ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেলেও অবজ্ঞার শিকার বাংলা

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

 আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেলেও অবজ্ঞার শিকার বাংলা

মনোয়ার হোসেন ॥ বিয়েটা বাঙালীর। কিন্তু অতিথিদের পাঠানো আমন্ত্রণপত্রের ভাষাটি ইংরেজী। অথচ ইংরেজী নিমন্ত্রণপত্র বিলানো সেসব বিয়েতে থাকেন না কোন বিদেশী অতিথি। বাংলা ভাষার প্রতি এমন হীনম্মন্যতার চালচিত্র এখন নিত্যদিনের। শুধু বিয়ের আমন্ত্রণপত্র নয়, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে অকারণেই বাংলার বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে ইংরেজী। ভাষা শহীদদের রক্তঋণে পাওয়া মাতৃভাষা অবজ্ঞার শিকার রকমারি তরিকায়। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগুলো নর্থ-সাউথ থেকে দৌড় দিচ্ছে ইস্ট-ওয়েস্টে। ইংরেজী প্রীতিতে ভরপুর বিভিন্ন বেসরকারী ব্যাংকের নাম হচ্ছে প্রাইম থেকে প্রিমিয়ার। দোকানের সাইন বোর্ডগুলোয় বড্ড কোণঠাসা আ-মরি বাংলা ভাষা। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা ও অমান্য করে অধিকাংশ দোকান থেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে যুক্ত এখন ইংরেজী বর্ণমালা। অকারণে বিপণিবিতান থেকে রেস্তরাঁ সবখানেই উঁকি মারে ইংরেজী নাম। শিকড়বর্জিত অতি আধুনিক তরুণ-তরুণীর মুখে অবলীলায় উচ্চারিত হয় বাংলা-ইংরেজীর মিশ্রিত বিকৃত বাংলিশ। রেডিও জকির কথায় জড়িয়ে থাকে বাংলা ভাষার বিকৃতির ছোঁয়া। ভাষায় মর্যাদা রক্ষায় নানা নির্দেশনা দিলেও খোদ উচ্চ আদালতের রায়গুলো এখনও লেখা হয় ইংরেজীতে। এভাবেই লাঞ্ছনা আর অপমানে গুমরে মরছে ভাষা শহীদদের রক্তঋণে অর্জিত বাংলা বর্ণমালা। ফেব্রুয়ারি এলেই যেন কিছুটা কদর বাড়ে বাংলা ভাষার। ভাষার মাসটি পেরুলেই আবার শুরু হয় অবহেলা-অনাদর। বাংলা ভাষার প্রতি এমন অবজ্ঞা নিয়ে প্রায়শই কথা হয় নানা সভা-সেমিনারে। ভাষা সংগ্রামীসহ স্বদেশকে ভালবাসা মানুষেরা সোচ্চার থাকেন মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায়। তবে আপন ভাষার প্রতি বাঙালীর দায়বদ্ধতা ও শ্রদ্ধার বিষয়গুলো যেন হয়ে ওঠে শুধুই কথার কথা। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় নেযা হয় না যথাযথ পদক্ষেপ। নির্বিকার থাকে ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য গড়ে তোলা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে সংস্থাসমূহ। সরকারের পাশাপাশি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় নেই কোন বেসরকারী উদ্যোগ। বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধের পাশাপাশি মর্যাদা রক্ষা এবং মাতৃভাষার প্রতি অবজ্ঞা-অবহেলা বন্ধের নানা যুক্তি ও মতামত মেলে ধরেছেন বিশিষ্টজনরা। ইংরেজীতে রায় লেখাসহ নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা ভাষার বিষয়ে খোদ উচ্চ আদালতের সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠে এসেছে তাদের কথায়। অমর একুশের অহঙ্কারে উদ্দীপ্ত বাংলা ভাষার সম্মান রক্ষায় সেসব মানুষের মন্তব্যগুলো উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে। এ বিষয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করে ভাষা সংগ্রামী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের জাতির দুর্ভাগ্য যে পদে পদে লাঞ্ছিত হচ্ছে বাংলা ভাষা। মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যেসব ছাত্র-জনতা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, বাংলা ভাষাকে নানাভাবে অবজ্ঞা করে আজ তাদের অপমান করা হচ্ছে। ভাষা আন্দোলনের ৬৭ বছর পরও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে আমাদের। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, যেমন খুশি তেমনভাবে বাংলা ভাষাকে অবহেলা-অপমান করা হচ্ছে। আজ আফসোস নিয়ে বলতে হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের মাতৃভাষাকে রক্ষা করা এই উচ্চ আদালতের রায় লেখা হচ্ছে ইংরেজীতে। বিচারপতি গোলাম রাব্বানীসহ কয়েকজন বাংলায় রায় লিখলেও পরবর্তীতে আর সেটির প্রচলন হয়নি। ষাটের দশকে এই বাংলা ভাষা যতটা মর্যাদা পেয়েছিল আজ যেন ততটাই অবজ্ঞার শিকার । আমরা ইংরেজী ভাষা ব্যবহারের বিরোধী নই। এমনকি বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষারও সমান অধিকার চাই আমরা। তাই বলে সেটা বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে নয়। ইদানীং নতুন প্রজন্মকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়ানোর প্রতি অভিভাবকদের অতি আগ্রহের আড়ালে লুকিয়ে ব্যবসায়িক মনোভাব। তারা ভাবছে, সন্তানটি ইংরেজী মাধ্যমে পড়লে বিদেশ যাওয়া খুব সহজ হবে। পাশাপাশি কর্পোরেট সেক্টরসহ বড় বড় পদের চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও সুবিধা পাবে। এ অবস্থায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু নির্দেশনা দিয়ে ভাষার মর্যাদা রক্ষা নয়, বরং সেসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। বৈশ্বিক প্রয়োজনেই বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে ইংরেজী ভাষা আমাদের দ্বিতীয় ভাষা হতে পারে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বিভিন্ন সাইনবোর্ড কিংবা ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ইংরেজী নামকরণের মাধ্যমে আমরা হীনমন্যতার পরিচয় দিচ্ছি। এখানে মাতৃভাষাকে ভালবাসার জন্য যে মানসিকতা থাকা প্রয়োজন, সেটার অভাব দেখা দিচ্ছে। এক সময় ব্যাংকের সব কাজকর্ম হতো বাংলা ভাষায়। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তিগত সমস্যাকে অজুহাত করে ইংরেজীতে চলছে কাজকর্ম। অথচ চাইলেই বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করে একই প্রযুক্তির সাহায্যে কাজ করা যায়। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বাংলা ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে সরকারী উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারী উদ্যোগের সমন্বয় ঘটাতে হবে। শুধু সরকারী উদ্যোগের মাধ্যমে মাতৃভাষার মান-মর্যাদাকে তার যথার্থ স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে ভাষা আন্দোলনের গবেষক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক গোলাম কুদ্দুছ বলেন, আমাদের সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে লেখা আছে- এই প্রজাতন্ত্রে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। অথচ সংবিধান লংঘন করে ইংরেজীতে লেখা হচ্ছে উচ্চ আদালতের রায়। যেখানে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, সাইনবোর্ড লেখাসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে, সেখানে খোদ আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে ইংরেজীতে। সরকারী-বেসরকারী অফিসে অকারণেই ইংরেজীর ব্যবহার হচ্ছে। লোক দেখানোর জন্য অহেতুকভাবে বিয়ের আমন্ত্রণপত্র লেখা হচ্ছে ইংরেজীতে। এমনকি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রেও অযথা ইংরেজী ব্যবহার হচ্ছে। সেমিনার থেকে শুরু করে চিঠিপত্রে কারণ ছাড়াই ইংরেজীর বাহুল্য দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাষার ব্যবহার হয়। অথচ আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ইংরেজী ছাড়া উপায় নেই। এক্ষেত্রে আমাদের যথার্থ অনুবাদের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। অফিস-আদালতে শুধু বৈদেশিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ইংরেজীর ব্যবহার আবশ্যিক হলেও সেটা মানছে না কেউ। সবাই যেন ভুগছে ইংরেজী প্রীতিতে। এভাবে আমরা নানাভাবে বাংলা ভাষা ও ভাষা শহীদদের প্রতি অবজ্ঞা এবং অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করছি। বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেলেও আমরা নিজেরাই প্রতিনিয়ত সে ভাষার অমর্যাদা করছি। তাই বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় প্রয়োজনে মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারী সংস্থা ও দেশের প-িতজনদের নিয়ে এই সেল গঠন করতে হবে। এই সেলের কাজ হবে সাইনবোর্ড থেকে শুরু করে অফিস-আদালতের কার্যক্রম, শিক্ষা কার্যক্রম, চিঠিপত্রের আদান-প্রদান, টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করা। বিভিন্ন তথ্য সূত্রে জানা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে বছর পাঁচেক রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলা ভাষা প্রচলিত হয়েছিল। এ সময় বাংলা ভাষা, প্রশাসন, শিক্ষার মাধ্যম, নিম্ন আদালত প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্রুত চালু হতে থাকে। সত্তর দশকের প্রথমার্ধে সমাজ জীবনের বিভিন্ন স্তরে পূর্ণ মর্যাদা পেয়েছিল বাংলা ভাষা। কিন্তু এই প্রবণতা রোধ হতে সময় লাগেনি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার ভাগ্যও পরিবর্তিত হতে থাকে। উদাহরণস্বরূপ পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’ আর ‘জয় বাংলা’ হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’। এ সময় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত, জাতীয় পতাকা, এমনকি রাষ্ট্রভাষা পরিবর্তনের অবিশ্বাস্য দাবিও তুলেছিল মৌলবাদীরা। অধচ স্বাধীনতার পর দেশের সব রাস্তাঘাট, দোকানপাট এবং স্থাপনার নাম বাংলা ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছিল। এমনকি ইংরেজ আমলেও সামাজিক অনুষ্ঠানাদি যেমন- বিয়ে, জন্মদিন, পুনর্মিলনী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বাংলা ভাষায় রচিত হতো। কিন্তু বর্তমানে হীনমন্যতায় ভোগা তথাকথিত শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত দ্বারা তা অকারণে ইংরেজীতে রচিত হচ্ছে।
×