আমাদের অর্থনীতির প্রাণ হচ্ছে গ্রাম। গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত মজবুত না হলে জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে না। আমাদের দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ লোক শহরে বাস করে বাকি ৬৯ শতাংশ লোকই গ্রামে বাস করে। বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন না হলে সামগ্রিক উন্নয়ন হবে না। গ্রাম-শহর সমানভাবে উন্নত হলেই কেবল দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। যে সকল দেশ উন্নত সমৃদ্ধিশালী হয়েছে তাদের ভিত্তি ছিল শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতি। এসব ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের উন্নয়নের স্লোগান ‘আমার গ্রাম আমার শহর’-এর অর্থই হলো গ্রামাঞ্চলকে অবকাঠামোগত দিক দিয়ে বদলে দেয়া, গ্রামীণ জনপদকে শহরের মতো করে সেবা দেয়া। সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার আজ প্রতিটি গ্রাম থেকে উপজেলা ও জেলা পর্যায় পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগের নেটওয়ার্কে নিয়ে এসেছে, দেশের ৯৩ শতাংশ এলাকা এখন বিদ্যুতের আওতায় এসেছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই শতভাগ বিদ্যুত নিশ্চিত করা হবে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে নতুন নতুন উদ্ভাবন কৃষকের দোড়গোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, কৃষক যাতে ফসলের ন্যায্য মূল্য পায় সে লক্ষ্যে সরকার পর্যাপ্ত পরিমাণ ধান চাল গম ক্রয় করে থাকে, যাতে করে কৃষি বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। গ্রামের লোককে শিক্ষার মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীর বিনামূল্যে বই দেয়া, দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষাকে অবৈতনিক, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল করে বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সব জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সেবা প্রদান করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমে একদিকে যেমন শহরের চাপ কমবে অন্যদিকে গ্রামে বাড়বে উদ্যোক্তা ও কর্মসংস্থান।
কৃষি আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত হওয়া সত্ত্বেও এতদিন ছিল অবহেলিত। বর্তমান সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপের কারণে কৃষি আজ স্বয়ংসম্পূর্ণ। সরকার স্বল্পমূল্যে কৃষকদের মাঝে বীজ, সার, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ বিতরণ করছে। বাজেটে কৃষি উপকরণে ভ্যাট, ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে। যার ফলে শুধু উৎপাদনই বাড়েনি গ্রামীণ অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে গ্রামের জনগণের জীবনযাত্রার ওপর।
প্রান্তিক জনগণের সুবিধার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল তথ্য সেবা সেন্টার স্থাপন, কৃষকের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার ব্যবস্থা, ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক বা ইউনিয়ন সেবা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
সরকারের গ্রামীণমুখী পদক্ষেপের ফলে বিগত এক দশকে কৃষি আজ মজবুত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। যে জমিতে বছরে একবার ফসল হতো, সেখানে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন বেড়েছে কয়েকগুণ। যার ফলে বাংলাদেশ এখন খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি দেশ। যে সকল মাছ বিলুপ্তির পথে ছিল, জিন প্রযুক্তির মাধ্যমে মাছেরও বিপ্লব সাধিত হয়েছে।
সরকারের উন্নয়নের সুফল প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছে। ভূমিহীন গৃহহারা লোকদের বিনা পয়সায় গৃহ নির্মাণ, বিনা সুদে কিংবা স্বল্প সুদে নারীদের ঋণ দেয়া হয় যাতে নারীরাও বিভিন্ন ধরনের কাজ করে নিজেরাই সাবলম্বী হতে পারে। সরকারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকরী প্রকল্প হলো ‘একটি বাড়ি একটি খামার’। এ প্রকল্পে আগ্রহী হয়ে অধিকাংশ বাড়িতে গড়ে উঠেছে হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল পালনের পাশাপাশি মৎস্য চাষ ও সবজির বাগান। এ কাজে অর্থ সহায়তা শুধু নারীরাই পেয়ে থাকে বিধায় স্বনির্ভর হচ্ছে গ্রামের নারীরা এবং পরিবারকে স্বাচ্ছন্দ্যে রাখতে সহায়তা করছে।
সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের ফলে অতি দারিদ্র্যের হার ১২ শতাংশে নেমে এসেছে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদন তথা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান এখন ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ পৌঁছেছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাত কোটি মানুষের খাদ্য উৎপাদন করতে হিমশিম খেতে হয়েছে। খাদ্য আমদানি করে ঘাটতি মেটানো হতো। আজ জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে, আবাদী জমি কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ তারপর বাংলাদেশ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য সংস্থা (এফএও) তথ্যানুসারে বাংলাদেশ এখন চাল ও মাছ উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ, সবজিতে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম স্থান দখল করছে। সবই সম্ভব হয়েছে সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে। অত্যন্ত আশার কথা হলো অনেক শিক্ষিত তরুণ কৃষিতে শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করছে। সরকার আর্থিক সহায়তা দিয়ে সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আরও সামনের দিকে। যেভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে তাতে করে ২০৪১ সালের অনেক আগেই উন্নত দেশের কাতারে চলে যাবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
লেখক : সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা
[email protected]