উনবিংশ শতকের আধুনিক প্রাণপুরুষ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজের সর্বক্ষেত্রে নতুন সময়ের আবেদনে যে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন, সেখানে তিনি সমকালীন অঙ্গনের এক অসীম সাহসী যোদ্ধা। কট্টর ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েও রক্ষণশীল সমাজের যাবতীয় অভিশাপকে যে মাত্রায় আঘাত করেন শান্ত আর সুদৃঢ় শক্তিতে, সেখানে আজও তিনি অপরাজেয় এক বলিষ্ঠ অগ্রনায়ক। যুগের অগ্রগামী চিন্তায় বিদ্যাসাগর সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেন সমাজের অর্ধাংশ নারীই সব চাইতে অসহায়, নিপীড়িত, মূর্খ আর অসম ব্যবস্থার শিকার। মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধে তাদের সর্বাধিক অধিকারের প্রতি বিদ্যাসাগরের যে অনমনীয় মনোসংযোগ, সেখানে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা সামাজিক অপসংস্কারগুলো সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবন প্রবাহকে যে মাত্রায় উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত অবস্থায় নিয়ে যায়, তারই আলোকে সমাজকে নতুন পথ দেখাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন তিনি। উনিশ শতকের আধুনিক এই ব্যক্তিত্ব প্রচলিত সমাজ সংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে গিয়ে সরাসরি কোন ধর্মকে সেভাবে আঘাত করেননি। বরং সমস্ত রক্ষণশীলতার প্রতিকার খুঁজতে গিয়ে এই সুপ-িত, জ্ঞানাচার্য অবলম্বন করেছিলেন শাস্ত্রকেই।
বিনয় ঘোষ তার ‘বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ’ বইয়ে এ অকুতোভয় প-িতের আলোকিত জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। লেখকের মতে, গোপাল ও রাখালের যে চরিত্র শিশু শিক্ষায় অঙ্কিত হয়, সেখানে বিদ্যাসাগর নিজেই ছিলেন রাখাল। কারণ গোপালের মতে সুবোধ বালকের চারিত্রিক গুণাবলী বিদ্যাসাগরের মধ্যে কখনও দেখা যেত না। বিনয় ঘোষ উল্লেখ করেন, পিতা ঠাকুর দাস যা বলতেন তার অন্যথাই করতেন বালক ঈশ্বর। যেমন বাবা বলতেন- ঈশ্বর পুকুরে গিয়ে স্নানটা কর। পরের ২/৩ দিন বিদ্যাসাগর পুকুরের ধারে কাছেও যেতেন না। ঠাকুর দাস কখনও যদি নির্দেশ করতেন আজ স্নানের প্রয়োজন নেই। সেদিন বালক ঈশ্বর সারাদিনই পুকুরে ভেসে বেড়াতেন। তেজ, জেদ এবং দৃঢ়তা ছিল বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক শৌর্য। এ সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য তুলে ধরা যায়- ‘বিদ্যাসাগরের জীবনবৃত্তান্ত আলোচনা করিলে প্রথমেই তাঁহার পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি নিরতিশয় তেজস্বী ছিলেন। কোন অংশে কাহারও নিকট অবনত হইয়া চলিতে অথবা কোন প্রকার অনাদর বা অবমাননা সহ্য করিতে পারিতেন না। এ দরিদ্র ব্রাহ্মণ তাঁহার পৌত্রকে আর কোন সম্পত্তি দান করিতে পারেন নাই, কেবল যে অক্ষয় সম্পদের উত্তরাধিকারী বণ্টন একমাত্র ভগবানের হস্তে, সেই চরিত্র মাহাত্ম্য অখ-ভাবে তাঁহার জ্যেষ্ঠ পৌত্রের অংশে রাখিয়া গিয়েছিলেন’ (চারিত্র্যপূজা)। চারিত্রিক ঔদার্যের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়েছে বিদ্যাসাগরের জ্ঞানার্জনের অদম্য স্পৃহা। সেটি আশৈশব, পিতা ঠাকুর দাসের সঙ্গে গ্রাম থেকে শহরে আসার সময় রাস্তায় ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত মাইল ফলকের ইংরেজী সংখ্যা গুনে আসতে আসতে ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত পুরো সংখ্যাই তার আয়ত্তে এসে যায়। এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় বিনয় ঘোষের লেখায়।
শিক্ষা থেকে আরম্ভ করে সমাজের বিধিবদ্ধ জঞ্জালকে সাফ করে সর্বজনীন এক ব্যবস্থা অবারিত করতে উনিশ শতকের এ কৃতী মানুষ তাঁর মহতী কর্মযোগে এগিয়ে যান একাই। ব্রাহ্মণ ঘরের সন্তান হয়েও ধর্মের কঠিন সংস্কারের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে এলেন। তাঁর মনে হয়েছিল শিক্ষাই প্রয়োজনীয় মাধ্যম যার ওপর ভর করে অর্ধাংশ নারী জাতি জীবনের আলো খুঁজে পাবে। নারী শিক্ষার জন্য বিদ্যাসাগরের যুগান্তকারী অবদান আজও সংশ্লিষ্ট অংশের সোনালী অধ্যায়। তাঁর হাত ধরেই নারী শিক্ষা বঙ্গললনার আঙিনায় প্রবেশ করে। বাল্য বিয়ের মতো অভিশাপকে রদ করতে ব্যর্থ হলে অবোধ বালিকাদের অকাল বৈধব্যকেও মেনে নেয়া ছাড়া গতি থাকে না। এই বোধে অসংখ্য বাল্য বিধবা নিয়ে তাঁর আন্তরিক মর্মবেদনা ও উৎকণ্ঠার শেষ ছিল না। বাল্যবিয়ে রদ এবং বিধবা বিয়ের আইন সিদ্ধতা বিদ্যাসাগরের অবিস্মরণীয় কীর্তি। আর এমন সব নারী হিতকর কর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে তৎকালীন বিদগ্ধ প-িত মহল তাঁকে ভর্ৎসনা করতে ছাড়েননি। তবে কোনভাবেই সনাতন ধর্মের গায়ে আঁচড় লাগাননি। বরং শাস্ত্র ঘেঁটেই বের করেছেন হিন্দু রমণীর মুক্তির সর্ববিধ উপায়।
জীবনভর বিদ্যাসাগরকে প্রায় পূজা করেছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই জ্ঞান তাপসকে নিয়ে কবির বহু অভিব্যক্তি আছেÑ
‘বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে একক ছিলেন এবং বৃহৎ বনস্পতি যেমন ক্ষুদ্র বন জঙ্গলের পরিবেষ্টন হতে ক্রমেই শূন্যে আকাশে মস্তক তুলিয়া ওঠে, বিদ্যাসাগর সেই রূপ বয়োবৃদ্ধি সহকারে বঙ্গসমাজের সমস্ত অস্বাস্থ্যকর ক্ষুদ্রতা জাল হতে ক্রমশই শব্দহীন সুদূর নির্জনে উত্থান করিয়া ছিলেন? (চারিত্র্যপূজা)।
বঙ্গীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ধারক বিদ্যাসাগর যেভাবে মাতৃভাষা বাংলাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছিলেন সেটাও এক অকৃত্রিম সম্পদ। কঠিন, জটিল ও দুর্বোধ্য বাংলা ভাষায় ছন্দময় গতি, শৈল্পিক বোধ, সরলতা এবং সহজবোধ্যতা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এই প্রাণপুরুষের অভাবনীয় কীর্তি আজও বাঙালী সমাজকে যথার্থ পথ দেখিয়ে যাচ্ছে। সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা সংস্কৃতি কঠিন, কট্টর ও দুর্বোধ্যতার আবর্তে ঢেকে যেতে পারে না। সেই অনধিগম্য কাঠিন্য থেকে বের করে বাংলাভাষাকে সহজ, সাধারণ এবং নান্দনিকতায় পরিপূর্ণ করা এই কৃতী ব্যক্তিত্বের অসাধারণ কর্মযোগ। অবিভক্ত বাংলায় নারী শিক্ষার বিস্ময়কর অগ্রযাত্রায় বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠায় বিদ্যাসাগরের যে দুর্লভ ভূমিকা, তা আজও অবিস্মরণীয়। আর বিধবা বিয়ের নজির স্থাপন করতে গিয়ে স্বীয় পুত্রের সঙ্গেই বিধবার বিয়ে দেন প্রথম। বর্ণপরিচয়সহ অসংখ্য শিশুশিক্ষামূলক গ্রন্থসহ অনুবাদ কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম অবলম্বনে শকুন্তলা, সীতার বনবাস, মহাভারতের উপক্রমণিকা ওপর সমৃদ্ধ রচনা বিদ্যাসাগরের জ্ঞান ও মননের অনন্য ঐশ্বর্য। ঈশ্বরে অবিশ্বাসী একজন নিষ্ঠাবান মানুষ কোন দিন মন্দিরে প্রবেশ না করেও পরিত্রাণের সমস্ত উপায় খুঁজেছিলেন ধর্মীয় শাস্ত্র আর আধুনিক বোধ থেকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আচারের যে হৃদয়হীন, প্রাণহীন পাথর দেশের চিত্তকে পিষে মেরেছে, রক্তপাত করেছে, নারীকে পীড়া দিয়েছে, সেই পাথরকে দেবতা বলে মানেননি। তাকে আঘাত করেছেন। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরে জন্মগ্রহণ করেও এই দেশেরই একজন নবীনের বিদ্রোহ নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাঁর নবীনতাই আমার কাছে সবচেয়ে পূজনীয়।
আর মধু কবি মাইকেল? তাঁর চরম আর্থিক সঙ্কটের সময় বিদ্যাসাগরের সহৃদয় সহযোগিতা জীবনব্যাপী মনে রেখেছেন তিনি। কবিতায় বলতেও দ্বিধা করেননি- শুধু বিদ্যার সাগর নয়- দয়ার সাগর- করুণার সিন্ধু। তবে দয়া, বিদ্যা আর পা-িত্যকে অতিক্রম করে যে মানবিক বোধ, অজেয় পৌরুষ, চারিত্রিক দৃঢ়তা, মাতৃভূমি আর ভাষায় অনমনীয় চৈতন্য এ সবই উনিশ শতকীয় এই নবজাগৃতির প্রবাদ ব্যক্তিত্ব বিদ্যাসাগরের যুগোত্তীর্ণ কর্ম সাধনা।
লেখক : সাংবাদিক