ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

রাজশাহীতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল

প্রকাশিত: ১১:১০, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৯

রাজশাহীতে মহারানী হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল

সমুদ্র হক/মামুন-অর-রশিদ ॥ ঐতিহ্যের সাক্ষী রাজশাহী মহানগরীর কংক্রিটের বন বেলদারপাড়া ও বোয়ালিয়ার ঢোপকলগুলো আজও টিকে আছে। তবে তাদের আয়ুষ্কাল বেশি দিন নেই। সিটি কর্পোরেশন জানিয়ে দিয়েছে, এগুলোকে আর নগরীতে রাখা হবে না। আধুনিক যুগে সব বাড়িতেই ওয়াসার পানি আছে। ঢোপকল- রাজশাহীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য। জড়িয়ে আছে সভ্যতাও। অতীতে প্রমত্ত পদ্মা পাড়ের প্রাচীন নগরী রাজশাহীতে বিশুদ্ধ পানির অভাব ছিল। নোংরা পানি খেয়ে ছড়িয়ে পড়ত মহামারী কলেরা। অনেক মানুষ মারা যেত। এক সময় মহানগরীর মাটি রুক্ষ হয়, তখন হা-পিত্যেশ করতে হয় সুপেয় পানির জন্য। ১৯৩৪ সালে তৎকালীন পৌরসভা চেয়ারম্যান রায় ডি এন দাশগুপ্ত রাজশাহীতে সুপেয় পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন। এগিয়ে আসে রাজশাহী এ্যাসোসিয়েশন। সে সময় পুঠিয়ার মহারানী ছিলেন হেমন্ত কুমারী। পৌরসভা ও এ্যাসোসিয়েশন মহারানী হেমন্ত কুমারীসহ দানশীল ব্যক্তিবর্গকে সহযোগিতার অনুরোধ জানান। মহারানী হেমন্ত কুমারী নিজে ৬৫ হাজার টাকা অনুদান দেন। জেলা বোর্ডের দানের জমিতে স্থাপিত হয় ‘হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস’। এরপর শুরু হয় স্থাপন কাজ। পানি সরবরাহের পাইপগুলো হয় কাস্ট আয়রনে তৈরি, বাকি দ্রব্যগুলো পিতলের। আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বানিয়ে আনা হয় ব্রিটেন (ইংল্যান্ড) থেকে। ১৯৩৭ সালের আগস্টে মিনিস্ট্রি অব ক্যালকাটার অধীনে রাজশাহী ওয়াটার ওয়ার্কস নামে পানি সরবরাহ ও বিশুদ্ধকরণ কেন্দ্র নির্মিত হয়। সে সময়ে ব্যয় হয় প্রায় আড়াই লাখ টাকা। সেদিনের পৌরসভার প্রতিটি মোড়সহ একশ’ পয়েন্টে বসানো হয় হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কস। চার ফুট ব্যাসের এসব কল ভূমি থেকে প্রায় ১২ ফুট উঁচু। তৈরি করা হয় ইটের খোয়া ও সিমেন্টের ঢালাইয়ে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত টিনের মতো ঢেউ খেলানো প্লাস্টার দিয়ে। এই হেমন্ত কুমারী ওয়াটার ওয়ার্কসই পরে হয়ে ওঠে পৌরসভা ও আশপাশের এলাকায় বিশুদ্ধ পানির আধার। লোকমুখে হেমন্ত কুমারীর ঢোপকল নামেই এই ওয়াটার ওয়ার্কস পরিচিতি লাভ করে। প্রতিদিন সাত শ’ বর্গমিটারের এই ভূগর্ভস্থ পানি পরিশোধন করা যেত। পানি শোধন কেন্দ্রে আয়রন ম্যাঙ্গানিজ ও ক্ষার দূর করার ব্যবস্থা ছিল। এভাবেই পরিশোধিত পানি নগরীর ঢোপকলে পৌঁছে যেত। ঢোপকলগুলোর প্রতিটিতে পানির ধারণক্ষমতা ৪৭০ গ্যালন। প্রতিটি ঢোপকলেই ছিল একটি করে রাফিং ফিল্টার, যার মধ্য দিয়ে সরবরাহ করা পানি পরিশোধিত হয়ে বের হতো। দিনে দুই ঘণ্টার পানি সরবরাহে ঢোপকলগুলো ভরত। দিনভর নগরবাসী পেতেন সুপেয় পানি। অবশ্য এমন ঢোপকল দিনাজপুর ও ভারতের মালদহ জেলায়ও ছিল। ঢোপকলের পানি বহুকাল রাজশাহীর মানুষ ব্যবহার করেছে। বেলদারপাড়ার একটি প্রাচীরঘেঁষা ঢোপকলে এখনও পানি পাওয়া যায়। তবে বেশিরভাগ ঢোপকলই অকেজো। বেলদারপাড়ার ঢোপকল ঘিরে এখনও স্থানীয় কিছু লোক চা-বিস্কুটের দোকান দিয়েছেন। তাদের একজন বললেন, আগে ট্যাপ ছাড়লেই গলগলিয়ে পানি আসত। গরিব মানুষের উপকার হতো। এখনও পানি আসে, তবে টিপটিপ করে। গরমের সময় পানির জন্য ছুটতে হয় টিউবওয়েলে। আরেকজন বললেন, গ্রীষ্মকালে রাজশাহীতে যেমন খুব গরম শীতকালে তেমনই শীত। শীত এখন বেশি সময় থাকে না। গরমই বেশি। সাহেবরা বলেন, রাজশাহীর মাটি নাকি চড়া (রুক্ষ) হয়ে যাচ্ছে। মাটির নিচে পানিতে টান পড়ছে। সামনে কি হবে কে জানে? রাজশাহীর মানুষ বুঝতে পারছে ভবিষ্যতে খাবার পানির সমস্যা দেখা দেবে। পরিবেশবিজ্ঞানী আবু হায়দার বলেন, সভ্যতার পৃথিবীতে যদি কখনও তৃতীয় বিশ^যুদ্ধ লেগে যায়, তা হবে সুপেয় পানির দখলদারিত্ব নিয়ে। পৃথিবীর তিনভাগ জল একভাগ স্থল। তারপরও বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করে দিয়েছেন ৯৭ শতাংশ পানি সমুদ্রের যা লবণাক্ত। পৃথিবীর তিন পঞ্চমাংশ পানির মধ্যে মিষ্টি পানি মাত্র তিন শতাংশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সুপেয় পানির চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে, কমছে সুপেয় পানির আধার। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নামছে। সমুদ্রের লোনা পানি উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে ভূঅভ্যন্তরে ঢুকে পড়ছে। প্রভাব পড়ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে। পানিতে লবণাক্ততা বাড়ছে। সুদূরপ্রসারী ভাবনায় নির্মিত হয়েছিল রাজশাহীর ঢোপকলগুলো। এসব ঢোপকলে ছিল উন্নত ফিল্টারেশন ব্যবস্থা। পানি বিজ্ঞানীরা সুপেয় পানির বিকল্প আধার খুঁজছেন। প্রত্যেক দেশেই ওয়াটার পিউরিফায়ারের (পানি বিশুদ্ধকরণ যন্ত্র) ব্যবহার শুরু হয়েছে। দিনে দিনে আরও উন্নত হচ্ছে। যেসব দেশের পানিতে লবণাক্ততা বেড়েছে তারা ডিস্যালাইনেশন প্লান্ট তৈরি করেছে। পানির ক্ষতিকারক জীবাণু ও রাসায়নিক মুক্ত করতে বিশ^জুড়ে নানা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও আয়রন রিমুভ্যাল প্লান্ট তৈরি হয়েছে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কৌশল নেয়া হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তিতে বিশ^জুড়ে যখন এমন কর্মযজ্ঞ চলছে তখন সুদূরপ্রসারী ভাবনায় নির্মিত রাজশাহীর ঢোপকলগুলোতে উন্নত প্রযুুক্তির আওতায় না এনে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। ‘কথিত’ যুক্তি দেখানো হচ্ছে রাস্তা সম্প্রসারণসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের দরকার পড়ছে। এই যুক্তিতেই ঐতিহ্যবাহী ঢোপকলগুলো কখনও ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, কখনও সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। রাজশাহীতে এক যুগে প্রায় ৬০ ঢোপকল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। রাজশাহী ওয়াসা জানায়, বর্তমানে মহানগরীতে ৪৭ ঢোপকল রয়েছে। চালু আছে ৩৩। এরও অধিকাংশই বিকল। হাতেগোনা কিছু ঢোপকলে পানি সরবরাহ করা হয়। ঢোপকলে পানি সরবরাহের যে ব্যবস্থা ছিল, এখন তা আর নেই। ঢোপকলের পানির সংযোগ এখন মহানগরীর উপকণ্ঠের পানি শোধনাগারের সঙ্গে যুক্ত। ঢোপকল থেকে রাজস্ব আসে না। সংস্কার হয় না। সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য অনেক ঢোপকল ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছে। অবশ্য সব বাড়িতেই ওয়াসার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। আগামী দিনে ঢোপকলগুলো আর নগরীতে রাখা হবে না। শ্যাঁওলা জমে। পানি ঝরে। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী এসব ঢোপকল প্রদর্শনের জন্য দুটি রাখা হয়েছে বরেন্দ্র জাদুঘরে, সি এ্যান্ড বি মোড় থেকে ডিআইজি অফিস পর্যন্ত তিনটি, কাজলার মাহবুবুর রহমানের আর্কাইভে একটি। কিছু ঢোপকল শহীদ এ এইচ এম কামরুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যানেও প্রদর্শনের জন্য দেয়া হবে। রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি আহসান কবির লিটন বলেন, ঐতিহ্য কখনও জাদুঘরে রেখে সংরক্ষণ হয় না। পুরান জায়গায় রেখেই করতে হয়। এগুলো না ভেঙ্গে সংস্কার করে চালু রাখা যায়। গ্রীষ্মে পথচারীদের তৃষ্ণা নিবারণ, গরিব মানুষের পানি পেতে ঢোপকলগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারে। প্রবীণ ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বললেন ঢোপকলের সঙ্গে রাজশাহীর সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জড়িত। রাজশাহী এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও গবেষক ড. তসিকুল ইসলাম রাজা বলেন, এসব ঢোপকলও আমাদের ঐতিহ্য বহন করে। আগামী পৃথিবীর কথা ভেবে প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব ঢোপকল উন্নত ও চালু রাখা উচিত। হেরিটেজ রাজশাহীর সভাপতি মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, ঢোপকলগুলো ভেঙ্গে ফেলায় ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
×