সমুদ্র হক ॥ আমাদের মেধা অন্বেষণে শিশুরা হারিয়ে ফেলছে প্রতিভা। বইয়ের বোঝায় নুয়ে পড়ছে তাদের ভবিষ্যত। পিঠে পাঠ্য বইয়ের বোঝা নয়, বইয়ে আসক্তিই পারে শিশুর ভবিষ্যত গড়ে দিতে। ঘুমকাতুরে অলস শিশু- যারা লেপে মুখ লুকিয়ে চুপ করে থাকতÑ এই তো ক’দিন আগের দাদি-নাতিরা যাদের বিছানা থেকে উঠাতে বলতেন, ভোরের শিশির যে বাচ্চার পায়ে লাগে না তার লেখাপড়া হয় না। যে অবারিত আকাশ দেখে না বড় হয়ে সে কিছু করতে পারে না। অথচ দাদি-নানির সন্তান যারা চাকরি-বাকরি করে নিজেদের ভাগ্যবান করে তুলেছেন তারাই তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য তার বাচ্চাদের পায়ে ঘাসের শিশির লাগাতে দেন না। সকালের সোনাঝরা রোদ তাদের শরীরে লাগতে দেন না। অথচ শিশুর মনোজগত বিকাশের জন্য চাই অবারিত আকাশ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো আকাশে ওড়ার স্বপ্নসাধই পারে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে। তাদের মনোজগত বিকশিত হওয়ার কোন স্বপ্ন সাধই এখন আর তাদের পূরণ হয় না।
ভোরে সূর্যের আলো ফোটার আগেই তাদের ছুটতে হয় স্কুলে। সন্তানদের স্কুলে পৌঁছানোর সময় তাদের ওপর বাবা-মা জারি করেন রীতিমতো জুলুম : যেমন করেই হোক গোল্ডেন-৫ তোমাকে পেতেই হবে। সে হুকুম তামিলের যোগ্যতা তার সন্তানের থাক বা না থাক। এই সেদিন জিপিএ-৫ পাওয়া রাকিবের সঙ্গে কথা হলো ভার্সিটির উচ্চতর পড়া শেষে জীবনের পথে নেমেছেন।
চোখে মুখে স্বপ্ন। দেশ ভ্রমণ করবেন। জানতে চাওয়া হয় সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা বই পড়েছেন?-পাল্টা, প্রশ্ন উনি কে ছিলেন? মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীর শাহীন। তারও অনেক আশা। আবুল মনসুর আহমেদের ফুড কনফারেন্স বইটি পড়েছেন!- ওহ! উনি বই লিখেছেন। উনি তো খাদ্য বিভাগের বড় অফিসার ছিলেন তাই না! শওকত ওসমানের কোন বই পড়েছেন! উত্তর না দিয়ে লজ্জা পাওয়ার আগে কেটে পড়লেন। আরেক উচ্চ শিক্ষিতকে বলা হয় মৈত্রেয়ী দেবীর ‘ন হন্যতে’ বইটি পড়েছেন। চোখমুখ বলে দিল অবাক হয়েছেন! বললেন, ওহ ইনি তো হ্যাঁ হ্যাঁ ইনি...। পূর্ণেন্দু পত্রীর নামই শোনেননি তিনি। বিশ^াস হয়তো হবে না। ‘শিশুর পিঠে বইয়ের বোঝা’ শিক্ষায় বাস্তবতা এমনটাই।
ছাপার অক্ষরে লেখা বই মানবের অন্তরের চোখ খুলে দেয়। প্রকৃতি আলো বাতাসে জাগিয়ে দিয়ে অন্তরের হাজারো চোখ মেলে জগত সম্ভারে সঞ্চারিত হয় জীবনী শক্তি। সেই পাঠাভ্যাস এখন নেই! অতীতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকরা পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ছড়া কবিতা গল্প উপন্যাসসহ নানা ধরনের বই পড়ায় উৎসাহ দিতেন। বলতেন নিজেকে গড়তে শুধু পাঠ্যবই যথেষ্ট নয়। কল্পনাশক্তি না থাকলে মেধার বিকাশ হবে না। তৈরি হবে না উপস্থিত বুদ্ধি। সুন্দর দুষ্টুমিতে, মধুর প্রণয়েও মেধা দরকার- পাঠাভ্যাসে যা গড়ে উঠবে। বইপড়ার আসক্তিতে কেউ বিপথে যেতে পারে না। বিপথের সব পথ রুদ্ধ করে দেয় পাঠাভ্যাস।
আগের দিনে মধ্যবিত্ত পরিবারের বুক শেল্্ফ, আলমারি, কাঠের বাক্সে বই থাকত। বলা হতো পারিবারিক লাইব্রেরি। পরিবারে পাঠাভ্যাস গড়ে উঠত। বই মনকে সজীব রাখে। সচল রাখে মস্তিষ্ক। বিষণœতা দূর করে সহানুভূতিশীল ও আত্মনির্ভরতা এনে দেয়। নিকট অতীতেও তরুণ-তরুণীরা বই পড়ে চলেছে আগামীর পথে। এই চর্চা কর্মক্ষেত্রকে সার্থক করে তোলার পথ দেখাত। উত্তরসূরিরা আলোর পথ খুঁজে পেত।
বর্তমান প্রজন্ম কি পারছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে কোন বই পড়তে, ছড়া কবিতা গল্পের বই কি ওদের হাতে দেয়া হয়? শিশুদের পাঠ্যবই পড়ার চাপ দিয়ে ত্রাহী অবস্থায় ফেলে প্রতিভা বন্দী রাখা হচ্ছে। ওরা ভোরের আলো দেখে না। সূর্যালোকের ভিটামিন-ডি নেয়ার আগেই পিঠে কয়েক কেজি বইয়ের বোঝা চেপে ছুটতে হয় স্কুলে। সে স্কুলে মাঠ নেই। পায়ের পাতায় শিশির লাগে না। বহুতল ভবনের খোপ। আলো বাতাস অপর্যাপ্ত। ফাস্টফুডে টিফিন শেষে বাড়িতে ফিরে ভাত মুখে দিয়েই ছুটতে হয় কোচিংয়ে। বিকেলের সোনামাখা রোদ ওদের জীবনে উধাও। কখনও রাতেও কোচিং। বাড়ি ফিরে এইচডব্লিউ (হোমওয়ার্ক) খাতা ঠিক করা। পরদিন ওই একই টাইট রুটিন। শিশুরা বাইরের বই পড়বে কখন, উৎসাহ দেয়া দূরে থাক অভিভাবকদের জুলুম। জিপিএ-৫ (এখন ৪ হয়েছে) পেতেই হবে। না পেলে শাস্তি। স্কুলের শাস্তি আইন করে রোধ করা গেছে। কিন্তু পারিবারিক শাস্তি তো রোধ হয়নি। ‘অমুকের ছেলে মেয়ে এ-প্লাস গোল্ডেন আর তোর ফল এই’!-এমন কথায় শিশু মনে কি প্রভাব পড়ে তা কি ভেবে দেখেন অভিভাবকরা!
বগুড়ার সূত্রাপুরের আবুল কালাম আজাদের নাতনি মুশফিকা আল মামুন নক্সী (৭)। মেধাবী এই শিশুর অভিভাবকও আর দশজনের মতো। তবে নানা চান মানুষের মতো মানুষ হয়ে গড়ে উঠুক। তিনি নাতনিকে ছড়ার বই কার্টুন বই, মজার বই কিনে দিয়ে পাঠাভ্যাস গড়ে দিচ্ছেন। মনিটরিং করে দেখেছেন, পাঠ্যবইয়ে যতটা জ্ঞান ও আহরণ করছে ছড়া আর মজার বই তাকে মেধাবী ও বুদ্ধিদীপ্ত করে তুলছে। নক্সী তার নানাকে এখনই বলে ‘ভাইয়া এত বই ব্যাগে ভরে পিঠে নিয়ে প্রতিদিন স্কুলে গেলে তো কোমর বাঁকা হয়ে বুড়ির আগেই বুড়ির মতো হবো!’ এতেই প্রমাণ মেলে শিশুদের পাঠ্যবই যথেষ্ট নয়। শিশুর মনোজগত বিকাশে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য বই অবশ্যই পড়া দরকার। এতে শিশুর মনের রঙিন স্বপ্নসাধ পাখা মেলতে পারে।
মুদ্রিত (ছাপাখানা) বই বা কাগজের বই পড়ার স্বাচ্ছন্দ্য চিরন্তন। একটি বইয়ের প্রতিটি পাতার প্রতিটি শব্দ পড়ার সময় মনে হবে অনেক কথার মালা গাঁথা হয়ে যাচ্ছে জীবনের আঙিনায়। যে লেখক সহজ ভাষায় মানুষের জীবনের কথা তুলে ধরতে পারেন তার লেখা পাঠকের মন ছুঁয়ে যায়। খুঁজে পায় নতুন পথ। যেন পথ আলোয় ভরা। হালে বইমেলায় ই-বুকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা কাগজের বইয়ের সঙ্গে ই-বইয়ের স্বাদ পাচ্ছে। অনেক বই পোর্টেবল ডকুমেন্ট ফরমেটে (পিডিএফ) পাওয়া যায়। বিশিষ্ট লেখক বজলুল করিম বাহার বললেন, অতীতে অনেক বাড়িতে ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। ছিল সে সময়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে বই উপহার দেয়ার রেওয়াজ। বললেন, মনোজগত দীর্ঘ গভীর। সাহিত্যে নৈতিক এনরিচমেন্ট চিত্তের আলোকায়ন। যা দীর্ঘ মেয়াদে ভূমিকা রাখে। যিনি প্রকৃত লেখক যা কিছু দেখেন না লিখে থাকতে পারেন না।
বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে ল্যাপটপ, ট্যাবে ই-বুক (ইলেক্ট্রনিক বই) পড়ার প্রবণতাও আছে। বিশ^ায়নে ই-বুক তরুণদের গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয় পড়ুয়া কয়েক তরুণের সঙ্গে কথা হলো। তাদের কথা, নেটে বই পড়ে বেশিক্ষণ ধৈর্য রাখা যায় না। যন্ত্র যে ভাবে বলে তাই- ভাবনার দুয়ার খোলে না। সৃজনশীলতা আনে না। উল্টো রেডিয়েশন চোখ ধাঁধিয়ে চাপ বাড়িয়ে দেয়। তবে বিশে^র যে কোন বই (যা ডিভাইসে যুক্ত আছে) ডাউনলোড করে রাখা যায়। রেফারেন্সের প্রয়োজন হলে খোঁজ করা যায়। ই-বুক দূরকে কাছে এনেছে। কেড়ে নিয়েছে আবেগের সুপ্ত জায়গাটি।