॥ দ্বিতীয় কিস্তি ॥
আমরা আপ্লুত হয়ে বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী যখন আমাদের সম্মান দেখিয়েছেন, আমরাও তাকে সম্মান দেখাব। আমরা চাঁদা তুলে অন্যদের তুলনায় উচ্চমূল্য দিয়েছি। আমরা বধ্যভূমি চিহ্নিত করছি, গণহত্যা নির্ঘণ্ট প্রকাশ করছি, আরও অনেক কিছু। না, এসব বলার জন্য এ ঘটনার অবতারণা নয়। আমরা ৪০ বছর আন্দোলন করেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। প্রথম থেকেই তিনি আমাদের সহায়তা করেছেন এবং বিরোধী দলের নেত্রী থাকার সময় চমৎকার এক বক্তৃতা দিয়েছিলেন, যা আমরা ছেপে প্রচার করেছি। এবং তিনিই এদের বিচার শুরু করেছেন। তিনি না থাকলে, আওয়ামী লীগ এতে রাজি হতো কিনা সন্দেহ। কারণ, এ দলের অনেক নেতা আত্মীয়তার বন্ধনে, ব্যবসার কারণে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে জড়িত বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে। ১০ বছর বা তারও আগে আমি ও শাহরিয়ার কবির লিখিতভাবে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা করার জন্য। তখন অনেকে এ প্রস্তাব অবাস্তব ও হাস্যকর বলেছেন। শেখ হাসিনাই এত বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা ১০ হাজার টাকা করেছেন। পুরনো হাইকোর্টকে জাদুঘর করার প্রস্তাবও রেখেছিলাম। তিনি তাতে সায় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুর সম্মাননা দেয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম তাও তিনি কার্যকর করেছেন। এখন ২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবস তারই উদ্যোগে সংসদে পাস হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের আমরা সমালোচক বটে; কিন্তু এটি বলতে দ্বিধা নেই মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার কমিটমেন্টে কোন ঘাটতি নেই। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ছিলেন যেসব মন্ত্রী তাদের অধিকাংশও মুক্তিযুদ্ধের কোন বিষয়ে আমাদের ফেরাননি। আমরা তাই আশা রাখি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় মন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী আমাদের আরও কয়েকটি প্রস্তাব কার্যকর করবেন-
১. মুক্তিযোদ্ধা ও সংবিধান দিবস পালন
২. প্রস্তাবিত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অস্বীকার অপরাধ আইন পাস
৩. জামায়াতে ইসলাম নিষিদ্ধকরণ।
২৫ মার্চ গণহত্যা স্মরণ দিবস ঘোষণা করায় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের অভিনন্দন।
এবার আলোচনা করব কেন ২৫ মার্চ বিশেষভাবে এবং জাতীয়ভাবে আমাদের পালন করা উচিত। গণহত্যা স্মরণ দিবস পালনে আমরা কেন গুরুত্ব দিয়েছিলাম? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় আমরা দেখেছি, গণহত্যা, নির্যাতন বা অবরুদ্ধ দেশ তেমন কোন গুরুত্ব পায়নি। এখানে বলে রাখা ভাল, গণহত্যার সঙ্গে নির্যাতনের বিষয়টিও আসবে। নির্যাতনের ভেতর অন্তর্গত আবার বাস্তুচ্যুতি এবং নারী নির্যাতনও। গণহত্যা আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে এ দুটি বিষয়েও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের গুরুত্ব দেয়ার কারণ, এ বিষয়গুলো না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ গুরুত্ব হারায় ও বৈশিষ্ট্যহীন হয়ে যায়। আমরা জয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় এই ভারসাম্য না থাকায় জাতির বুননে (পলিটি) বিষয়টি গেঁথে যায়নি।
উদাহরণ হিসেবে বলি, ভাষা আন্দোলন বা ২১ ফেব্রুয়ারির কথা কেন মুক্তিযুদ্ধ বা গণহত্যা বেশি জানে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মৌখিক পরীক্ষা নিতে দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের নেতা, ১৯৭১ সালের সরকার, গণহত্যা সম্পর্কে ধারণা অস্পষ্ট। কয়েকদিন আগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আনকোরা নতুন কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তারা শুনেছেন, জানেন, আমি ঢাকা নিয়ে লেখালেখি করি, ঢাকা শহর নিয়ে তাদের আগ্রহ আছে, তাই দেখা করতে আসা। আমি গণহত্যা-নির্যাতন (নারী ধর্ষণসহ) সম্পর্কে জানতে চাইলাম, দেখি মোটামুটি তারা কিছুই জানেন না। তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন আমার মনে হলো, এ রকমটি এখানে হলো, ইউরোপে হলো না কেন?
এর প্রধান কারণ, পরম্পরা। ইউরোপে নাৎসি ও ফ্যাসিস্ট সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছিল তা কেন মনে রাখে বা রাজনীতিতে কেন প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপে হিটলার মুসোলিনীর পরাজয়ের পর তারা বিজয় পালন করেছে, এখনও করে; কিন্তু গুরুত্ব দিয়েছে গণহত্যা-নির্যাতনের ওপর। শহীদ স্মৃতি পালনের ওপর। কেননা, বিজয়ের কথা মানুষ বেশি মনে রাখে না; কিন্তু হত্যা-নির্যাতন অপমানের কথা মনে রাখে। তা বংশ পরম্পরায় রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হয়। সেই থেকে ইউরোপে আজ পর্যন্ত অজস্র চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, উপন্যাস, গল্প, কবিতা লেখা হয়েছে, ইতিহাস রচিত হয়েছে। এখনো হচ্ছে। অর্থাৎ পরম্পরা আছে। সব বধ্যভূমি তারা সংরক্ষণ করেছে, শহীদদের সমাধি সুন্দর করে রেখেছে, স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছে। জাদুঘর বিশেষ করে গণহত্যা জাদুঘর নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে। স্কুলের ছাত্রদের বাধ্যতামূলকভাবে সেসব জাদুঘর, স্মৃতিসৌধ, বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন প্রজন্মের কাউকে গণহত্যা-নির্যাতনের কথা ভুলতে দেয়া হয় না। এর পরিপূরক হিসেবে নাৎসি-ফ্যাসিবাদী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এ থেকে বর্ণবাদের, জাতি বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়। হলোকাস্ট আইন হয়েছে অনেক দেশে।
আমাদের এখানে এই পরম্পরাটি নেই। ১৯৫২ সালের পরম্পরা আছে। স্বাধীনতাবিরোধী, সামরিক স্বৈরশাসন সব বছরে ২১ পালিত হয়েছে। জাতির বুননে এটি এমনভাবে আছে, কেউ তা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারে না।
১৯৭২-’৭৫ বঙ্গবন্ধু সরকার গণহত্যা নিয়ে যে বলেনি বা গণহত্যাকারীদের বিচার যে চায়নি তা নয়। কিন্তু অন্য কারও মনে না থাকুক, আমাদের জেনারেশনের নিশ্চয় মনে আছে ১৯৭১-৭৪ কি অবস্থায় ছিল বাংলাদেশ। সারা জাতি বিষণœ। ৩০ লাখ পরিবারের কমপক্ষে ২০ জন করে আত্মীয় থাকলে তারা স্বজনহারা অবস্থায় শোকাতুর ছিলেন। পাঁচ লাখেরও বেশি নারী ধর্ষিত হয়েছিলেন। একটি পরিবারে একটি মেয়ে ধর্ষিত হওয়ার অর্থ সেই একইভাবে পুরো পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে যাওয়া শরণার্থীরা ধ্বংসস্তূপে ফিরেছিলেন। অবকাঠামো কিছু ছিল না। তারপর ছিল খাদ্য অভাব। অর্থ নেই। আর ছিল স্বাধীনতা বিরোধীদের ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুপার পাওয়ার ও তথাকথিত ইসলী দেশসমূহের বিরোধিতা। প্রতিটি সমস্যাই ছিল অগ্রাধিকার। বঙ্গবন্ধুকে তা সামলাতে হয়েছে। এককভাবে গণহত্যার বিষয়টি তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি। বঙ্গবন্ধু শহীদদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করেছিলেন, বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে বিজয় স্তম্ভ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারের জন্য আইন করে তা সংবিধানের সুরক্ষায় এনেছিলেন। তিনি আর সময় পাননি।
এরপর তিন যুগ বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে বাঙালী পাকিস্তানীদের দ্বারা। পাকিস্তানে ইতিহাস পড়ানো হয় না। গত চার দশকে আমাদের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ‘ইতিহাস’ শব্দটি বাদ পড়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো বটেই। তাই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, গণহত্যার স্মৃতিতে পলি জমেছে। এবং এই সুযোগ নিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী, বাঙালী পাকিস্তানী, পাকিস্তান। ইতিহাস সামগ্রিকভাবে বিচার না করলে এবং তা লালন না করলে কী হয়, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও রাজনীতি এর প্রমাণ। ইতিহাসের সূত্রগুলো মননে গেঁথে দিতে হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণহত্যা। কারণ, নয় মাসে পৃথিবীর কোথাও এত মানুষ হত্যা করা হয়নি। এত মানুষ নির্যাতিত হয়নি, এত নারী ধর্ষিতও হয়নি। অথচ এটি চোখের আড়ালে চলে গেল কীভাবে? এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র জড়িত।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জিয়াউর রহমানের নাম আসবেই। বঙ্গবন্ধু থাকবেন জাতির পিতা হিসেবে। জিয়া থাকবেন বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের নায়ক ও বাঙালিত্ব বিনষ্টের ভিলেন হিসেবে। বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে খন্দকার মোশতাক থেকে জিয়াউর রহমানের নাম বেশি আসে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর পাকিস্তানী শাসকদের প্রক্সি হিসেবে যখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলেন, তখন বাঙালীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে তিনটি কাজ করেছিলেন। এক. সংবিধানের মৌলনীতি বিনষ্ট যার ভিত্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধ বা অন্য কথায় ত্রিশ লাখ শহীদ। দুই. স্বাধীনতাবিরোধীদের জেল থেকে মুক্ত করে স্বাধীন শুধু নয়, ক্ষমতার অংশীদার করা এবং ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের যে ধারা ছিল সেগুলো বাতিল করা। তিন. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি অবলেপন, যার মধ্যে ৭ মার্চ ও ২৫ মার্চ অন্তর্গত। এ তিনটি আবার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এভাবে ১৯৭৫ সালে ইতিহাসের পরম্পরা ছিন্ন করা হলো যেটি ১৯৫২-এর ক্ষেত্রে হয়নি।
সংবিধান বদল ছিল স্মৃতির সঙ্গে দূরত্ব স্থাপনের প্রথম উদ্যোগ। জয়বাংলা অলিখিতভাবে নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হলো। এটি ছিল পরম্পরার পরিপ্রেক্ষিতে স্মৃতি জাগরূক রাখার প্রধান হাতিয়ার। যেমন, ৭ মার্চ যেখানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন ও পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেছিল, সেখানে শিশুপার্ক স্থাপন। উল্লেখ্য, হাইকোর্টের নির্দেশ সত্ত্বে বর্তমান সরকার গত ৭-৮ বছরে তা সরায়নি। জিয়ার প্রতি কোন না কোন স্তরে যে নীতিনির্ধারকদের ভালবাসা আছে সে অভিযোগ উঠতেই পারে। স্বাধীনতা চত্বরে এ ধরনের শিশুপার্ক যে মানানসই নয় এটি আওয়ামী লীগ মানতে রাজি নয়। অন্যান্য দলের মতো নান্দনিকতার সঙ্গেও তাদের দূরত্ব অনেক। বীরাঙ্গনাদের জন্য ক্লিনিকগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। মুক্তিযুদ্ধের গানের স্মৃতির বদলে এলো শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ।’ এটি পরিণত হলো জিয়া আমলের থিমসং-এ। এরশাদ এই ধারা বজায় রাখলেন এবং ঘোষণা করলেন শহীদ মিনারে মিলাদ হবে এবং সেখানে আলপনা দিতে দেয়া হবে না। [এসব বিকৃতমনা রাজনীতিকদের এসব কথাবার্তা আমরা কীভাবে ভুলে যাই?]। খালেদা জিয়ার সময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিলই বদলে দেয়া হলো। আসলে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। তিনি এর মানেই বোঝেন না। বুঝলে, পাকিস্তানী সেনাপ্রধানের মৃত্যুতে শোকাহত হতেন না, ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্নও তুলতেন না। তার আমলে, পাঠ্যবইয়ে ইতিহাস বিকৃত করা হয়। যারা গণআদালত করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। তার ও তার পরবর্তী আমলে [খালেদা-নিজামী] মুক্তিযুদ্ধ একটি নোংরা শব্দে পরিণত হয়। সেখানে গণহত্যা নির্যাতনের স্থান থাকার কথা নয়। আর গণহত্যা-নির্যাতন তেমনভাবে প্রজন্ম না জানায় এর বিরুদ্ধে তেমন কোন বক্তব্যও আসেনি।
এর পেছনে তো একটি রাজনীতি ছিল। এই রাজনীতির উদ্দেশ্য ছিল, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির অবলেপন। এ স্মৃতি মনে না থাকলে সমন্বয়ের রাজনীতির পথ মসৃণ হয়। বিএনপি-জামায়াতের উত্থান ও রাজনীতির যখনই কোন বিরোধিতা হয়েছে তখন অনেক ‘সুধীজন’ প্রশ্ন করেছেন, কবে কী হয়েছিল তা মনে রাখলে তো আমরা এগোতে পারব না।
এই রাজনীতির কারণে, মুক্তিযুদ্ধের তথ্যেরও বিকৃতি ঘটতে থাকল। ধরা যাক, বীরাঙ্গনাদের কথা। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই বিদেশী বেতারে বীরাঙ্গনাদের সংখ্যা যা বলা হচ্ছিল, তার থেকে সংখ্যা এখন কম বলা হচ্ছে। ১৯৭২ সালের দিকে ডাঃ ডেভিসই এই সংখ্যা প্রায় চার লাখ বলেছিলেন। আমার গবেষণায় দেখেছি তা পাঁচ লাখের ওপরে। সরকারী ভাষ্য, এখন দুই লাখ। এই সংখ্যা কখন কীভাবে এলো তা হয়ত কেউ বলতে পারবে না। সামাজিক রক্ষণশীলতা, মানসিক অধস্তনতা, পাকিস্তানের অপরাধকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টাÑ এসব কিছুর কারণেই এই সংখ্যা দুই লাখের বেশি হচ্ছে না। সুভাষচন্দ্রের নাতনি এ সংখ্যাকে ৩০০০-এ নামিয়ে এনেছেন। পাকিস্তানী ভাষ্যই তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। এভাবে বীরাঙ্গনাদের দুঃখ, নির্যাতন-ত্যাগকে খাটো করা হচ্ছে।
৩০ লাখ শহীদ নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে। জামায়াত ক্ষমতায় গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করেছে। বিএনপি নেত্রী যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী ছিলেন তিনিও ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এর চেয়ে দুঃখজনক কী হতে পারে। ডেভিড বার্গম্যান ড. কামাল হোসেনের কন্যার জামাতা। তিনি এক সময় যুদ্ধাপরাধীদের ওপর ডকুমেন্টারি নির্মাণ করে আমাদের প্রশংসাভাজন হয়েছিলেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের সময় জামায়াত দুই হাতে টাকা বিলিয়েছে। ওই সময় দেখা গেল বার্গম্যান বিদেশী পত্রিকায় ৩০ লাখ শহীদ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাস বিকৃতি আইনের দাবি তুলছিলাম, তখন বার্গম্যান আমার সঙ্গে দেখা করে আলাপ করতে চাইলেন। আমি বললাম, আলাপে লাভ নেই। তবে, আলাপে আমার আপত্তি নেই যদি আপনি জার্মানি বা ইসরাইলে গিয়ে বলতে পারেন হলোকাস্ট হয়নি, তিনি আর উত্তর দেননি।
মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচার বিএনপি সমর্থন করেনি। সে কারণে, গণহত্যার বিষয়টিও তারা খাটো করে দেখাতে চেয়েছে। বধ্যভূমির প্রকৃত সংখ্যা কেউ জানে না। অনেকে বধ্যভূমি দখল করেছেন, নদীভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে, অনেক বধ্যভূমির কথা মানুষ ভুলে গেছে। এগুলো সবই এক ধরনের অপরাধ যা রাজনীতি হিসেবে চালানো হচ্ছে।
এর কারণটা কী? কারণ, পরম্পরা ব্যাহত হওয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদ ইউরোপে নিষিদ্ধ হয়েছে। এবং এ বিষয়ে আইন করা হয়েছে। অর্থাৎ, কেউ এ বিষয়ে বিতর্ক উঠালে তার জেল-জরিমানা হবে। ২৪টি দেশে বিধিবদ্ধ আইন হয়েছে যেখানে, হলোকাস্ট নিয়ে কথা বলা যাবে না। গণহত্যার জায়গাগুলো ইউরোপে সংরক্ষিত হচ্ছে। হলোকাস্ট মিউজিয়াম হয়েছে সব খানে।
ইউরোপে ‘হলোকাস্ট আইন’ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিবছর যুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে এবং এর অনেকগুলো এখন ধ্রুপদী মর্যাদা পেয়েছে। প্রতিবছর এ বিষয়ে গল্প উপন্যাস কবিতা ছাড়াও অন্যান্য ধরনের বই প্রকাশিত হচ্ছে। গান তৈরি হয়েছে। বন্দী শিবিরগুলো সংরক্ষিত করা হয়েছে এবং স্কুল ছাত্রদের সেখানে নিয়মিত নিয়ে যাওয়া হয়। হলোকাস্ট মিউজিয়াম শুধু ইউরোপে নয়, আমেরিকায়ও নির্মিত হয়েছে। তাছাড়া জাতি হিসেবে ইহুদীরা কখনও এই গণহত্যা পৃথিবীকে ভুলতে দেয়নি। সাইমন ওয়েজেনথেন নিজ প্রচেষ্টায় নাৎসি অপরাধীদের ধরার জন্য একটি সেন্টার স্থাপন করেছিলেন।
এই পরম্পরার সূত্রটি আমাদের মধ্যে ছিল না। যে কারণে এখনও গণহত্যা-নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবেও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। কারণ, বাংলাদেশের গণহত্যার স্মৃতি অবলুপ্ত হলে বা এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে বিএনপি-জামায়াত বা স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিদের রাজনীতির সুবিধা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারের যৌক্তিকতা থাকে না। সবচেয়ে বেশি লাভ হয় পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশগুলোর। কারণ, তারা মুসলমান হয়ে মুসলমান হত্যা করেছে এ নৈতিক দায় তাদের বহন করতে হচ্ছে। চলবে...