ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

গাইবান্ধায় যেভাবে এমপি লিটনের কিলাররা সনাক্ত হয়

প্রকাশিত: ০৫:০৩, ২৮ নভেম্বর ২০১৯

গাইবান্ধায় যেভাবে এমপি লিটনের  কিলাররা সনাক্ত হয়

নিজস্ব সংবাদদাতা, গাইবান্ধা ॥ সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে সরিয়ে দিয়ে পুনরায় ওই আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার উচ্চাভিলাষ ও ক্ষমতার মোহেই সাবেক এমপি কাদের খান এক বছর আগে থেকেই এই হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনা করে। এজন্য তিনি তার ঘনিষ্ঠ ৪ সহচর মেহেদী হাসান, শাহীন, হান্নান ও রানাকে প্রলুব্ধ করে এবং নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে তাদের ৬ মাসব্যাপী নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়। তার ছক অনুযায়ি ইতোপূর্বে ঢাকা থেকে গাইবান্ধা আসার পথে এমপি লিটনকে গত ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা ব্যর্থ হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ি রাস্তায় প্রথমে তার গাড়িতে পেছন থেকে ধাক্কা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। এতে গাড়ি থামিয়ে লিটন বের হয়ে আসা মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যার পরিকল্পনা করে ওই কিলাররা। কিন্তু সে মিশনও ব্যর্থ হয়। লিটন হত্যা মিশন : ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এমপি লিটনের নিজ বাড়িতে তাকে গুলি করে হত্যা করতে সক্ষম হয়। লিটন হত্যা মিশনে ৩ জন হত্যাকারি অংশ নেয়। তারা হলো- মেহেদী হাসান, শাহীন ও হান্নান। এরমধ্যে ৫ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে মেহেদী হাসান। প্রথমে ৩ খুনি লিটনের সাথে জরুরী কথা আছে এ কথা বলেই তার সাথে বৈঠকখানা ঘরে ঢোকে। সেখানে ঢুকেই তাকে সালাম দিয়েই ১ রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে মেহেদী। যা লিটন হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। ফলে সে গুলিটি হাতে লাগে। যেহেতু এই খুনিরা পেশাদার কিলার ছিল না, সেজন্য প্রথম গুলিটি ব্যর্থ হলে খুনি মেহেদী ঘাবড়ে যায় এবং চোখ বন্ধ করে এলোপাথারি পরবর্তী ৪ রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে হত্যা নিশ্চিত করে। হত্যাকান্ড শেষে তাদের ব্যবহৃত ডাইং ব্রাউন্সার রানার ১০০ সিসির কালো রংয়ের মটর সাইকেলটিতে চড়ে দ্রুত পালিয়ে যায় তারা। খুনে ব্যবহৃত মটর সাইকেলটি কাদের খানের নামে রেজিষ্ট্রেশনকৃত এবং রেজিঃ বাবদ প্রদত্ত ফি জমা করা হয়েছে এমডি আলী নামে। যা পুলিশ জব্দ করে। এরপর রাস্তায় অপেক্ষমান কাদের খানের গাড়িতে কিলাররা বগুড়ায় তার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে পরে খুনিরা বাসে ঢাকায় গিয়ে কাদের খানের সহযোগিতায় আত্মগোপন করে থাকে। যেভাবে কিলাররা সনাক্ত হয় : এমপি লিটনের কিলাররা ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়কে ধোপাডাঙ্গায় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি দিয়ে ভয় দেখিয়ে ফাইম নামে এক যুবকের কাছ থেকে তার মোবাইল ও টাকা পয়সা ছিনতাই করে। ছিনতাই শেষে তাড়াহুড়া করে পালাতে গিয়ে পিস্তলের ৬ রাউন্ড বুলেটের ম্যাগাজিনটি তাদের অগোচরে রাস্তায় পড়ে যায়। যা স্থানীয় জনগণের দেয়া তথ্য অনুযায়ি পুলিশ উদ্ধার করে। এই পিস্তলের বুলেট পরীক্ষা করে দেখা যায় এমপি লিটনের শরীর থেকে অপারেশন করে বের করা এবং তার বাড়িতে হত্যার পর প্রাপ্ত বুলেটের খোসার সাথে ওই ম্যাগাজিনের বুলেটের মিল রয়েছে। পরে এই সুত্র ধরে খুনিদের আটক করা হয় এবং পিস্তলটির ব্লাষ্টিক পরীক্ষার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। খুনিদের স্বীকারোক্তি : গ্রেফতারকৃত ৩ খুনি সেসময় ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে খুনের ঘটনা স্বীকার করে এবং এই ঘটনার মুল পরিকল্পনাকারি, অর্থ যোগানদাতা ও প্রশিক্ষণদাতা হিসেবেও আব্দুল কাদের খানের নাম উল্লেখ করে। এদিকে খুনিরা কাদের খানের পিস্তলটি ব্যবহার করেছিল বলেই বিভিন্ন সুত্র থেকে নিশ্চিত করে পুলিশ। তৎকালিন সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান খুনিদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক কাদের খানের পিস্তল এবং বুলেট জব্দ করে। কিন্তু ৪০ রাউন্ড বুলেট ক্রয় করলেও কাদের খান পুলিশকে মাত্র ১০ রাউন্ড বুলেট জমা দেয়। বাকি ৩০ রাউন্ড বুলেটের হিসাব সে দিতে পারেনি। খুনে ব্যবহৃত পিস্তল উদ্ধার : পুলিশ কাদের খানের গ্রামের বাড়ি সুন্দরগঞ্জের ছাপড়হাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটি খান বাড়িতে এমপি লিটন খুনে ব্যবহৃত পিস্তলসহ অন্যান্য আলামত উদ্ধারে ২০১৭ সালের ২৩ ফেব্র“য়ারি ব্যাপক তল্ল¬াসী শুরু করে। এসময় ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা বাড়ি সংলগ্ন ৩টি পুকুরের পানি সেচে ফেলে। কিন্তু সেখান থেকে কোন আলামতই পাওয়া যায়না। অবশেষে রিমান্ডে নিয়ে কাদের খানকে চাপ সৃষ্টি করা হলে তিনি পিস্তলের কথা স্বীকার করেন এবং তাকে সাথে নিয়ে ওইদিন রাতেই তার বাড়িতে যাওয়ার পর তার নির্দেশিত আমগাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ে অস্ত্র ও ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। মাটির নিচ থেকে উদ্ধারকৃত পিস্তল ও ম্যাগাজিন দেখেই বোঝা যায় দেড় থেকে দু’মাসের মধ্যেই এগুলো মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল। কিলারদের প্রশিক্ষণ ঃ সুন্দরগঞ্জের ছাপড়হাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটি খান বাড়িতে কাদের খানের একটি দোতলা বাড়ি রয়েছে। এই বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল গ্রেফতারকৃত কিলার শাহীন। পুলিশকে দেয়া তাদের তথ্য অনুযায়ি জানা গেছে, এই বাড়িতেই কিলারদের পিস্তল চালানো এবং কিলিং মিশন সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিত কাদের খান। বাড়ি থেকেই অস্ত্রসহ গিয়ে এমপি লিটনকে হত্যা করা হয়। সেদিন ওই পিস্তলটির ম্যাগাজিনে ৬ রাউন্ড বুলেট ছিল। কাদের খানের বাড়িতে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে অসাবধানতাবশতঃ পিস্তল থেকে একটি বুলেট বেরিয়ে গিয়ে দেয়ালে লাগে। পুলিশের অভিযানকালে ঘরের দেয়ালে বুলেটের আঘাতের চিহ্ন পরিলক্ষিত হয়। ওই পিস্তলের ম্যাগাজিনে থাকা ৫ রাউন্ড গুলি ছুঁড়েই খুনিরা এমপি লিটনকে হত্যা করে। যেভাবে কাদের খান গ্রেফতার : গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের আওয়ামী লীগ দলের এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের হত্যার মুল পরিকল্পনাকারি ও অর্থ যোগানদাতা সুন্দরগঞ্জের জাপা (এ) সাবেক এমপি কর্ণেল (অবঃ) ডাঃ আব্দুল কাদের খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে ২০১৭ সালের ২২ ফেব্র“য়ারি বিকেলে বগুড়া শহরের রহমান নগর জিলাদারপাড়া তার বাসা থেকে গ্রেফতার করে রাতে গাইবান্ধায় নিয়ে আসা হয়। এছাড়া ওইদিন সকালে গাইবান্ধা শহরের ব্রীজ রোড এলাকা থেকে তিন খুনি কাদের খানের ঘনিষ্ঠ সহযোগি সুন্দরগঞ্জ উপজেলার উত্তর সমস কবিরাজপাড়া গ্রামের আব্দুল করিমের ছেলে রাশেদুল ইসলাম ওরফে মেহেদী হাসান (২২), উত্তর সমস বেকাটারি গ্রামের ওসমান গণির ছেলে শাহীন (২৩) এবং কাদের খানের গাড়ি চালক বগুড়ার শাহজাহানপুর থানার কামারপুর গ্রামের আব্দুর রহমানের ছেলে হান্নান (২৭) কে গ্রেফতার করা হয়। কে এই কাদের খান? সুন্দরগঞ্জের এলাকার সর্বস্তরের মানুষের কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, কাদের খানের পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল ময়মনসিংহ জেলায়। তার দাদা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ছাপড়হাটি ইউনিয়নের পশ্চিম ছাপড়হাটি গ্রামে জমি কিনে পরিবার-পরিজনসহ বসবাস শুরু করে। কাদের খানের পিতা হাসেন আলী খা। তার স্ত্রী ডাঃ নাসিমা আকতার একজন গাইনী বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারি চাকরি করছেন। সেনা বাহিনী থেকে কাদের খান কর্ণেল হিসেবে অবসর নেয়ার পরে বগুড়ার রহমান নগর দিলাদারপাড়ায় গরিব শাহ ক্লিনিক নামে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই ক্লিনিকটি পরিচালনা করেন। ক্লিনিকের সাথেই তিনি বসতবাড়িও নির্মাণ করে বগুড়াতেই বসবাস শুরু করেন। এর পাশাপাশি গ্রামের বাড়িতেও একটি দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে সেখানে তিনি মাঝে মধ্যে এসেই বসবাস করতো। এ সময়টিতে জাতীয় পার্টির হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সাথে পূর্ব পরিচয়ের সুত্র ধরে জাতীয় পার্টির রাজনীতি শুরু করেন মহাজোটের মনোনয়ন নিয়ে জামায়াত প্রার্থী সাবেক এমপি মাওলানা আব্দুল আজিজকে পরাজিত করে ২০০৮ সালে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
×