দিন যতো সামনে এগোচ্ছে ততো বেশি ইলিশ আসছে এ মোকামে। এখানে ইলিশ সংরক্ষণের জন্যও নেই কোন হিমাগার। আড়তাদার নাসির উদ্দিন জানান, বুধবার দেড় কেজি সাইজের প্রতি মণ ইলিশ ৩৫ হাজার টাকা, ১ কেজি ২শ’ গ্রাম সাইজের প্রতি মণ ৩০ হাজার টাকা, কেজি সাইজের প্রতি মণ ২৭ হাজার টাকা, রপ্তানিযোগ্য এলসি সাইজ (৬শ’ থেকে ৯শ’ গ্রাম) ২০ হাজার টাকা, ভেলকা (৪শ’ থেকে ৫শ’ গ্রাম) সাইজ প্রতি মণ ১৪ হাজার টাকা এবং গোটলা সাইজের ইলিশ প্রতি মণ বিক্রি হয়েছে ৯ হাজার টাকা মণ দরে। এতো কম দামে পাইকারী বাজারে ইলিশ বিক্রি করা হলেও খুচরা বাজারে এরকোন প্রভাব পরেনি বলে জানিয়েছেন ক্রেতা তানভির আহম্মেদ অভি। এখনও খুচরা বাজারে কেজি সাইজের প্রতিকেজি ইলিশ নয়শ’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ইলিশ বিক্রেতা একাধিক ক্ষুদ্র ব্যসায়ীররা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে কতিপয় প্রভাবশালী মৎস্য ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট অবৈধপন্থায় পার্শ্ববর্তী দেশে ইলিশ পাচার করে আসছে। এখন তারা অতি মুনাফারলোভে সরকারের কাছে ইলিশ বিদেশে পাঠানোর বৈধতা চায়। এজন্য রফতানি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী নেতারা বিভিন্নস্থানে লবিংও শুরু করেছেন। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশালের সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত বলেন, ইলিশ শুধু ধরা শুরু হয়েছে। এখনও খুচরা বাজারে যে দর চলছে, তা সাধারণ মানুষের কেনার সামর্থ্যের মধ্যে পৌঁছায়নি। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন বরিশাল জেলার সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেটে ইলিশ জনগণের মুখ থেকে কেড়ে নেওয়ার পাঁয়তারা করছেন। যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনও ইলিশের স্বাদ নিতে পারেননি, সেখানে কী করে রফতানির প্রশ্ন আসে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় বিশ্বাস বলেন, দেশের চাহিদা মিটানোর পর উদ্বৃত্ত থাকলে ইলিশ রফতানির কথা ভাবতে হবে। কিন্তু বহুদিন ইলিশ ধরা বন্ধের পর এখনই যদি রপ্তানি করা হয়, তবে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হবেন। মৎস্য অধিদফতরের বরিশাল বিভাগীয় উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার জনকণ্ঠকে বলেন, ইলিশ রফতানি সরকারের নীতি নির্ধারকদের ব্যাপার। তবে তড়িঘড়ি করে এটি করা যাবেনা। তিনি আরও বলেন, সরকার সারাবছর ইলিশ পাওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। খুচরা বাজারে ইলিশের দাম আরও সহনীয় হতে হবে। তখন হয়তো জনগনের চাহিদা মিটিয়ে মৎস্য অধিফতরের ইলিশ রফতানির প্রস্তাব করতে পারে।
×