অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নিত্যনতুন ইস্যুর ভিড়ে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ফেরত যাওয়ার বিষয়টি বিশ্ববাসীর সামনে যাতে চাপা না পড়ে সেদিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থাগুলো থেকে ৬৮২ মিলিয়ন ডলার তহবিল এসেছে। ওই হিসেবে প্রতিটি রোহিঙ্গা গড়ে পাবে প্রায় ৫৭ হাজার টাকা। কিন্তু এই অর্থের মধ্যে কতটুকু তারা পেয়েছে এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় হিসেবে কতটুকু খরচ করেছে সে হিসেবে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনার জন্য স্থানীয় এনজিওগুলোকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার কথাও বলা হয়েছে।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যবহারে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা তাদের নিজস্ব মতামত তুলে ধরেন। ওই সভায় বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মুখ্যসচিব এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল করিমের সভাপতিত্বে সরকারী-বেসরকারী এবং দাতা সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) ২০১৯-এ কক্সবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি এবং পরিবেশের উন্নয়নে মানবিক এবং উন্নয়ন কর্মসূচীর পরিকল্পনা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে।
আলোচনায় অংশ নেন এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কেএম আবদুস সালাম, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ উইংয়ের মহাপরিচালক নাহিদা সোবহান, জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মায়া সাপো, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)-এর বাংলাদেশ প্রধান জর্জ জিওগারি, ইউএনএইচসিআর-এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি পাপা কাইসমা সিলা, অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধি এবং গ্লোবাল লোকালাইজেশন ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য অনিতা কাট্টাখুজি, কক্সবাজার সিএসও এ্যান্ড এনজিও ফোরাম কো চেয়ার আবু মুর্শেদ চৌধুরী, এডাবের পরিচালক জসিম উদ্দীন, ডিজাস্টার ফোরামের গওহর নঈম ওয়ারা এবং কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর একেএম মুসা। কোস্ট ট্রাস্টের রেজাউল করিম চৌধুরীর সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন একই সংস্থার মোঃ মজিবুল হক মনির। সভায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কিছু বক্তব্য একটি ভিডিও প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। যেখানে রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে তারা স্থানীয়দের বিভিন্ন সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।
আলোচকরা বলেন, প্রতিদিন সারাবিশ্বে নতুন নতুন ইস্যু তৈরি হচ্ছে আবার এসবের ভিড়ে চাপা পড়ছে পুরান ইস্যু। রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশে দীর্ঘ সময় অবস্থান না করে সসম্মানে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখা জরুরী হয়ে পড়ছে।
আবদুল করিম বলেন, নিরাপদ প্রত্যাবাসনের আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের অধিকার এবং মর্যাদা রক্ষায় আমাদের সবার সচেষ্ট থাকতে হবে। শুধু উন্নয়ন সহায়তার স্বচ্ছতা নয়, উন্নয়ন সহায়তার কার্যকারিতা নিয়েও ভাবতে হবে। মুজিবুল হক মনির বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলায় জাতিসংঘ অঙ্গসংস্থাগুলো এই পর্যন্ত যে ৬৮২ মিলিয়ন ডলার তহবিল পেয়েছে। তাতে দেখা যায়, প্রতিটি রোহিঙ্গার জন্য মাথাপিছু করে প্রায় ৫৭ হাজার টাকা এসেছে। এই তহবিলের কত অংশ রোহিঙ্গাদের জন্য আর কত অংশ সংস্থাগুলোর প্রধান কার্যালয় বা মাঠ পর্যায়ে তাদের পরিচালন ব্যয় বাবদ খরচ হয়েছে এই বিষয়েও তথ্য প্রকাশ করা উচিত।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং জাতিসংঘ অঙ্গসংস্থাগুলো তাদের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর অর্থ হলো, তারা সরাসরি প্রকল্প বাস্তবায়ন না করে স্থানীয় অংশীদারদের দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ উইংয়ের মহাপরিচালক নাহিদা সোবহান বলেন, সরকারের উদ্দেশ্য টেকসই, নিরাপদ এবং রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন। এই মানবিক সঙ্কটে বৃহত্তর সমন্বয় খুব প্রয়োজন। স্থানীয় এনজিওদের এই সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ করতে হবে। মায়া সাপ্পো বলেন, অংশীদারিত্বই আমাদের প্রয়াসে সাফল্য আনতে পারে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জানাতে হবে। উন্নয়ন কার্যক্রমে আমাদের আরও বেশি বিনয়ী এবং সহযোগিতার মনোভাব সম্পন্ন হতে হবে এবং উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে আমাদের আশাব্যঞ্জক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
পাপা কাইসমা সিলা বলেন, কক্সবাজারের জনগণের ওপর থেকে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা কমিয়ে আনা আমাদের অন্যতম অগ্রাধিকার। নিরাপদ এবং টেকসই প্রত্যাবাসনই এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান। মিয়ানমার সরকারের সঙ্গেও এ বিষয়ে কাজ করতে হবে, যাতে এই রোহিঙ্গারা নিরাপদে ফিরে যেতে পারে। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম আবদুস সালাম বলেন, প্রত্যাবাসন বিষয়ে সরকারী সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাজ করা উচিত নয়। এনজিওদের কাজ মানবিক সহায়তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে। অনিতা কাট্টাখুজি বলেন, উন্নয়নের স্থানীয়করণের সুপারিশের জন্য আমাদের অপেক্ষা করলে চলবে না, সংশ্লিষ্ট প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে কারণ, এটি শুধু স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিষয় নয়।
আবু মুর্শেদ চৌধুরী রোহিঙ্গাদের জন্য বরাদ্দের মোট ২৫ ভাগ স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য বরাদ্দ করার জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।