১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। ইংরেজদের তুলনায় নবাবের অস্ত্র, গোলাবারুদ, সৈন্য সবই বেশি ছিল। ইংরেজ পক্ষে ছিল তিন হাজার সৈন্য এবং আটটি কামান; এর বিপরীতে নবাব পক্ষের সৈন্য সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজার এবং কামানের সংখ্যা ছিল তিপান্নটি। এত বিপুল সমর-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নবাবের পরাজয় হলো ক্লাইভের গাধা বলে পরিচিত সেনাপতিরা বাংলার স্বাধীনতা বিসর্জন দিল। এই মর্মান্তিক ঘটনাকে অবলম্বন করে সিকানদার আবু জাফর ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটক রচনা করেন। নাট্যকার প্রথম দিকে সিরাজউদ্দৌলাকে মূল্যায়ন করলেও শেষ পর্যায়ে এসে তেমন একটা মূল্যায়ন করেননি।
সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন মির্জা মুহম্মদ আলিবর্দি খাঁর (তিন মেয়ের) ছোট মেয়ে আমিনা বেগমের ছেলে। আশি বছর বয়সে নবাব আলিবর্দি ১০ এপ্রিল ১৭৫৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। নানার মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব নিযুক্ত হন।
সিরাজউদ্দৌলা ছিলেন আলিবর্দির অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। নবাব সিরাজউদ্দৌলা নবাব হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করলে চারদিকে ষড়যন্ত্র ঘনীভূত হয়ে ওঠে। একটি নাটকে যে এক বা একাধিক চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তাদের রূপায়ণের পেছনে সক্রিয় থাকে নাট্যকারের চরিত্রায়ন কৌশল। এদিক থেকে লক্ষ করলে প্রতীয়মান হয় যে, ষড়যন্ত্রে বিপর্যস্ত এক জাতীয় বীর নায়ককে সৃজন করাই ছিল নাট্যকারের কেন্দ্রীয় চরিত্রায়ন কৌশল। লক্ষণীয় যে, বীরের বিপর্যয় দেখাতে গেলে নায়কের বিপ্রতীপ চরিত্রগুলোকেও সমান শৈল্পিক দক্ষতায় সৃজন করা প্রয়োজন। তা না হলে, নায়কের বিপর্যয়কে মহিমান্বিত করে তোলা সম্ভব হয় না। এই বিষয়টি আলোচ্য নাটকে নিরবচ্ছিন্নভাবে অনুসৃত হয়নি। এই চরিত্রগুলোর প্রতিটি একমাত্রিক। ঘষেটি বেগম, ক্লাইভ কিংবা মীরজাফর কেবলই শঠ্-মানসিকতার অধিকারী। মীরমদন, মোহনলাল, রাহসুল জুলাহা তথা নারায়ণ সিংহ কেবলই নীতিবান, শুদ্ধ মানুষ। লুৎফুন্নেসার কোন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই পাঠকের চোখে পড়ে না। কিন্তু দোষেগুণে মিলিয়েই তো মানুষ; যা এই নাটকে অনুপস্থিত। এই একমাত্রিকতার সমস্যা সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে বিদ্যমান। সিরাজউদ্দৌলাও ধীরোদাত্ত, স্থিরপ্রতি, সহানুভূতিশীল; বলতে গেলে প্রায় ত্রুটিহীন। নিকটজনদের পরিত্যাগ করতে না পরিণত হতো, কূটনীতিতে তিনি যদি পারদর্শী হতেন, শাসক হিসেবে তিনি যদি কঠোর হতে পারতেন, অন্তরের দয়া-দাক্ষিণ্যই যদি সময়মতো নিজের ভেতর হতে দূর করতে পারতেন, তাহলে তিনি মানুষ হিসেবে চোট হয়েও শাসক হিসেবে হয়তো বড় হতে পারতেন এবং কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করতে পারতেন। এটা যে, তার অক্ষমতা বা অযোগ্যতা তা নয়। এটা হলো বাঙালী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। এগুলো না পারার কারণেই সিরাজউদ্দৌলার পতন হয়েছে, পতন হয়েছে বাঙালীর ও বাংলার।
সিকানদার আবু জাফর নাটকটির গঠন বৈশিষ্ট্য নিয়ে খুব বেশি নিরীক্ষা করেননি। এমনকি দৃশ্যগুলো কীভাবে মঞ্চায়িত হবে তাও খুব স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করা হয়নি। প্রসঙ্গত, স্মরণ করা যেতে পারে, মুনীর রচিত ‘কবর’ নাটকের কথা; যেখানে আলোর ব্যবহার, মঞ্চের গঠন পরিবেশ প্রভৃতির বিস্তৃত উপস্থাপন লক্ষ করা যায়। তবে ইতিহাসও আশ্রিত নাটকের উপযোগী সংলাপ ব্যবহার সিরজউদ্দৌলা’র অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। সিরাজউদ্দৌলা যখন বলেন, ‘বাংলার বুকে দাঁড়িয়ে বাঙালীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরবার স্পর্ধা ইংরেজ পেল কোথা থেকে, আমি তার কৈফিয়ত চাই’ তখন তার সাহস, বীরত্বই প্রতিভার হয়; যা ইতিহাস-আশ্রিত নাটকের জন্য একান্ত জরুরী।
পলাশীর যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের পর স্ত্রী-কন্যাসহ পাটনার উদ্দেশে সিরাজউদ্দৌলা যখন পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন মীরজাফরের ভাই মিরদাউদ সপরিবারে নবাবকে বন্দী করে রাজধানীতে নিয়ে আসে। গণবিক্ষোভের আশঙ্কায় ক্লাইভ দ্রুত সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করতে চান। তখন মিরনের আহ্বানে মোহাম্মদী বেগ সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করতে রাজি হয়। অথচ সিরাজউদ্দৌলার পিতা জয়নুদ্দিন অনাথ বালক মোহাম্মদি বেগকে আদর যতেœ মানুষ করেছিলেন। অথচ সেই মোহাম্মদি বেগ অর্থের লোভে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। কিন্তু নাট্যকার এখানে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে এভাবে মৃত্যুর মুখোমুখি না করে বিচারের সম্মুখীন করে মৃত্যুদ- কার্যকর করতে পারতেন। কিন্তু নাট্যকার তা না করে জনগণকে বেশি আবেগপ্রবণ ও আকর্ষণ করার জন্য মোহাম্মদি বেগকে দিয়ে দ্রুত হত্যার পথ বেছে নেন।
আমরা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখতে পাই, মোহাম্মদি বেগ যখন সিরাজউদ্দৌলাকে মারার জন্য এগোচ্ছে, তখন সিরাজউদ্দৌলা বলেন, ‘তুমি এ কাজ করও না মোহাম্মদি বেগ। অতীতের দিকে চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ। আমার আব্বা-আম্মা-পুত্রস্নেহে তোমাকে পালন করেছেন। তাদেরই সন্তানের রক্তে সে স্নেহের ঋণ আ...।’ সিরাজউদ্দৌলার এ উক্তির মাধ্যমে লক্ষ করা যায়, তার ভীরুতা ও কাপুরুষতা। তিনি এই উক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করেন, তিনি একজন অপরাধী, তাই তিনি মোহাম্মদি বেগের কাছে প্রাণভিক্ষা চাইছেন। নাট্যকার এখানে একজন নবাব, শাসক বা বীরের প্রতি অবিচার করেছেন। কারণ, একজন বীর মৃত্যুবরণ করবেন বীরের মতো। এটাই স্বাভাবিক। এখানে নাট্যকার সিরাজউদ্দৌলাকে একেবারেই অবমূল্যায়ন করেছেন।
আমরা যদি নাট্যকার মুনীর চৌধুরী রচিত ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের দিকে তাকাই, সেখানে পানি পথের দ্বিতীয় যুদ্ধ হয় মুসলমান ও মারাঠাদের মধ্যে। যুদ্ধের মুসলমানরা জয়লাভ করে এবং মারাঠারা পরাজিত হয়। মারাঠাদের প্রধান সেনাপতি ইব্রাহিম কার্দিকে বন্দী করা হয়। সেখানে কিন্তু নাট্যকার ইব্রাহিম কার্দিকে সরাসরি মৃত্যুদ-ের মুখোমুখি না করে আইনের আওতায় এনে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদ- কার্যকর করেন।
‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের নায়ক-নায়িকা ছিল স্বামী-স্ত্রী। নায়িকা জোহরা বেগম ছিল মুসলমানদের পক্ষে এবং নায়ক ইব্রাহিম কার্দি ছিল মারাঠাদের পক্ষে। আদর্শের দ্বন্দ্বের কারণে একে অপরের প্রতি ভালবাসা থাকা সত্ত্বেও দু’জনের মিলন হয়নি। সেখানে নায়ক ইব্রাহিম কার্দিকে বাঁচানোর জন্য নাট্যকার কখনও জোহরা বেগম বা জল্লাদের কাছে অনুনয়-বিনয় করার জন্য হাজির করেননি। এখানে নাট্যকার মুনীর চৌধুরী নায়ক ইব্রাহিম কার্দিকে বীরদর্পে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করান এবং ইব্রাহিম কার্দিকে বীরের মতো মূল্যায়ন করেন।
নাটক মূলত ক্রিয়াশীলতার সৃজনভূমি। এই চিন্তা সিকান্দার আবু জাফর পূর্বাপর বজায় রেখেছেন। দীর্ঘ বর্ণনার ভার কখনই নাটকটিকে আক্রান্ত করেনি। একটি দৃশ্য থেকে অপর দৃশ্যে নাট্যকার চলে গেছেন অনায়াসে দ্রুততার সঙ্গে। এমনকি পলাশীর প্রান্তর থেকে মুর্শিদাবাদের নবাব দরবারে ফিরে এসে সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে যে বর্ণনাধর্মী সংলাপ প্রদানের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা মূলত সিরাজউদ্দৌলাকে পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সুযোগ করে দেয়। এছাড়াও প্রয়োজন অনুসারে অলঙ্কার ব্যবহার এবং দৃঢ় ও সাবলীল ভাষায় নাট্যক বক্তব্যকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সিকান্দার আবু জাফর বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
মোঃ আবদুল খালেক