সমুদ্র হক ॥ দেশে প্রতি বছর অন্তত ১২ লাখ বিয়ে হয়, যার প্রায় ১২ শতাংশ বালিকা বধূ। এসব দম্পতি প্রতি বছর জন্ম দেয় প্রায় ৩০ লাখ শিশু। তবে জন্মহার অনেকটা কমেছে। বর্তমানে দুইয়ের অধিক সন্তান নেয়ার প্রবইতা কমে এসেছে। এদিকে বালিকা বিবাহ রোধে সরকার অন্তত ৩৭টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। সূত্র জানায়, শীঘ্রই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে সকল পদক্ষেপ নেয়া হবে।
জনসংখ্যায় টিনএজের (১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী) সংখ্যা আনুপাতিক হারে বেশি। বালিকা বিবাহের হার কমে একটি পর্যায়ে স্থিতি হয়ে থাকছে। সরকারের সিদ্ধান্ত আছে ২০৪১ সালের মধ্যে বালিকা বিবাহের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার। তা বাস্তবায়নের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া দরকার হলেও চলছে শম্বুকগতিতে। এদিকে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্কুলের শিক্ষার্থীরা (বালিকা) কম বয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে মানববন্ধন, মিছিল, সমাবেশ শুরু করেছে। সরকারের তথ্য অধিদফতর, সমাজকল্যাণ অধিদফতর নিজস্ব উদ্যোগে উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নেমেছে। বিভিন্ন সংগঠন বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কর্মসূচী নিয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে দেশে বাল্যবিয়ের হার ছিল ৭৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে তা নেমে দাঁড়ায় ৫২ শতাংশে। ২০১৫ সালের বেসরকারী জরিপে এ হার খুব একটা কমেনি। আন্যদিকে ইউনিসেফের এক জরিপে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫ বছরের নিচে কিশোরীদের ১৮ শতাংশকেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয় আর ১৮ বছরের নিচে বালিকাদের বিয়ের হার ৫২ শতাংশ। এসব কিশোরী ও বালিকার বিয়ের সময় কোন মতামতই নেয়া হয় না। উভয়পক্ষের অভিভভাবকদের সম্মতিতেই বিয়ে দেয়া হয়। মাঠপর্যায়ে বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোন জন্ম সনদ দেখা হয় না। অনেক সময় ইউনিয়ন কাউন্সিল ও পৌরসভা থেকে ভুয়া জন্ম সনদ সংগ্রহ করা হয়।
হালে শহর ও নগরীতে এ অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। বিয়ে নিবন্ধকগণ (কাজী হিসেবে যাদের অধিক পরিচিতি) এখন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) অথবা জন্ম নিবন্ধন সনদ দেখতে চাইছেন। উল্লেখ্য, ৪-৫ বছর আগে যেসব বালক-বালিকার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়ে এনআইডি কার্ডের জন্য ছবি তোলা হয়েছে তারা এখনও স্মার্ট এনআইডি কার্ড পায়নি। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন থেকে আপৎকালীন সময়ের জন্য এনআইডির যে প্রিন্ট দেয়া হয় তা গ্রহণযোগ্য। তবে অনেকেই তা সংগ্রহ করেনি। অনেকে বিষয়টি জানেও না।
সূত্রের খবর, বাল্যবিয়ে রোধে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে তার মধ্যে আছেÑ নিবন্ধনে (রেজিস্ট্রেশন বা কাবিননামা) বর-কনের ছবি সংযোজন বাধ্যতামূলক, বিয়ের দিনক্ষণ, বর-কনের জন্মের ও বয়সের দিন-মাস-বছর উল্লেখ থাকতে হবে। এর সঙ্গে এনআইডি, জন্ম নিবন্ধন সনদের ফটোকপি ও তার নম্বর কাবিননামায় থাকবে। কাজী ও মৌলবি (যিনি বিয়ে পড়ান) তাদের নাম-ঠিকানা সম্পূর্ণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। আইনী পদক্ষেপের পাশাপশি জনসচেতনতামূলক বহুমুখী কার্যক্রম হাতে নেয়া হবে।
ইউনিয়ন পরিষদ, পৌর এলাকা ও সিটি কর্পোরেশনের কাজী ও তাদের সহকারী এবং যারা বিয়ে পড়ান তাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। দায়িত্ব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারি করা হবে। উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাদের মামলা দায়েরের ক্ষমতা দেয়া হবে। সরকারী বিভিন্ন সুবিধাভোগী পরিবারের সদস্যদের বাল্যবিয়ে থেকে বিরত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যত্যয় ঘটলে সরকারী সুবিধা বাতিল হতে পারে।
বাল্যবিয়ে রোধে জনগণকে সচেতন করতে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনকে কাজে লাগানো হবে। মসজিদের খতিব বা ইমাম জুমার নামাজের খুতবায় মুসল্লিদের বাল্যবিয়ের কুফল ব্যাখ্যা করবেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বিয়ে নিবন্ধন, নিবন্ধনের সুবিধা, বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে খতিবের বক্তব্যের বিষয়গুলো তৈরি করে দেবে। জেলা ও উপজেলায় যারা বিয়ে পড়িয়ে থাকেন তাদের প্রশাসনের নিবন্ধন থাকতে হবে। তালিকাভুক্ত ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের বিয়ে নিবন্ধন ও আইনের বিষয়গুলো জানার প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হবে। কাজীর উপস্থিতিতে মৌলবিগণ বিয়ে পড়াবেন।
ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে ভুল তারিখের বা ভুয়া জন্ম সনদ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হবে। দরিদ্র পরিবারের বাল্যবিয়ে রোধে কিশোরী ও বালিকাদের সুরক্ষা প্রদানে সমাজসেবা অধিদফতরকে দায়িত্ব দেয়া হবে। এসব সিদ্ধান্তের পাশাপশি বাল্যবিয়ে রোধে তথ্যচিত্র, নাটিকা, বিয়ে নিবন্ধনের বিষয়গুলো নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান বানিয়ে তা বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বেসরকারী টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারের ব্যবস্থা করা হবে। জেলা তথ্য অফিস এ ধরেরন অনুষ্ঠান মাঠপর্য়ায়ে ছড়িয়ে দিতে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে।
দেখা গেছে, নারী শিক্ষিত হলে বাল্যবিয়ে অনেকটা কমে যায়। মাঠপর্যায়ে শিক্ষার গতিপ্রকৃতি এ রকম : প্রাথমিক স্কুলে শতভাগ ভর্তির পর মাধ্যমিক স্কুলে প্রবেশের হার নেমে যায়। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়ার পর উচ্চ মাধ্যমিকে প্রবেশ আরও কিছুটা কমে। এরপর উচ্চ শিক্ষায় আরও কমে। এ সময়ের মধ্যে অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। কম বয়সের বিয়েতে মেয়েদের মতামত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত হয়। আবার এমনও দেখা যায়, অল্প বয়সে কোন কিশোরী বা বালিকা প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে। তারা এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে যে, কখনও গোপনেও বিয়ের কাজটি সেরে নেয়। হালে এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তনও হতে শুরু করেছে। তবে তা হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে। বালিকাদের মতামত উপেক্ষা করে জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসার খবর পাওয়ার সঙ্গেই তা পৌঁছে দেয়া হচ্ছে উপজেলা প্রশাসনের কাছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বাল্যবিয়ে রোধ করতে সক্ষম হচ্ছেন। তবে এমনও হয়, বালিকার বিয়ে রোধ করার পর অভিভাবকরা কোন আত্মীয়র বাড়িতে নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে দেন।
পরিবারও বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। অনেক আগেই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গে নিউক্লিয়াস ফ্যামিলিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞের মতে, মোট প্রজনন হার (টোটাল ফার্টিলিটি রেট সংক্ষেপে টিএফআর) কমাতে সাফল্য এসেছে। ডেমোগ্রাফি (জনমিতিক) ও হেলথ (স্বাস্থ্য) জরিপ সূত্রের তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর টিএফআর ছিল ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ একজন মা গড়ে ৬ জনেরও বেশি সন্তান জন্ম দিতেন। বর্তমানে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩। চাইল্ড ম্যারেজ ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বালিকা বধূরাই জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিশোরী বা বালিকাদের বিয়ে দেয়ার এক বছরের মধ্যে তারা গর্ভধারণ করে শিশুর জন্ম দেয়। এসব মা দ্বিতীয় সন্তানও আগে নেয়। প্রতি বছর যে ১২ লাখ নারীর বিয়ে হয় তার মধ্যে ১ লাখ ৭০ হাজার জনই বালিকা। এ বালিকা বধূদের শ্বশুরবাড়ির লোকজনই বিয়ের প্রথম বছরেই গর্ভধারণের জন্য চাপ দেয়। বালিকা বধূ হওয়ার পর গর্ভধারণ করায় মাতৃমৃত্যুর বড় ঝুঁকি থাকে। একজন অভিভাবক বললেন, অভিভাবক ও নারী শিক্ষিত হলে বালিকা বধূ হওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যাবে।