আগামী ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এই দিন আমরা জাতির পিতাকে কি দিয়ে সম্মান-শ্রদ্ধা জানাতে পারি? এ প্রশ্ন মাঝে মাঝেই মাথায় ঘোরে। এক কথায় সবাই বলে চলেছে বঙ্গবন্ধুর দেশ গঠনের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করাই হবে বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানো। সেটিই কি সবটা? না, আমার মন মানে না। রাষ্ট্রের অবকাঠামো, সব সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, সব সম্পদের উৎস এবং জনগণের জীবিকার উন্নয়ন সব সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য, অবশ্য যদি সে সরকার আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-আদর্শে বিশ্বাসী হয়, তবেই। নতুবা যুদ্ধাপরাধী-মিত্ররা সরকার গঠন করলে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রিত্ব প্রদান শুধু নয়, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার বন্ধ করার মতো অসভ্য, বর্বর ইনডেমিনটি আইন করে সুরক্ষা দেয়, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি ও অর্থনীতি ও ক্ষমতার উচ্চ শিখরে বসিয়ে দেয়! কি অদ্ভুত! এই পাকিস্তানপন্থী রাষ্ট্র শাসনের ধারা দীর্ঘদিন চলার পর অবশেষে আবার ২০০৯ মুক্তিযুদ্ধপন্থী সরকার গঠিত হবার পর একদিন যা ছিল অসম্ভব কল্পনা- বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেল হত্যার বিচার হলো, যারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে, যারা ছিল সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী, সেই ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের অভাবনীয়ভাবে বিচার করে ফাঁসির দন্ড দেয়া সম্ভব হয়েছে! কী অসাধারণ জাতি এই বাঙালী ! অসম্ভবকে সে কতবার সম্ভব করেছে! ’৭১-এ এত হত্যা-নির্যাতন, ধর্ষণ, বাড়িঘর, গ্রাম, জনপদ ধ্বংস করার মধ্যেও বিজয় ছিনিয়ে এনেছে! আবার প্রায় পাকিস্তানে রূপান্তরিত হওয়া এক কি¤ু¢ত উটের পিঠে চড়া অচেনা স্বদেশকে শত শত নতুন জন্ম নেয়া জঙ্গী-হার্মাদ, খুনি গোষ্ঠীর কাছ থেকে ছিনিয়ে এনে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের পথে দাঁড় করিয়েছে! ওদিকে আবার তরুণ প্রজন্ম, প্রযুক্তি আসক্ত, ইতিহাস চেতনাহীন বলে যাদের আমরা ভরসা করতাম না, হঠাৎ আকস্মিক এবং অত্যাশ্চর্য এক মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্লোগান নিয়ে তারা একদিন সংঘটিত করল গণজাগরণ মঞ্চ! সত্যি, বাঙালী এমন ঘটনা ঘটাতে পারে, সম্ভবত আর কোন জাতি এমন পুনরুত্থান, বার বার, ঘটাতে পারেনি!
সেই গর্বিত বাঙালী তার জাতির পিতাকে আগে সম্ভব না হলেও তাঁর শতবর্ষে তাঁর সে আরাধ্য এবং গভীর উপলব্ধিজাত বাঙালী সংস্কৃতির সঞ্জিবনী বীজ-ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন একাত্বতাবোধকে তাঁর কাছে ফিরিয়ে দিয়ে তার প্রধান দায় মোচন করবে। এটিই হবে জাতির স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং বাঙালী জাতিকে প্রথম বারের মতো স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দেয়া মহান বিশ্ব নেতাকে তাঁর কাক্সিক্ষত যথোপযুক্ত উপহার দেয়া। এটি হয়তো হবে- মাছের তেলে মাছ ভাজার মতোই, তাঁরই মূল্যবান হিরক খন্ডটি দুর্বৃত্তের হাতে দখল হয়ে যাওয়ার পর কৃতজ্ঞ জাতি সেটি উদ্ধার করে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে নিজেরাও সেই হিরক খন্ডের দ্যূতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
আমি প্রকৃত অর্থেই একটি ক্রান্তিকালকে বর্তমানে অতিক্রম করছি- যে কালটি আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে একটি বন্ধ দুয়ার যেটি এখন অর্গল মুক্ত হয়ে আমাদের ’৭৫-এর পর স্বাধীনতার অনেক হারিয়ে যাওয়া অমূল্য রত্ন ফিরে পাওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। স্মরণ করতে হবে, এই সুযোগ বারবার আসবে না, আরও একবার আসবে কি-না সন্দেহ, যদি আসেও হয়তো তখন পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকূল নাও থাকতে পারে। এসব ভাবনা-চিন্তা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রীকে বাঙালী জাতির স্বার্থে জাতির পিতার স্বপ্ন শুধু নয়, পুরো পৃথিবীতে বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একটি সংস্কৃতি ও সভ্যতার উত্তরাধিকার যে বাঙালী জন্ম থেকেই লাভ করেছে- সেটি হচ্ছে ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, মানবিক কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, যাত্রা, পালা, নাটকে সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে সংবিধানে পুনঃস্থাপন করে জাতীয় জীবনকে তার প্রকৃত যাত্রাপথের প্রধান ধারা হিসেবে অনুশীলন করার সুযোগ সৃষ্টি করা। এ কাজটি করবার সময়- এখনই। প্রধান মন্ত্রী ও সরকারকে সময়-সুযোগ বুঝতে হবে। বুঝতে হবে বঙ্গবন্ধুর মূল দর্শনকে যারা ক্ষত-বিক্ষত করেছিল তারা এখন বাঙালীর ইতিহাসের খলনায়ক, সিরাজ-উদ-দৌলার সময়ে ক্লাইভ ও মীর জাফরের সমান ঘৃণ্য।
কোন বাংলাদেশ দেখলে বঙ্গবন্ধু আনন্দিত হবেন? এ প্রশ্ন আমরা প্রত্যেকে নিজেরা নিজেকে করতে পারি এবং করা উচিত। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে- তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ এর রূপ রেখায় তিনি ’৭২-এর সংবিধানে উপস্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের সুপ্রাচীন ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি যা- লালন সাঁই থেকে শুরু করে হাজার হাজার সাধু-সাঁই লোক সঙ্গীতকার, গায়ক, শত শত পীর ও যে অসাম্প্রদায়িক মানবিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে পরবর্তী সময়ে যুক্ত হয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুভাষ বসু, নজরুল ইসলাম, পরবর্তীকালে বেগম রোকেয়া এবং ‘শিখা গোষ্ঠী’র কবি সাহিত্যিকরা এই একই ধর্ম নিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছেন, করেছেন মুক্তবুদ্ধির অনুশীলন, ধর্মের ঘেরা টোপ থেকে মুক্ত করেছেন বোধ ও চেতনাকে। কি অসাধারণ এই কীর্তি! আশ্চর্য বোধ হয় এই কথা ভেবে যে- অনেক উজ্জ্বল রাজনীতিকরা এসেছেন, চলে গিয়েছেন, কিন্তু বাঙালীর এই অসাধারণ ধর্মীয় ভেদ-বুদ্ধিহীন ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক, উজ্জ্বল গভীর বোধটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুই উপলব্ধি করেছিলেন! অনেক উচ্চশিক্ষিত রাজনীতিকরা রাজনীতি চর্চা করেছেন, কিন্তু বাঙালীর রাজনীতির মন্ত্র বীজ-ধর্ম নিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক মানবতা বোধকে একমাত্র বঙ্গবন্ধুই কেন একলা মনের গহীনে উপলব্ধি করে উচ্চারণ করতে পারলেন- ধর্ম থাকবে যার যার জীবনে, রাষ্ট্র চলবে সংসদে প্রণীত আইন অনুযায়ী! এখন আমরা কতভাবেই এই অনুভূতিকে প্রকাশ করছি- ধর্ম যার যার, উৎসব সবার, ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান- আমরা সবাই বাঙালী।
এটা ঠিক যে, ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২৬ বছরে যখন ধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রকে সংবিধান থেকে তুলে দিয়ে, সমাজে ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেবার পর- রাষ্ট্রের চেহারা- চরিত্রকে বদলে ফেলা হয়েছিল। সে প্রেক্ষিতে ধর্ম হলো ধর্মান্ধতা, ধর্মের নামে উগ্র মৌলবাদিতা প্রসার লাভ করে ধর্ম নিরপেক্ষ, প্রগতিশীল ব্যক্তি- দলকে কোণঠাসা করে, পরবর্তী সময়ে ’৭১-এর মতই তালিকা তৈরি করে গুম, হত্যা শুরু করেছিল, তাদের কঠোর হস্তে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মহাজোট সরকার নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রকে ধর্মান্ধতা জঙ্গী-জেহাদীদের উত্থানকে দমন করে পুরো পৃথিবীতে প্রশংসিত হয়েছে। সুতরাং, এখন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রাষ্ট্রকে তার স্বমহিমায় ফিরিয়ে আনা দায় সরকার ও সংসদের। পাশাপাশি, জঙ্গী তোষণকারী দল ও ব্যক্তি তারা সমাজে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করেছে, সংখ্যালঘু, দরিদ্র, জেলে, আদিবাসী, সাঁওতালদের ওপর হামলা, নির্যাতন, সম্পদ লুট, অগ্নিসংযোগ করেছে, মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সাইবার অপরাধ করেছে- তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে- যাতে তারা ভবিষ্যতে আবারও তাদের সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত ফণা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে তুলতে না পারে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর মানবিক, ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন সহজসাধ্য হবে।
বঙ্গবন্ধুকে এক সময় কোন কোন গোষ্ঠী তার সহকর্মীদের তুলনায় কম শিক্ষিত বলার চেষ্টা করেছে। অথচ তাঁর অন্য যে কোন সহকর্মীর চেয়ে তাঁর কাজগুলো এবং ভাষণের মাধ্যমে দেখি তিনিই উচ্চ শিক্ষিতের দৃষ্টিভঙ্গি, মেধা, দক্ষতা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং একই সঙ্গে ধর্মভীরু ধর্ম নিরপেক্ষ!
সমাজতন্ত্রী না হয়েও তাঁর মুখে শুনতে পাচ্ছি- কে আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, কে আমাদের খাদ্য দেয়, কাদের টাকায় আমরা ডাক্তার সাব, ইঞ্জিনিয়ার সাব হয়েছি? আমার গরিব কৃষক, শ্রমিকের টাকায়, তাদের সম্মান করে কথা বলবেন- শুনে গাঁয়ে কাঁটা দেয়! যতবার শুনি ভাবি, একজন লেনিনই তো এভাবে কথা বলতেন। চমৎকৃত ও মুগ্ধ হয়ে বাঙালী এখনও তাঁকে শোনে, ভবিষ্যতেও শুনবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক