ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

শাহরিয়ার কবির

পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং জাতীয় নাগরিক কমিশন

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ১২ মার্চ ২০১৭

পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ এবং জাতীয় নাগরিক কমিশন

(গতকালের পর) এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে ইসলাম ধর্মের বই বা কোরানকে হুমায়ুন আজাদ নয়- হেফাজত মনে করছে ‘ভয় দেখানো অন্ধকারের বই’! বাংলাদেশের ৯৯% মুসলমান কখনও বলবেন না কোরান ভয় দেখানো অন্ধকারের বই। কোরানের প্রতি যাদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস আছে তারা বলবেন কোরান মানুষকে আলোকিত করে। শুধু ইসলাম ও কোরানবিদ্বেষী নাস্তিকরাই বলতে পারেন ‘কোরান ভয় দেখানো অন্ধকারের বই’। হেফাজত কাদের নাস্তিক বলছে? ইসলামের মহানবী তার উম্মতদের জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজন হলে চীন পর্যন্ত যেতে বলেছেন। জ্ঞানের যদি ধর্ম থাকে তাহলে মহানবীর উম্মতরা চীনে গিয়ে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করবেন না, বরং বৌদ্ধ-নাস্তিক-কনফুসিয়ান জ্ঞানপ্রাপ্ত হবেন। কিন্তু মহানবী জানতেন এবং সবাই জানেন- জ্ঞানের বা ভাষার কোন ধর্ম নেই। ভাষার ওপর কিংবা জ্ঞানের ওপর ধর্মনির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকার। পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষাকে হিন্দুদের ভাষা হিসেবে আখ্যায়িত করে শাসকরা আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রচলন করতে চেয়েছিল। তাদের বিবেচনায় আরবী আল্লাহর ভাষা, মুসলমানদের ভাষা আর বাংলা হিন্দুদের ভাষা! নজরুলের কবিতার ‘মহাশ্মশান’ কেটে তারা ‘গোরস্তান’ বানিয়েছিল, জসীম উদ্দীনের ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতার শিরোনাম পাল্টে ‘দাওয়াত’ লেখা হয়েছিল। এখন যেমন হেফাজতের আবদার রাখতে গিয়ে একটি চরিত্রের ‘উত্তম’ নাম বাদ দিয়ে ‘অলিউল’ রাখা হয়েছে। আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো সওয়ার হয়ে হেফাজতীরা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। ’৭৫-এর পর থেকেই মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের জামায়াতীকরণ ও হেফাজতীকরণ হয়েছে। এখন শুরু হয়েছে সাধারণ পাঠক্রমের হেফাজতীকরণ। ‘উত্তম’কে অলিউল বানাবার পর হেফাজত নিশ্চয় আবদার করবে ‘রবীন্দ্রনাথ’ না লিখে ‘শামস উদ্দীন’ লিখতে হবে! ‘মন্দির’ শব্দটি থাকার কারণে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ কবিতাটি বাদ পড়েছে। তবে কি পাকিস্তানের মতো ‘মন্দির’কে ‘মসজিদ’ বানিয়ে আমাদের গাইতে হবে- তোমার দুয়ার আজি ভরে গেছে সোনার ‘মসজিদে’!? হেফাজতীরা ‘রামছাগল’কে কী বলবেন? আমরা কি কাউকে ‘রামধোলাই’ দিতে পারব না? হেফাজত যা করছে তা কখনও ইসলাম সমর্থক হতে পারে না। এসব হচ্ছে বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাবার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক চক্রান্তের অন্তর্গত। এভাবে পাকিস্তান তাদের এদেশীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সপক্ষের গণমাধ্যমে পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণের প্রচ- সমালোচনা হলেও জামায়াত-হেফাজত সমর্থক গণমাধ্যমে সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলাম আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ কোন মন্তব্য না করলেও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর হেফাজতের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিনাশী সাম্প্রদায়িক হুমকি ও সন্ত্রাসের সমালোচনা করেছেন। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি (২০১৭) চট্টগ্রামে সংস্কৃতিকর্মীদের এক সমাবেশে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব খোলাখুলি হেফাজতের সমালোচনা করেছেন। ‘পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রতিক রদবদলে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির যে অভিযোগ উঠেছে সে প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘একজন সরকারী কর্মকর্তা আমাকে বললেন, যে পরিবর্তনগুলো নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে, আমি বিশদ পড়েছি কি-না।’ ‘আমি বলেছি, আমার তো পড়ার দরকার নেই। যে পরিবর্তনকে হেফাজত বিবৃতি দিয়ে স্বাগত জানায়, সেটি আমার না পড়লেও চলে।’ ‘গত বছরের ডিসেম্বরে সুপ্রীমকোর্টের মূল ভবনের সামনে রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’-এর আদলে একটি ভাস্কর্য স্থাপনের পর তা অপসারণের দাবিতে কর্মসূচী দেয় হেফাজতে ইসলাম। ইসলামী সংগঠনটির একটি প্রতিনিধিদল গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রীমকোর্টে গিয়ে প্রধান বিচারপতি বরাবরে একটি স্মারকলিপি দিয়ে আসে। সেখানে ওই ভাস্কর্যকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যায়িত করে বলা হয়, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের আজ্ঞাবাহী এক শ্রেণীর পেইড ও প্রপাগান্ডিস্ট মিডিয়া এবং ইসলামবিদ্বেষী সেকুলার অপশক্তি এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৃহত্তর তৌহিদি জনতার ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ইমান-আকিদার বিরুদ্ধে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল, পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া নাস্তিক্যবাদী ও হিন্দুত্ববাদী প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংযোজনের দাবিও করছে।’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৮ ফেব্রুয়রি ২০১৭) ইসলামের নামে মহাতাণ্ডব ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী হেফাজতে ইসলাম গঠিত হয়েছে ২০১০ সালে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আহমদ শফীর নেতৃত্বে গঠিত কওমী মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের এই সংগঠনটি আলোচনার পাদপ্রদীপের নিচে এসেছে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড এবং জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে সূচিত ছাত্র-জনতার মহাজাগরণের পর। এককালে জামায়াতে ইসলামীর সমালোচক দেওবন্দি শফী হঠাৎ জামায়াতের পক্ষে খোলাখুলি মাঠে নামলেন। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে জামায়াতের পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বিশাল এক খোলা চিঠি লিখে তিনি গণজাগরণ মঞ্চ ও নির্মূল কমিটির নেতাদের ‘নাস্তিক’, ‘মুরতাদ’ আখ্যায়িত করে ফতোয়া জারি করলেন। এরপরই শুরু হলো গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের ওপর হামলা ও হত্যাকাণ্ড, যার প্রথম বলি ছিলেন শাহবাগের তরুণ ব্লগার রাজীব হায়দার। ব্লগার হত্যার পর ২০১৩ সালের এপ্রিল ও মে মাসে হেফাজত দুটি মহাসমাবেশ করে রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে যে মহাতাণ্ডব এবং ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত করেছে তার ওপর ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’র পক্ষ থেকে আমরা প্রায় তেরো শ’ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছি। হেফাজত দাবি করেছিল ৫ মে (২০১৩) মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সরকার তাদের মহাসমাবেশ ভাঙ্গতে গিয়ে রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার আলেমকে হত্যা করেছে। শ্বেতপত্রে হেফাজতের নেতাদের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে আমরা ৪৬ জন নিহতের নাম পেয়েছি, যারা শাপলা চত্বরে নয়, নিহত হয়েছেন রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন এলাকায়, ৫ ও ৬ মে পুলিশের সঙ্গে হেফাজত-জামায়াতের সশস্ত্র সংঘাতে। নিহতদের তালিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, আওয়ামী লীগের কর্মী এবং দলীয় পরিচয়হীন নিরীহ পথচারীও ছিলেন। আমাদের শ্বেতপত্রে হেফাজতের মিথ্যাচার উন্মোচনের পর এ নিয়ে তারা টুঁ শব্দ উচ্চারণ করেনি। হেফাজত দাবি করে তারা অরাজনৈতিক সংগঠন। আমরা শ্বেতপত্রে হেফাজত নেতাদের রাজনৈতিক পরিচয়ও তুলে ধরেছি। সংগঠনের আমির আহমদ শফীসহ হেফাজতের শীর্ষস্থানীয় সকল নেতা একদিকে ’৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলাম এবং পরবর্তী সময়ের ইসলামী ঐক্যজোট প্রভৃতি মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে যুক্ত। এছাড়াও হেফাজতের শীর্ষ নেতারা মুক্তিযুদ্ধকালে ‘আলবদর’ ও ‘আলশামস’-এর আদলে ‘মুজাহিদ বাহিনী’ গঠন করে হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন প্রভৃতি মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১৩ সালের ৫ মের মহাতাণ্ডবের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, হেফাজত-জামায়াতকে আর ছাড় দেয়া হবে না। প্রধানমন্ত্রীর শক্ত অবস্থানের কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতের বেশ কয়েকজন রাঘব বোয়ালকে গ্রেফতার করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় হেফাজতের নেতারা বলেছেন জামায়াত-বিএনপির সহযোগিতায় তারা কীভাবে সরকার উৎখাতের ‘জিহাদে’ অংশ নিয়েছিলেন। শাপলা চত্বরের মহাতাণ্ডব এবং শীর্ষ নেতাদের স্বীকারোক্তির পর হেফাজতের রাজনৈতিক অভিলাষ গোপন কোন বিষয় নয়। তারা কী রকম সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা চান সেটি বর্ণিত হয়েছে শাপলা চত্বরে ঘোষিত তাদের ১৩ দফা কর্মসূচীতে। হেফাজতের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের পর কৌশলগত কারণে সংগঠনের নেতারা সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে রেলের জমি ও নগদ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে হেফাজত নেতাদের অন্তর্কলহের সংবাদ বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। ঘুষ দিয়ে সরকার হেফাজতকে রাজপথের আন্দোলন ও সন্ত্রাস থেকে বিরত রাখতে সাময়িকভাবে সফল হয়েছে বটে- তাদের গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা কখনও বন্ধ হয়নি। হেফাজত-জামায়াত গ্রামে গ্রামে ইসলামী দাওয়াতের নামে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য হেফাজত নেতারা মাঝে মাঝে হুঙ্কার দেন- তারা ১৩ দফা কর্মসূচী থেকে এক চুলও সরে আসেননি। পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতীকরণ কর্মীদের আরও চাঙ্গা করবে। জামায়াত-হেফাজতের বাধার কারণে কবীর চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কওমী মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র ও শিক্ষক তাদের সনদের সরকারী স্বীকৃতি এবং পাঠ্যসূচী যুগোপযোগী করার পক্ষে হলেও হেফাজত নেতাদের বাধার কারণে সরকার কওমী মাদ্রাসার রক্ষণশীল, উগ্র মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক পাঠ্যসূচীর গায়ে সামান্যতম আঁচড় কাটতে পারেনি। সরকারের প্রতিষ্ঠান ইসলামী ফাউন্ডেশন ২০১৪ সালে মাদ্রাসার পাঠ্যসূচী পর্যালোচনা করে জানিয়েছিল- এই সরকারের আমলেও মাদ্রাসায় মওদুদীবাদ পড়ানো হচ্ছে, যেখানে বলা হচ্ছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘গণতন্ত্র’, ‘জাতীয়তাবাদ’ ইত্যাদি ইসলামবিরোধী মতবাদ; যারা এ মতবাদের অনুসারী তারা ‘মুরতাদ’, যার সহজ অর্থÑ ‘হত্যার যোগ্য।’ জামায়াত-হেফাজত মাদ্রাসার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এখন হাত দিয়েছে সাধারণ পাঠ্যসূচীর ওপর। পাঠ্যপুস্তক সংশোধনে হেফাজতের অযৌক্তিক দাবি খণ্ডন করে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এক বছর আগেই শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন দিয়েছিল। তারপরও ২০১৭ সালে হেফাজতের দাবি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়েছে। এটিকে হেফাজত তাদের আন্দোলনের বিরাট বিজয় হিসেবে দেখছে। অন্যদিকে আমরা দেখছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর একটি আলোকিত জাতির তমসযাত্রা হিসেবে। এই পরিস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- চলবে...
×