খাদ্য না খেয়ে মানুষ একুশ দিনের বেশি বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু পানি পান না করে সাধারণত তিন দিনের বেশি বাঁচা সম্ভব নয়। পানির সুষ্ঠু ব্যবহারই জীবনের স্পন্দনকে গতিশীল রাখে। তাই পানির অপর নাম জীবন। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ছাড়া ভবিষ্যতে আমরা মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে পারি। ঢাকা শহরের চারপাশের বেষ্টনীর মতো ঘিরে আছে ৫টি নদীÑ বুড়িগঙ্গা, বালি, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা আর ধলেশ্বরী।
সুদূর অতীতে বুড়িগঙ্গার পানি যখন ঢাকা শহরের পানির চাহিদা পূরণ করত তখন কোনরূপ প্রক্রিয়া ছাড়াই ঐ পানি সরাসরি ব্যবহৃত হতো। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে নদী-নালা, খাল-বিল যেভাবে দূষিত হয়েছে তাতে যথেষ্ট প্রক্রিয়াকরণের পরেও তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই ঢাকা শহরের পানির মোট চাহিদার ৮৭% পানি ৭৪০টিরও বেশি ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূ-গর্ভ হতে সংগ্রহ করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে ঢাকা শহরের পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। বর্তমানে এই শহরের পানির স্তর স্থান ভেদে ৭০০ থেকে ১০০০ ফুটের মধ্যে রয়েছে। অথচ, ঢাকার অদূরে গাজীপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৬০/৭০ ফুটের মধ্যে পাওয়া যায়। অঞ্চলভেদে এই পরিসংখ্যানই ঢাকা শহরের ভূগর্ভস্থ পানির মজুদের নাজুক অবস্থা প্রকাশ করে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে ভূ-গর্ভস্থ পানি সহজে ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু আমাদের দেশে সময়ের চাহিদা পূরণের জন্য আমরা এর যথেচ্ছ ব্যবহার করছি- যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মোটেও কল্যাণকর নয়।
ভাবনাটি বেশিদিন আগের নয়। গত বছরের মার্চে আমি আমার বাসা পরিবর্তন করি। এ সময় এসি মিস্ত্রি ঘরের এয়ার কুলারের ফ্যানটি ঘরের বাইরে ব্যালকনিতে স্থাপন করে, কিন্তু পাইপের অভাবে পানি নির্গমন ব্যবস্থা একেবারে ব্যালকনির বাইরে করতে পারেনি। তাই রাতে যখন এসি অন করি তখন একটা বালতি ব্যালকনিতে রেখে দেই। লক্ষণীয় বিষয় হলো রাতে ৬/৭ ঘণ্টা এসি চললে বালতিতে প্রায় ১৪-১৫ লিটার পানি জমে, যা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। এসি থেকে এত পরিমাণ পানি সংগৃহীত হতে দেখে আমার মাথায় হঠাৎ করে যে চিন্তাটি আসে তা হলো ঢাকা শহরের পানি ব্যবস্থাপনায় এয়ারকুলারের পানি ব্যবহারের বিষয়টি। ঢাকা শহরে বিপুল সংখ্যক এসি রয়েছে যা শহরের অধিবাসীদের একটি নির্ভরযোগ্য ব্যবহার্য পানির উৎস হতে পারে।
এই পানির উৎস কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রায়ই ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি ঘটে। কোন পাত্রে বরফ বা ঠা-া কিছু রেখে দিলে পাত্রের বাইরের পৃষ্ঠে বিন্দু বিন্দু পানি জমে। প্রকৃতপক্ষে এই পানি বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্প যা পাত্রে রাখা ঠা-া বস্তুর সংস্পর্শে ঘনীভূত হয়ে পানিতে পরিণত হয়। এয়াকুলারে গ্যাস প্রবাহের মাধ্যমে এসির ভেতরের ইভেপরেটর-এর পাইপটি ঠা-া হয় এবং সেই ঠা-াতে বাতাস প্রবাহ করলে ঠা-া বাতাস ঘরের মধ্যে ঢোকে। গ্যাস পাইপটি খুব ঠা-া হওয়াতে পাইপের গায়ে বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্প ঠা-ার সংস্পর্শে পানি হয়ে যায় এবং বহিঃগমন পাইপ দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বাইরে পড়ে। আমাদের দেশের বায়ুর আর্দ্রতার কারণে আমরা এই পানি যথেষ্ট পরিমাণে পাই। প্রকৃতির এই আশীর্বাদকে কাজে লাগিয়ে আমরা পেতে পারি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য পানি, যা সামান্য প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে খাওয়ার পানি হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
আমরা যদি আমাদের ঢাকা ওয়াসার পানি ব্যবস্থাপনায় এয়ারকুলারের পানিকে ব্যবহার করতে পারি, তাহলে অনেকাংশে ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপরে নির্ভরশীলতা কমবে। ধরে নিই ঢাকা শহরে গড়ে এক কোটি টন এসি রয়েছে এবং ঐ এসি যদি দৈনিক ১২-১৪ ঘণ্টা চালানো হয়, তাহলে গরমের সময় প্রতিদিন প্রায় বিশ কোটি লিটার পানি পাওয়া সম্ভব। এর জন্য ওয়াসাকে কোন বিদ্যুত বিল গুনতে হবে না। প্রতিবছর যে হারে এসির ব্যবহার বাড়ছে তাতে এসির বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে ৪০ কোটি লিটার পানি পেতে আমাদের খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। বর্তমানে এই বিশ কোটি লিটার পানি আমরা প্রতিদিন পাচ্ছি কিন্তু তার কোন সদ্ব্যবহার হচ্ছে না। এই পানি হয় বিল্ডিংয়ের সানশেডে পড়ে কনক্রিটের আয়ু কমাচ্ছে নতুবা পয়নিষ্কাশন লাইনে চলে যাচ্ছে। সামান্য বুদ্ধি খাটিয়ে এই পানিকে প্লাস্টিক বা কনক্রিটের চৌবাচ্চায় সংরক্ষণ করে পানির ব্যবস্থাপনায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধন করা সম্ভব।
এজন্য আমাদের এসির পানি নিষ্কাশনের পাইপটির বহিঃস্থ মুখ একটি চৌবাচ্চায় যুক্ত করতে হবে। যাতে পানি ঐ চৌবাচ্চায় জমে এবং নগরবাসীর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত হয়। ঢাকা শহরের অনেক এলাকাতেই মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিং কমপ্লেক্স রয়েছে। যেখানে প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটেই একাধিক এসি রয়েছে। এমন একটি কমপ্লেক্সের সব এসিগুলোর পানি যদি আমরা নির্দিষ্ট চৌবাচ্চায় সংগ্রহ করি তাহলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ পানি পাওয়া সম্ভব। পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সম্ভব। সেন্সর ডিভাইস এবং মোবাইলের সমন্বয়ে স্থাপিত ডিজিটাল সিস্টেমের মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তে মনিটর করা সম্ভব।
এই পানি সংগ্রহে দীর্ঘ সাপ্লাই লাইন ব্যবহার করতে হবে না বলে পানিবাহিত রোগ যেমন টাইফয়েড, জন্ডিস ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনাও কমে যাবে। ফলে প্রভূত উন্নতি সাধিত হবে আমাদের স্বাস্থ্য খাতে। এছাড়া খাওয়ার পানি ফুটাতে অপচয় হবে না আমাদের অমূল্য সম্পদ প্রাকৃতিক গ্যাস। এই পানি যান্ত্রিক মোটরের রেডিয়েটরে ব্যবহার করলে রেডিয়েটরের আয়ু বহু গুণ বৃদ্ধি পাবে, কারণ এতে রেডিয়েটর ও বয়লারের স্থায়িত্ব হ্রাসকারী পদার্থ আয়রন থাকে না।
বিষয়গুলো নিয়ে আরও অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং গবেষণার প্রয়োজন। যেমন- কোন মাসে কত টন এসি থেকে কি পরিমাণ পানি পাওয়া যায়, প্রাপ্ত পানিতে কি কি পদার্থ দ্রবীভূত থাকে, এই পানি স্বাস্থ্যের জন্য কতটা নিরাপদ ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তব পরিসংখ্যান ও তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা দরকার।
বিন্দু বিন্দু জল থেকে সিন্ধু নদের সৃষ্টি, আবার হিমালয়ের বরফ গলা পানি থেকে পদ্মা নদীর সৃষ্টি। আমার বিশ্বাস- এয়ারকুলারের বিন্দু বিন্দু পানির একীভূতকরণ পদ্ধতি ঢাকাবাসীর পানি সঙ্কট নিরসনে যেমন ভূমিকা রাখবে তেমনি ভূ-গর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পানি ব্যবস্থাপনায় উন্মোচন করবে নতুন দিগন্ত।
লেখক : ডিন, ইলেকট্রিক্যাল এ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদ, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর