১৯৭১ সালে বাংলাদেশ যে ভাষাভিত্তিক জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে এক রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করল তার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মহান সংগ্রামে। আজ থেকে প্রায় সহস্র বছর আগে প্রাকৃত ভাষার বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার জন্ম। বাংলা ভাষার জন্মের সেই ঊষালগ্নেই বৌদ্ধ, চর্যা ও দোহার কবি ভূষক দৃপ্তকণ্ঠে বলেছেন, তিনি বাঙালী।
বৈষ্ণব পদাবলি, মঙ্গল কাব্য ও আখ্যানমূলক কাব্যকে আশ্রয় করে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে দশম শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে। বৈষ্ণব পদাবলি বিশ্ব সাহিত্যের লিরিক বা গীতি কবিতার ক্ষেত্রে এক অসাধারণ সংযোজন। বৈষ্ণব কবিরা রূপক বা প্রতীকের মধ্য দিয়ে নর-নারীর প্রেমকে এক অনন্য কালজয়ী ব্যঞ্জনা দিয়েছেন।
বিদ্যাপতির-
জনম্ অবধি হাম
রূপ নেহারিলু
নয়ন ন তিরপিত ভেল
লাখ লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলু
তবু হিঁয়ে জুরন ন গেল।
অথবা চণ্ডিদাসের-
সখী, বলিতে বিদরে হিয়া
আমারই বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমারই আঙিনা দিয়া,
-প্রভৃতি চরণ প্রেমের চিরন্তন অভিব্যক্তিরই প্রকাশ।
প্রত্যাখ্যানের গভীর বেদনায় মর্মাহত হয়ে প্রেমিকার এই উক্তি দেশ ও কালের মাত্রাকে অতিক্রম করে-
আমারই পরান যেমতি করিছে
তেমতি হউক সে।
প্রেম যে কোনো বন্ধনে আবদ্ধ নয়, তা যে জাত্যাভিমান, সব রকমের উঁচু-নিচু শ্রেণীভেদ ও বিত্তের অহঙ্কার পার হয়ে যেতে পারে এবং তা যে নিখাদ সোনা, সে কথাও ধোপানীর প্রেমে আত্মহারা ব্রাহ্মণ কবি দ্বিজ চণ্ডিদাস জানাতে কুণ্ঠিত হননি-
রজকিনী প্রেম, নিকষিত হেম
কাম গন্ধ নাহি তায়।
ভারতীয় সাহিত্যের মধ্যে বাংলা বৈষ্ণব পদাবলিতেই প্রথম দেহাতীত প্রেমের বন্দনা করা হয়েছে। বিশ্বসাহিত্যে বিদেহী প্রেমের প্রথম প্রকাশ রেনেসাঁস কবিদের লেখায়, বিশেষত দান্তের অমর কাব্যে,
প্রেত্রার্কের সনেটে। ভাবতে অবাক লাগে, রেনেসাঁসের যে-মর্মবাণী মানবতাবাদ তা সমকালীন বাঙালী কবির কণ্ঠেও ভাষা পেয়েছে। বর্ণ ও সব রকমের ভেদাভেদের উর্ধে উঠে মানুষকে তার মানবত্বে অভিষিক্ত করতে বাঙালী কবি উদাত্ত ডাক দিয়েছেন-
শুন হে মানুষ ভাই,
সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
ষোড়শ শতকের বঙ্গে এক ধরনের অপরিণত রেনেসাঁসের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু য়ুরোপের রেনেসাঁস যেমন বণিক পুঁজিকে অবলম্বন করে শ্রেণীদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল বাংলাদেশে সে ধরনের কোন বিবর্তন ঘটেনি। কেন ঘটল না তা বোঝা প্রয়োজন।
বাংলা, অসমিয়া, ওড়িয়া, হিন্দী, গুজরাটি ইত্যাদি লৌকিক মাতৃভাষার বিকাশের সূচনা হয়েছিল প্রায় এক হাজার বছর আগে। প্রায় একই কালে ইউরোপেও বিভিন্ন লৌকিক মাতৃভাষা যেমন ইতালি, প্রভেনকাল, স্প্যানিশ, ইংরেজী, ফরাসী প্রভৃতি ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছিল। লৌকিক ভাষাকে অবলম্বন করেই ইউরোপে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে চতুর্দশ থেকে অষ্টাদশ শতকের মধ্যে, বিভিন্ন জাতীয় রাষ্ট্রেরও উদ্ভব হয়। ইউরোপে জাতীয়তাবাদের বিকাশে ভাষার যেমন একটা ভূমিকা ছিল, তেমনি বিরাট ভূমিকা রয়েছে উৎপাদন পদ্ধতির, শ্রেণী সংগ্রামের। উৎপাদন শক্তির বিকাশ ও শ্রেণী সংঘাতের মধ্য দিয়ে জনগণের অধিকার প্রাপ্তিই জাতীয়তাবাদের আর্থ-সামাজিক ভিত্তি রচনা করেছিল।
মধ্যযুগে, ভারতবর্ষের মতো ইউরোপেও নানা ভাঙ্গা-গড়া ঘটেছে, শার্লেমনের অধীনে ইউরোপের বিরাট অংশ ক্যারোলেনজিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। পরবর্তীকালে তার সাম্রাজ্য তার তিন প্রপৌত্রের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। এর বহুদিন পরেও হোলি রোমান সম্রাট কে হবেন বা ইউরোপের সাম্রাজ্য কার হবেÑ এই নিয়ে ইতালি, ইংরেজ, ফরাসী, জার্মান রাজন্যবর্গের মধ্যে দ্বন্দ্ব অব্যাহত ছিল। নর্মান বিজয়ের (১০৬৬ খ্রিস্টাব্দ) দুই শতাব্দী পরেও ইংল্যান্ডের রাজা তার নর্মান্ডির জমিদারির জন্য ফরাসী রাজার অনুগত সামন্ত রাজা ছিরেন। তাকে ফরাসী-রাজের কাছে আনুগত্য স্বীকার করতে হত। ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ইংল্যান্ডের রাজভাষা ছিল ফরাসী, নরম্যান রাজারা ফ্রান্স থেকে আসার কারণে। এমনকি অষ্টাদশ শতকেও ইংল্যান্ডের রাজা আনা হয়েছিল জার্মান রাজবংশ থেকে যিনি ইংরেজী জানতেন না। মধ্যযুগের ইউরোপে বিভিন্ন রাজ্যের সীমানা নির্ধারণ, ভাঙ্গা-গড়া ইত্যাদি হতো সামন্ত রাজদের অধিকারকে কেন্দ্র করেই। তাই, একেক রাজ্যে এমন সব রাজা-রানী আসতেন যাদের সঙ্গে সেই সব দেশের জনগোষ্ঠীর ভাষাগত ও অন্যান্য সম্পর্ক থাকত খুবই ক্ষীণ। কিন্তু সামন্ততন্ত্রের অবক্ষয় এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন নিয়ে এলো। ধনতন্ত্রের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে যে নতুন বণিক শ্রেণী, শিল্পপতি শ্রেণী, কারিগর শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণী গড়ে উঠল তাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন হলো শিল্পপণ্য। সারাদেশ এবং অনেক সময় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পণ্য বাজারের বিস্তারের ফলে সামন্ত আনুগত্য ও সম্পর্কের ক্ষয় হয়ে নতুন সব সম্পর্কের সৃষ্টি হলো। পণ্য ও পণ্য-বাজারের বিকাশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করেছিল। বণিক ও শিল্পপতিরা দেখেছিলেন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের প্রধান বাধা সামন্ত সম্পর্ক। তাই বিভিন্ন বিপ্লবের মাধ্যমে বণিক ও পুঁজিপতি শ্রেণী ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যের রাষ্ট্রযন্ত্রকে তাদের করায়ত্ত করে যেসব সামন্ত-সম্পর্ক উন্নয়নের বাধা হিসেবে ছিল সে সবের অবলোপ ঘটায়।
বুর্জোয়া বিপ্লবের মাধ্যমে ইউরোপের বুর্জোয়া শ্রেণী ব্যক্তি মানুষের অধিকারের সীমা প্রসারিত করেছিল। আইনের চোখে সবার সমান অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য শ্রমজীবী শ্রেণীও বুর্জোয়া বিপ্লবের সহায়ক শক্তি হয়েছিল, পণ্যের বাজারে শ্রমজীবী শ্রেণী স্বাধীনভাবে তার শ্রমকে বিক্রয়ের অধিকারও পেয়েছিল। এই প্রক্রিয়ার প্রায় একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও জাতীয় রাষ্ট্রের সৃষ্টি-কাজের সূচনা ঘটে। জার্মানি, ইতালি ইত্যাদি দেশে অষ্টাদশ শতাব্দী এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীতেও যে সামন্ততন্ত্রের অবশেষ ছিল বিপ্লবের মাধ্যমে তাকে উৎখাত করার প্রয়োজন হয়েছিল দেশজুড়ে পণ্য-বাজার সৃষ্টির প্রয়োজনেই। বিসমার্কের নেতৃত্বে জার্মানির একীকরণ ও গ্যারিবন্ডি, মাৎসিনী ও কাভুরের নেতৃত্বে ইতালির একত্রীকরণ বা জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলেই জার্মানি এবং ইতালিতে পুঁজিবাদের বিকাশ বন্ধনমুক্ত হয়ে অবাধ পণ্য-বাজারের সৃষ্টি হয়। ইউরোপের দেশে দেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষে অর্থনৈতিক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন হাত ধরাধরি করেই চলেছিল।
একাদশ দ্বাদশ শতক থেকে লৌকিক মাতৃভাষার মাধ্যমে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির যে রেনেসাঁসের সূচনা হয়েছিল তাই পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটায়। এক ভাষাভাষী লোক অনুভব করতে থাকে তাদের স্বার্থ অভিন্ন। দেশের ও জাতির উন্নতির সঙ্গে তাদের ব্যাস্টিক উন্নতি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এই ভাবনা ও ধারণা এসেছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও অধিকারবোধের বিকাশের ফলেই। ব্যক্তির এই ধারণার অবসান হয়েছিল যে রাজায় রাজায় যুদ্ধে তার কোন কিছু যায় আসে না। ব্যক্তির আনুগত্য সামন্তের কাছ থেকে রাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছিল, কারণ রাষ্ট্রের ভাগ্য-নিয়ন্ত্রণে তার অধিকারের স্বীকৃতি সে পেয়েছিল রাজনৈতিক স্বাধীনতাপ্রাপ্তির বা গণতান্ত্রিক অধিকারপ্রাপ্তির মাধ্যমে। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালীর দুর্ভাগ্য তাকে এই ধরনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত।
দশম শতাব্দী থেকে বৌদ্ধ চর্যা ও দোঁহা পদে বাংলা ভাষার যে পদচারণা সূচিত হয়েছিল তাই সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে নব নব ধারায় বিকশিত হয়ে মহাকল্লোলের সৃষ্টি করলেও বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের বা জাতীয় রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। এর অন্যতম কারণ এই উপমহাদেশের প্রায় অবিচল উৎপাদন-পদ্ধতির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে উপমহাদেশে যে গ্রাম-সমাজের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তনের ধাক্কা লাগলেও তার সামাজিক, অর্থনীতির ভিত্তি প্রায় অনড়ই ছিল বলা চলে। এই সামাজিক অর্থনীতি ছিল গ্রামীণ কৃষক ও গ্রামীণ কারিগরের পারস্পরিক আদান-প্রদানের অবিচ্ছেদ্য নির্ভরতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। প্রত্যেক গ্রামে কামার, কুমার, ছুতার, তাঁতী, নাপিত, ধোপা, তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করত। গ্রামের কৃষির বা কৃষকদের সব প্রয়োজন এ কারিগররা মেটাত এবং এদের প্রয়োজন মেটাত কৃষকরা। পারস্পরিক দেয়া-নেয়ার ওপর ভিত্তি করে গ্রামীণ স্বয়ম্ভর অর্থনীতি যে অবয়ব পেয়েছিল, তাতে বিভিন্ন স্তরবিন্যাস থাকলেও ইউরোপের সামন্ত অর্থনীতির মতো উৎপাদনের ভাগ নিয়ে সেখানে তীব্র শ্রেণী-সংগ্রামের প্রকাশ ঘটেনি। জমিদার বা গ্রামপ্রধান যে ছিল না তা নয়, কিন্তু এদের কাজের পরিধি মুখ্যত ভূমি রাজস্ব আদায়েই সীমাবদ্ধ ছিল, কদাচ এরা ইউরোপের সামন্তের মতো ভূমির অধিকার দাবি করে রাষ্ট্রের বা রাজশক্তির সঙ্গে অধিকারের দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়েছিল। গ্রামগুলোর মধ্যে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনও ছিল গ্রাম পঞ্চায়েতের সূত্রে। গ্রামীণ চৌহদ্দির মধ্যে গ্রামবাসী এক ধরনের গণতান্ত্রিক অধিকারও ভোগ করত। কিন্তু রাষ্ট্র বা রাজশক্তি থেকে সে কোন রাজনৈতিক অধিকার আদায় করতে পারেনি। বস্তুত রাষ্ট্রের অবস্থান ছিল ব্যক্তি থেকে অনেক দূরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তির জীবন আবর্তিত ও আলোড়িত হত তার পরিবারের, গোত্রের, গোষ্ঠীর এবং গ্রামের সঙ্কীর্ণ বৃত্তের মধ্যে। ফলে জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ থেকেও শ্রেয়, এ ধরনের উক্তি শোনা গেলেও, জন্মভূমির প্রতি ভালাবাসা কোন জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়নি। তাই আমরা দেখি, পলাশীর প্রান্তরে তুর্কি সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে যখন ইংরেজ ক্লাইভের যুদ্ধ হচ্ছিল, অদূরেই কৃষককুল অনুদ্বিগ্নচিত্তে কৃষি কাজে ব্যাপৃত ছিল। তাদের কাছে এই যুদ্ধ দুই রাজার মধ্যে সিংহাসনের যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু বলে প্রতিভাত হয়নি। রাষ্ট্র বা রাজশক্তির সঙ্গে স্বীয় স্বার্থের কোন অবিনা-যোগ তাদের পক্ষে ভাবাই সম্ভব ছিল না। বংশপরম্পরায় তারা এ ধরনের যুদ্ধ দেখেছে, যুদ্ধের কথা শুনে এসেছে, তাদের সুদূর কল্পনায়ও আসা সম্ভব ছিল না যে এই যুদ্ধের ফলে এই উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রিক জীবনে কী বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হতে যাচ্ছে।
প্রাক-ব্রিটিশ বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের বিকাশ হয়নি বলার মানে কিন্তু এই নয় যে, বাঙালীর জাতিসত্তারও স্ফুরণ হয়নি। অনেক আগে থেকেই তা পদ্ম-কোরকের মতো উন্মেষিত হচ্ছিল ভাষাকে কেন্দ্র করে। হাজার বছর আগেই চর্যাপদের কবি কি বলেননি ভূষক বাঙালী ভইলি! ভাষাভিত্তিক এই জাতিসত্তা ধর্ম (ৎবষরমরড়হ), বর্ণ (ৎধপব), গোত্র (ঞৎরনব), গোষ্ঠীকে (এৎড়ঁঢ়) অতিক্রম করেই রূপ নিয়েছিল। তাই দৃপ্তকণ্ঠে কবি আবদুল হাকিম বলেছেন-
যেজন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
বাংলায় যে জন্মেছে, যে বাঙালী, বাংলাই যে তার জীবনাচরণের ভাষা হবে, এতে কবির কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তবুও আমরা জানি প্রায় সারা মধ্যযুগে বাংলা যারা শাসন করেছেনÑএ দেশের রাজা-বাদশা, সুবেদার, দেওয়ানÑ তারা ছিলেন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহিরাগত। রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষাও বাংলা ছিল না। কিন্তু তা নিয়ে বাংলার অধিবাসী বাঙালী উত্তেজিত হয়নি। কারণ রাষ্ট্র তখনও তার কাছে সুদূর সত্তা।
ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের এবং ইংরেজী ভাষার মাধ্যমে ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের, অধিকারবোধের সংস্পর্শে এসেই এ দেশবাসী সর্বপ্রথম যথার্থ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। সে বুঝেছে কীভাবে এ দেশ শোষিত হচ্ছে, রাষ্ট্রিক-ব্যক্তি হিসেবে কী তার দৈন্য এবং তার এই দৈন্যের উৎস কী। ইংরেজ শাসনই প্রথম তাকে আইনানুগ অধিকার দিয়েছে, সাংবিধানিক অধিকার দিয়েছে। এই অধিকারবোধই তাকে স্বাধীনতা চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছে, তার মধ্যে জাতীয়তাবোধকে জাগ্রত ও উদগ্র করেছে।
এই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্কিমচন্দ্র আক্ষেপ করেছিলেন যে, বাঙালীর কোন ইতিহাস নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীর লেখকরা বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছিলেন। উগ্র জাতীয়তাবোধ থেকে একজন বাঙালী কবি এমন কথাও বলেছিলেন যে, বিদেশের ঠাকুরের চেয়ে দেশের কুকুরও ভাল। কবি রঙ্গলাল লিখেছেনÑ
স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় রে
কে বাঁচিতে চায়।
রামনিধি গুপ্ত স্বদেশী ভাষার গুণ-কীর্তন করে বলেছেন-
নানান দেশের নানান ভাষা
বিনা স্বদেশী ভাষা
পুরে কি আশা
কবি মধুসূদন দত্ত খ্রীস্টান হয়ে তার নামের সঙ্গে মাইকেল যুক্ত করেছিলেন, প্রথম জীবনে ইংরেজীতে কাব্য রচনা করেছিলেন, কিন্তু তার সৃষ্টিতেও স্বভাষা, স্বজাতিপ্রীতি জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে নানাভাবে বাণীরূপ পেয়েছে।
যে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে (অবোধ আমি)
অবহেলা করি-
পরধন লোভে মত্ত
করিনু ভ্রমণ
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালীর জাতীয়তাবোধের উন্মেষ হয়েছিলÑ রাষ্ট্রশক্তি বিজাতীয় এবং রাষ্ট্রে সে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পূর্ণতা পাচ্ছে নাÑএই অভাববোধকে কেন্দ্র করে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে সারা ভারতজুড়েই জাতীয়তাবোধের উন্মেষ হয়।
ইংরেজরা ভারতবর্ষকে প্রকৃত অর্থেই একটি এক সত্তাবিশিষ্ট রাষ্ট্রে পরিণত করে বাঙালী, গুজরাটি, হিন্দী, মারাঠি, তামিল, কানাড়ি প্রভৃতি জাতিসত্তাকে এককেন্দ্রিক প্রশাসনিক কাঠামোর অধীনে নিয়ে এসেছিল। ফলে বিদেশী ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অধিকারের আন্দোলন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। তাই আমরা দেখি, বাঙালীর ও অন্যান্য জাতিসত্তার স্বাধীনতার আন্দোলন একই সঙ্গে নিজস্ব জাতিসত্তার ও সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদের দোলাচলকে কখনই সম্পূর্ণভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এই দোদুল্যমানতার একটা আর্থ-সামাজিক কারণও ছিল। ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কোন বুর্জোয়া ভিত্তি ছিল না। এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল পেশাজীবী শ্রেণীÑবুর্জোয়া অর্থাৎ বণিক বা শিল্পপতি শ্রেণী নয়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের এই অবিন্যস্ত ভিত্তির জন্য ইংরেজ শাসকদের পক্ষে এই আন্দোলনকে বার বার পথচ্যুত করা এবং বিপথে চালানো সম্ভব হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্ব এই বিপথগামিতারই অবৈধ সন্তান।
দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয় তার শাসকরা স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে ধর্মকে অবলম্বন করেছিল। তাই তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল উর্দুকে এই অজুহাতে যে উর্দু ইসলামী ভাষা। বস্তুত উর্দু এবং বাংলা দুটোই আর্য ভাষা, যদিও উর্দু আরবী হরফে লেখা হয়ে থাকে। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে, তা যতই বিকৃত হোক, পাকিস্তান রাষ্ট্র অর্জিত হয়েছিল। এই রাষ্ট্রে বাঙালীকে যখন তার রাষ্ট্রীয় ভাষার অধিকার থেকে বঞ্চনা করার চেষ্টা করা হলো বাঙালী তা বুকের রক্ত দিয়ে প্রতিহত করল। আমরা আগেই দেখেছি বাঙালী সব সময় তার ভাষাকে গভীরভাবে ভালবেসেছে, লালন করেছে, ভাষার জন্য তার গর্ব আকাশস্পর্শী। এই অহঙ্কার মধ্যযুগের কবিদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু মধ্যযুগে বাঙালীর রাজভাষা বাংলা ছিল না। বিভিন্ন সময়ে তা বিভিন্ন বিদেশী ভাষা ছিল। তখন কিন্তু বাঙালী এই নিয়ে মাথা ঘামায়নি, আন্দোলন তো দূরের কথা? তাহলে কেন পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী, বিশেষত শিক্ষিত বাঙালী ভাষার প্রশ্নে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ল ১৯৫২ সালে! এর কারণ জাতিসত্তাবোধে বা জাতীয়তাবাদে নিহিত। ভাষা আন্দোলনেই বাঙালীর প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়েছে। এই জাতীয়তাবাদের বাণী অত্যন্ত সুন্দরভাবে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ব্যক্ত করেছেন-‘উর্দুকে শ্রেষ্ঠ ভাষা, ধর্মীয় ভাষা বা বনিয়াদী ভাষা বলে চালাবার চেষ্টার মধ্যে যে অহমিকা প্রচ্ছন্ন আছে তা আর চলবে না। নবজাগ্রত জনগণ আর মুষ্টিমেয় চালিয়াত বা তথাকথিত বনিয়াদী গোষ্ঠীর চালাকিতে ভুলবে না।’
তিনি আরও বলেছেনÑ
‘আমাদের দেশেও, নোতুন পাকিস্তান রাষ্ট্রে জনগণ প্রমাণ করবে যে তারাই রাজাÑউপাধিধারীদের জনশোষণ আর বেশি দিন চলবে না। বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের ওপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।’
ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালী তার রাজনৈতিক অধিকারেরই প্রতিষ্ঠা চেয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে ভাষা আন্দোলন সাংস্কৃতিক আন্দোলন হলেও এর মধ্যেই সুপ্ত ছিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আকাক্সক্ষা। বাঙালী ভেবেছিল রাষ্ট্রভাষা যদি উর্দু হয় তাহলে তা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তার অধিকারকে বিরাটভাবে বাধাগ্রস্ত করবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বিজয় অর্জন করার ওপর বাঙালী দেখল, ভাষার অধিকার পেলেও রাজনৈতিক ও অর্থনেতিকভাবে তার স্বাথীনতা অপ্রাপ্যই রয়ে গেছে। তাই, ভাষা আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। তবে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ বাঙালীকে পূর্ণ রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যে মহান স্বপ্নে উজ্জীবিত করেছিল সেই-স্বপ্নকে এখনও আমরা পূর্ণতা দিতে পেরেছি কি?
শীর্ষ সংবাদ: