১৯৭১ সালের ১৬ মে দিনটি ছিল রবিবার। ২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যা অভূতপূর্বভাবে গোটা বাঙালী জাতিকে একতাবদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগের ৬-দফাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক দফায় একীভূত করেছে। বাঙালীর বন্ধনমুক্তির কাজটি পরিণত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জবরদখল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে। এইদিন চুনারুঘাট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে তেলিয়াপাড়ার কাছে ক্যাপ্টেন মতিনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সৈন্যদের এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে পাকবাহিনীর একটি গাড়ি ধ্বংস হয় এবং অসংখ্য পাকসেনা হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর যুব শিবির কর্মসূচীর সূত্রপাত হয়। এর আগে যোদ্ধা নিয়োগ সম্পর্কিত কোন নীতিমালা ছিল না। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেরাই প্রশিক্ষণ শিবির সংগঠিত করে। রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা পাকবাহিনীর ওপর আকস্মিক আক্রমণ চালায়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ২৫ জন সামরিক শিক্ষার্থী নিহত হয়। চট্টগ্রাম মুসলিম হলে সিরাত সম্মেলনের শেষ দিনে সিরাত সম্মেলনের অজুহাতে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল চৌধুরী রহমত এলাহী বলেন, পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিপন্নকারীদের নির্মূল না করা পর্যন্ত মুসলমান ভাইয়েরা ঘরে ফিরবে না। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সিটি কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম চৌধুরী। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী নারায়ণগঞ্জ ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। তিনি দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) কঠোর হস্তে দমনের জন্য সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। পরে নিয়াজী ঢাকার কয়েকটি অঞ্চলও পরিদর্শন করেন। ঢাকায় ৫৫ জন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক, কলেজ শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক ও শিল্পী এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, গত মার্চে দেশের প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারকে অমান্য করার কাজ পুরোদমে চলছিল। নির্বাচনে জনগণের কাছ থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের ম্যান্ডেট পেয়ে চরমপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিতে সম্প্রসারিত ও রূপায়িত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। যারাই জনতার অর্পিত আস্থার প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতায় অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে তাদের ওপর দুর্দিন নেমে এসেছিল। এ সময় ব্যাপকভাবে শিক্ষাঙ্গনকে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কাজে অপব্যবহার করা হতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সমরাস্ত্রের গোপন ঘাঁটিতে পরিণত করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের অভাব-অভিযোগ রয়েছে। আমাদের এই অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামোর আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ভোট দিয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের চরমপন্থীরা এই সহজ সরল আইনসঙ্গত দাবিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিতে রূপান্তরিত করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। আমরা কখনও এটি চাইনি, ফলে যা ঘটেছে তাতে আমরা হতাশ হয়েছি। পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসেবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর তা আমাদের আয়ত্তের মধ্যেই এসে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক তখনই চরমপন্থীরা জাতীয় অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলল। নেমে এলো জাতীয় দুর্যোগ। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী হবার সঙ্গত কারণ রয়েছে। পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূল হবার সঙ্গে সঙ্গে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন। এ অবস্থায় আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন রকম হস্তক্ষেপের বিরোধিতা ও নিন্দা করছি। বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- ড. সাজ্জাদ হোসেন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, মীর ফখরুজ্জামান, ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, নুরুল মোমেন, জুলফিকার আলী, আহসান হাবিব, খান আতাউর রহমান, আশকার ইবনে শাইখ, ড. মোহাম্মদ আলী, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, মুনির চৌধুরী, এ এইচ চৌধুরী, আবদুল্লাহ ইউসুফ ইমাম, শাহনাজ বেগম, ফরিদা ইয়াসমিন, আবদুল আলিম, খন্দকার ফরিুক আহমদ, এমএ হামিদ, নীনা হামিদ, লায়লা আর্জুমান্দ বানু, শামসুল হুদা চৌধুরী, বেদারুদ্দিন আহমদ, সাবিনা ইয়াসমিন, ফেরদৌসী রহমান, মোস্তফা জামান আব্বাসী, সরদার জয়েনউদ্দীন, সৈয়দ মুরতাজা আলী, কবি তালিম হোসেন, শাহেদ আলী, কবি আবদুস সাত্তার, ফররুখ সিয়ার, কবি ফররুখ আহমদ, সম্পাদক আবদুস সালাম, সম্পাদক বদরুদ্দিন, সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন, ফতেহ লোহানী, হেমায়েত হোসেন, বি রহমান, মবজুলুল হোসেন, আকবর উদ্দিন, এএফএম আবদুল হক, অধ্যক্ষ একিউএম আদমউদ্দিন, আলী মনসুর, কাজী আফসারউদ্দিন আহমদ, সানাউল্লাহ নূরী, সামশুল হক, সরদার ফজলুল করিম, বদিউজ্জামান, শফিক কবির, ফওজিয়া খান ও লতিফা চৌধুরী। এইদিন সকাল বেলা। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৬টি ভ্যান রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার যোগীশো গ্রামে পৌঁছায়। গ্রামে মিলিটারি প্রবেশ করেছে খবর পেয়ে পুরো জনপদ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বিশেষত হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা সকলেই পরিবারসহ পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে আত্মগোপন করে। পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে আগত রাজাকার ও তাদের সহযোগীরা ও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল আজিজ সরকার জড়িত ছিলেন মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে। তিনি এ অঞ্চলের পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সহযোগী হিসেবে কাজ করলেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি তার অনুজ আব্দুল কাদেরের (পোস্টমাস্টার) মাধ্যমে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে আত্মগোপনে চলে যেতে খবর পাঠান। কিন্তু কাদের মাস্টার তার অগ্রজের বার্তা পৌঁছে না দিয়ে বরং হিন্দু-মুসলিমের সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হবে মর্মে বার্তা দেন। এ ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যাচারের মাধ্যমে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আব্দুল কাদের মাস্টার, তার ঘনিষ্ঠ সঙ্গী মোজাফফর মাস্টার ও তার সহযোগীদের মাধ্যমে বসতবাড়ি ও জঙ্গলে লুকিয়ে থাকা হিন্দু ও মুসলমানদের ঘটনাস্থল স্কুলে সমবেত করা হয়। ’৬২ সালে যে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছিল এর অনুরূপ শান্তি কমিটি গঠনের মিথ্যা কথা বলে যোগীশো ও পালশা গ্রামের লোকদের যোগীশো প্রাইমারি স্কুলে জড়ো করা হয়। জনতা সমবেত হলে পাকিস্তানী বাহিনী হিন্দু-মুসলিমদের পৃথকভাবে সারিবদ্ধ করে এবং অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করে। এরপর স্কুল মাঠের উত্তর দিকে মাটির ঘরের পেছনে শুধুমাত্র হিন্দুদের নিয়ে গিয়ে বন্দুকের বাঁট দিয়ে পেটাতে থাকে। ফলে রক্তাক্ত হয়ে যায় সকলে। তাদের উপুড় করে বন্দুকের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো হয়। নির্যাতনের একপর্যায়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের। গণহত্যার বীভৎসতা এতই নির্মম ছিল যে, মানুষের রক্ত ও মগজ ঘটনাস্থলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। যাদের বুলেটের আঘাতে মৃত্যু হয়নি, রক্তাক্ত অবস্থায় নড়েচড়ে উঠার চেষ্টা করলে পাকিস্তানী বাহিনী বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করে। গণহত্যা শেষ হলে নিকটবর্তী ডোবায় সামান্য মাটি খনন করে মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়। যারা এই বধ্যভূমি খনন এবং মাটিচাপার কাজে সম্পৃক্ত ছিল তারা হলেন- যোগীশো স্কুল সংলগ্ন বাসিন্দা সওদাগর শাহ (৯৫), সোলাইমান আলী (৬৫), শুকুর আলী (৭০) প্রমুখ। গণহত্যার পর পাকিস্তানী বাহিনী ও দালালরা মিলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর লুটপাট করে। গণকবর দেয়ার পরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল ত্যাগ করে ফিরে যাওয়ার পথে হাটকানপাড়া সংলগ্ন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা অছির উদ্দীনের বড়বাড়ির ৮টি ঘর পুড়িয়ে দেয়। এইদিন রেলগাড়িতে করে আসেন পাক-আর্মিরা। বোয়ালমারী স্টেশন থেকে বহর নিয়ে মার্চ করেন হাসামদিয়ার দিকে। এরপর হাসামদিয়া গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে হত্যা করে ১৩ জন সংখ্যালঘুকে। পরে একে একে রামদিয়া, পোয়াইল, ময়েনদিয়া, শ্রীনগর ও রাজাপুর গ্রামের আরও ২০ জনকে হত্যা করা হয়। আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয় ঘরবাড়িসহ ময়েনদিয়াবাজার। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার ছয়টি গ্রামের মোট ৩৩ জন গ্রামবাসীকে। দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকা ‘বাংলাদেশর সংগ্রাম বৃথা যাবে না’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে, প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, আজ আশা প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম বৃথা যাবে না। তারা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা এবং তার থেকে গণতান্ত্রিক সরকার অর্জন করবেন। মোহনপুরে একটি বিশাল সমাবেশে তিনি বলেন, ভারত পূর্ববাংলায় একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে তাকে স্বাগত জানাবে এবং তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখবে। ভারতের মতো পূর্ব বাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে মানুষ তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করতে পারেনি যা তাদের দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে সাহায্য করবে। ভারত এবং পূর্ব বাংলার মানুষ গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করবে এবং তারা নিজেরাই তাদের নিজ নিজ জাতির স্বার্থে সাম্প্রদায়িকতার বিষয়কে আশ্রয় দেবে না। এটি শুধু পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার ছিল, কিন্তু এখন এটি ভারতের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মানুষগুলো তাড়াতাড়ি তাদের দেশের শান্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবে এবং তাদের নিজস্ব সরকার গঠন করে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]