স্পোর্টস রিপোর্টার ॥ পুরো বিশ্বের মতো বাংলাদেশও এক মহা সংকটে নিপতিত। সেই সংকটের নাম করোনা ভাইরাস। এই মরণঘাতী ব্যাধির কবল থেকে রক্ষা পেতে দেশ আজ অঘোষিত লকডাউনে। এতে করে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন গরীব, গৃহহীন ও নিন্ম আয়ের মানুষরা। কারণ তারা এখন কর্মহীন, উপার্জনহীন। করোনায় আক্রান্ত হবার ঝুঁকি তো আছেই, তার চেয়েও বড় ঝুঁকিতে আছেন তারা। সেটা হলো অনাহারে মারা যাওয়ার ঝুঁকি। সরকার অবশ্য ত্রাণ সামগ্রী যথেষ্টই দিচ্ছে। কিন্তু সেই ত্রাণ কিছু অসৎ জনপ্রতিনিধি আত্মসাৎ করে ফেলায় অসহায় মানুষদের কাছে না পৌঁছানোয় আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। তাদের এই অসহায় অসহায় অবস্থা দেখে কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করছেন বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের কিংবদন্তী ফুটবলার প্রয়াত মোনেম মুন্নার পরিবার এবং আরেক তারকা-দিকপাল ফুটবলার আলফাজ আহমেদ।
১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে চার জাতি ফুটবলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। সেটাই ছিল আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের প্রথম ট্রফি জয়। সেই শিরোপাজয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন মুন্না। দীর্ঘ ২৫ বছর পর আবারও সেই জয়ের স্মৃতি সামনে তুলে এনেছেন তার স্ত্রী সুরভী মোনেম। ওই প্রতিযোগিতায় মুন্নার খেলা জার্সিটিই (২ নম্বর জার্সি) নিলামে ওঠাতে চান তিনি।
সুরভী বলেন, ‘আজ মুন্না বেঁচে থাকলে হয়তো অসহায়দের জন্য অনেক কিছু করতো। এখন সে নেই। তারপরও আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তার চার জাতি ট্রফি জয়ের জার্সিটি নিলামে তুলবো। এতে করে যদি কিছু লোকের উপকার হয়।’
আলফাজ আহমেদও প্রায় একই কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলাম। ফাইনালে আমার গোলে জিতেছিল বাংলাদেশ। প্রথমবারের মতো সাফ ফুটবলের শিরোপা জিতেছিলাম। ওই আসরে আমার সেই ১০ নম্বর জার্সি নিলামে ওঠাতে চাই অসহায় মানুষের সহযোগিতার জন্য।’
২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩৯ বছর বয়সে কিংবদন্তি মুন্না সবাইকে অশ্রুজলে ভাসিয়ে চলে যান না-ফেরার দেশে। এত অল্পবয়সে তাঁর চিরবিদায়ে ক্রীড়াঙ্গনে নেমে এসেছিল বিষাদের ছায়া। ২০০০ সালের প্রারম্ভে হঠাৎ করেই কিডনি ফেল করলে ডাক্তাররা দ্রুত কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন। ওই বছরের মার্চে ভারতের ব্যাঙ্গালোর থেকে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় তাঁর শরীরে। মুন্নার বড় বোন শামসুন নাহার আইভী তাঁকে একটি কিডনি দান করেন। এরপর টানা পাঁচ বছর ভাল থাকলেও ২০০৫ সালে মুন্না আবারও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে চিরকালের জন্য তিনি বিদায় নেন।
ফুটবলমোদীদের কাছে মুন্না নামটি এখনও অন্যরকম এক চমকের ব্যাপার। তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়, ছিলেন দক্ষিণ এশিয়ারই অন্যতম সেরা ফুটবলার। স্টপার পজিশনে খেলেও যিনি সর্বসাধারণের মাঝে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মাঠে শুধু চোখ ধাঁধানো নৈপুণ্য নয়, দক্ষ নেতৃত্ব এবং ফুটবলে দুর্দান্ত পেশাদারিত্ব প্রদর্শন করে রীতিমতো ফুটবল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। আর এ কারণেই `কিং ব্যাক’ উপাধি তাঁর জন্য ছিল অবধারিত। ঢাকার মাঠের সবচেয়ে দামী ফুটবলারও ছিলেন তিনি।
৮০-৮১ সালে পাইওনিয়ার লীগে নাম লেখানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে অভিষেক ঘটেছিল মুন্নার। এরপর খেলেছেন শান্তিনগর, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ব্রাদার্স ইউনিয়ন ও আবাহনী ক্রীড়া চক্রে। আবাহনীর হয়েই ক্যারিয়ার শেষ করেন। ফুটবল খেলা ছাড়লেও আবাহনীর কর্মকর্তা-ম্যানেজার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু। আবাহনী মাঠেই তাঁর শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
কলকাতা ফুটবল লীগে ইস্ট বেঙ্গলেও ১৯৯১-৯৩ পর্যন্ত খেলে সমান দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মুন্না। এই ক্লাবে মুন্না লিবারো পজিশনে খেলে দারুণ আলোড়ন তোলেন। জাতীয় দলের হয়ে মুন্না ১৯৮৬- ’৯৭ সাল পর্যন্ত খেলেন। ’৯৫ সালে তাঁরই নেতৃত্বে মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত চার জাতি কাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশের বাইরে প্রথম কোন ট্রফি জেতে বাংলাদেশ।
১৯৮৯ সালে তিনি বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার লাভ করেন ১৯৯১ সালে। ২০০৫ সালে মরণোত্তর জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান।
আলফাজের জন্ম ১৯৭৩ সালে। সিলেটের সন্তান। পরে পুরো বাংলাদেশকেই গর্বিত করেছেন। বাংলাদেশ ফুটবলের সর্বশেষ সুপারস্টার। ৭ এপ্রিল, ২০১৩ তারিখে আবাহনী-মোহামেডানের মধ্যকার খেলায় আলফাজ ফুটবল খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। খেলা ছাড়ার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোচ হবেন। তখন থেকে এ পর্যন্তু এএফসি এ, বি, সি লাইসেন্স কোর্স করেছেন। এর আগে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ফুটবল দলের কোচ হিসেবে কাজ করেছেন তিন বছর (২০১৫-২০১৭)। ২০১৪ সালে মোহামেডান মহিলা ফুটবল দলের কোচ হিসেবেও কাজ করেছেন। সে বছর দলকে লিগে রানার্সআপ করিয়েছিলেন। এছাড়া ২০১৭ সালে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে (বিসিএল) চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ ছিলেন। এখন তিনি উত্তর বারিধারা ক্লাবের কোচ।
১৯৯৬ সালে এশিয়ার প্লেয়ার অব দ্য মান্থ হয়েছিলেন আলফাজ। এরপর আজ পর্যন্ত সেই বিরল কীর্তির পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি আর কোন বাংলাদেশী ফুটবলার। ১৯৮৩ সালে একটি কিশোর ফুটবল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু আলফাজের। পাইওনিয়ার, দ্বিতীয় বিভাগ খেলে ১৯৯১-৯২ সালে রহমতগঞ্জের হয়ে তিনি যাত্রা শুরু করেন ঢাকার ঘরোয়া ফুটবলে। ১৯৯২ সালেই নাম লেখান দেশের অন্যতম সেরা দল আবাহনীতে। ১৯৯৪ সালে যোগ দেন আরামবাগে। পরের বছরই নাম লেখানে আরেক দেশসেরা ক্লাব মোহামেডানে। ওই বছরই জাতীয় দলে খেলার জন্য ডাক পান।
১৯৯৫-২০০১ সাল পর্যন্ত টানা মোহামেডানে খেলে মুক্তিযোদ্ধায় যোগ দেন আলফাজ। ২০০৩ সালে যোগ দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নে। মিডফিল্ডার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা আলফাজ তত দিনে দেশসেরা ফরোয়ার্ড। এরপর শেখ রাসেল, বিজেএমসির হয়েও খেলেছেন তিনি। মাঝে আবার খেলেছেন মোহামেডান, আবাহনী ও আরামবাগের হয়ে।
আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশের উজ্জ্বল তারকা আলফাজ আহমেদ। ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত টানা জাতীয় দলে নির্ভরতার সঙ্গে খেলা আলফাজ ১৯৯৯ সাফ গেমসের এবং ২০০৩ সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন।