ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিষয় প্রকরণে দিলারা হাশেমের উপন্যাস

প্রকাশিত: ০৯:৪৮, ২৯ মার্চ ২০১৯

  বিষয় প্রকরণে দিলারা হাশেমের উপন্যাস

জান্নাতুল যূথীর ‘দিলারা হাশেমের উপন্যাস বিষয় ও প্রকরণ’ গ্রন্থটি ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ পায়। অক্ষর প্রকাশনা বইটি বের করে। প্রচ্ছদ আঁকেন মোস্তাফিজ কারিগর। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী জান্নাতুল যূথীর স্নাতকোত্তর পর্বের গবেষণামূলক অভিসন্দভকে নতুন আঙিকে বই-এর উপযোগী করে পাঠককে উপহার দেয়া হয়। শুরুতেই গ্রন্থাকার সে বিষয়ে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন। জীবনের সবচাইতে নিকটজন বাবা-মাকে গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে। ষাট এবং পরবর্তী সময়ের পথিকৃৎ উপন্যাসিক দিলারা হাশেম শিল্পসত্তায় সমৃদ্ধ একজন অনন্য সৃজন সাধক। এমন গুণীজনের পরিচিতিও ব্যাপক এবং সর্বজনবিদিত। পাঠক মাত্রই তার নান্দনিকতায় মুগ্ধ, বিমোহিত। শুধু শৈল্পিক অনুরণনই নয় সমকালীন সমাজ, সংস্কার, গতানুগতিকতাকে গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে লালন করা এই বিদগ্ধ উপন্যাসিক নারীর অধিকার ও সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তেমন এক সৃজন ব্যক্তিত্বের উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করা সত্যিই দুরূহ এবং দুঃসাহসিক কর্মযোগ। গবেষক সেই মাত্রারই একজন সাহসিক মনন এবং কলম যোদ্ধা। প্রথম অধ্যায় ‘পরিপ্রেক্ষিতে’ লেখক উপন্যাসের আদি ইতিহাস স্মরণ করতে গিয়ে এর আধুনিক বলয়কেই নির্ণীত করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছান প্রাচীন সাহিত্যে উপন্যাসের কোন আদল আসলে সেভাবে তৈরি হয়নি। যা শুধু বাংলা সাহিত্যেই নয় বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায়ও এর পুরাকালের কোন ইতিবৃত্তের নজির নেই। সঙ্গত কারণে উপন্যাস নতুন ও আধুনিক সময়ের এক উল্লেখযোগ্য নন্দন তত্ত্ব যেখানে ব্যক্তি মানুষ, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিম-লের এক বৃহৎ সংযোজন। সমৃদ্ধ বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের নবধারার কৃতিত্বে আঙ্গিক ও বৈশিষ্ট্যের রূপকার হিসেবে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্রকেই অভিনন্দন জানাতে হয়। তবে প্যারিচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ উপন্যাসের গোড়া পত্তন করলেও গবেষক জান্নাতুল মনে করেন এটি মূলত একটি সামাজিক নকশা। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের গতি প্রকৃতি নির্ণয় করতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে যে সমৃদ্ধ অবয়ব তৈরি হয় সেটাকেই বাঙালীর সৃজন দ্যোতনার শ্রেষ্ঠ উপহার হিসেবে তুলে ধরা হয়। তুলনামূলক আলোচনা, যা গবেষণায় অত্যন্ত জরুরী সেখানে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস বলয়কে প্রাথমিক স্তরে বঙ্কিমী প্রভাব হিসেবে উল্লেখ করা হলেও শেষ অবধি বিশ্বকবি আপন সৃজন দক্ষতায় নিজস্ব ধারা তৈরি করতেও বেশি সময় নেননি। দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপন্যাস ও দিলারা হাশেমকে নিয়ে তার নান্দনিক অভিগামিতাকে সমাজ সংসারের আবর্তে পারিপার্শ্বিক আবহের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন গ্রন্থের নির্মাতা। এক সময় সঙ্গীতের প্রতি অনুরোক্ত দিলারা হাশেম অল্প বয়স থেকে সাহিত্য সাধনায় মনোনিবেশ করেন বলে লেখক জানিয়ে দেন। তৃতীয় অধ্যায়ে দিলারা হাশেমের সৃজনকল্পে সমাজ ভাবনার যে বিদগ্ধ চিত্র উপস্থাপিত হয় তাও লেখকের মননসত্তার অনুষঙ্গ হয়। সমাজ এবং ইতিহাসের স্বচ্ছ প্রতিবেদন বৃহদাকার এই সাহিত্যে সম্পদ। সেই আলোকেই দিলারা হাশেম সময় এবং প্রচলিত ধারাকে অনুধাবন করে তার সৃষ্টিযজ্ঞে দেশ, মানুষ তার মাটির সন্ধানে নিজেকে বিলিয়ে দেন। শিল্পিত অনুভবে নান্দনিকতার যে অপার সম্মোহনী শৌর্য সেখানে বাস্তবের কষাঘাত পড়তেও বেশি সময় লাগে না। আর এই বিদগ্ধ উপন্যাসিককে তুলে ধরা হয়েছে সময়ের গতি প্রবাহেই শুধু নয় প্রথাসিদ্ধ সমাজের প্রতিপক্ষ শক্তি হিসেবেও। আর সেটা করতে গিয়ে অর্ধাংশ নারী জাতিও তার শৈল্পিক সত্তায় ভর করে, বিশেষ দায়বদ্ধতায় তাদের প্রতি সচেতন হন এবং বৈষম্য পীড়িত এই গোষ্ঠীর প্রতি সমঅধিকার আদায়ে সোচ্চারও হন। নারীকে শুধু আপন ভাগ্যজয় করা নয় প্রতিদিনের যাপিত জীবনের দুঃসহ পরিক্রমাও সদর্পে অতিক্রম করা সময় ও যুগের দাবি। সেই লক্ষ্যে তার উপন্যাসের নায়িকারা জীবন যুদ্ধের ঘূর্ণাবর্তে আটকে পড়লেও এক সময় তারা সংগ্রামী অভিযাত্রাকে পাড়ি দিতে সক্ষম হয়। সেখানে সংস্কারাচ্ছন্ন মায়েদেরকে সমস্ত কূপম-ূকতা থেকে বের হয়ে আসতে প্রাণিত করেছেন তার শিল্পিত চর্চার বিচিত্র অনুভবকে জাগিয়ে তোলে। অতি বাল্যকাল থেকে অসম অধিকার নিয়ে বড় হওয়া মেয়েরা একটি নির্দিষ্ট গ-ি থেকে বের হতে অনেক হিমশিম খায়। সেই সব সীমারেখাকে অদম্য চেতনায় পার হতে না পারলে নিজেদের টিকিয়ে রাখা মুশকিল। যেহেতু বইটি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সমন্বয়ে এক সুসংহত রচনাশৈল সেহেতু এর সাহিত্যিক মাত্রাও নিঃসন্দেহে অনন্য। এমন জ্ঞান এবং বয়োবৃদ্ধ উপন্যাসিককে সামনে এনে তার রচনাসম্ভার আলোচনায় নিয়ে আসা এক অসাধারণ মনন দক্ষতা। লেখক শুধু যে দিলারা হাশেমকে পাঠকের কাছে উপহার দিয়েছেন তা কিন্তু নয় তার চেয়েও বেশি বিদ্যমান অবস্থা তারই আলোকে তৈরি হওয়া সমাজ, সংস্কার, ইতিহাসও সচেতন পাঠককে নানামাত্রিকে আগ্রহান্বিত করে তুলবে। গত হওয়া বিভিন্ন সময়ের যথার্থ গতি প্রবাহও পাঠককে অনেক কিছু জানতে নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করবে। লেখককে ধন্যবাদ এমন একজন গুণীজনই শুধু নন বাংলাদেশের সংগ্রাম-আন্দোলনের যথার্থ পরিপার্শ্বিক অবস্থাকেও পাঠকের সামনে নিয়ে আসায়। গ্রন্থটি পাঠক প্রিয়তা পাবে নিঃসন্দেহে এর বহুল প্রচারেও কোন বিঘ্ন ঘটবে না।
×