ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

জলি রহমান

টিপিপি চুক্তি বাতিলে স্বস্তিতে বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

টিপিপি চুক্তি বাতিলে স্বস্তিতে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরেকটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন টিপিপি (ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ) চুক্তি প্রত্যাহারের মাধ্যমে। দীর্ঘ দশ বছর আলোচনার পর ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র্রসহ এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ১২টি দেশ টিপিপি চুক্তিতে সই করে। দেশগুলো হলো-যুক্তরাষ্ট্র্র, কানাডা, অষ্ট্র্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, মেক্সিকো, ব্রুনাই, চিলি, মালয়েশিয়া, পেরু, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। যারা বৈশ্বিক মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৪০ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এবং এর আওতায় ছিল ৮০ কোটি মানুষের বাজার। টিপিপির উদ্দেশ্য ছিল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে শুল্কমুক্ত বানিজ্য সুবিধা এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা। এই চুক্তি বাস্তবায়নে সদস্য দেশগুলোর ৮০ ভাগ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণকারী কমপক্ষে ৬টি দেশের অনুমোদন ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে দরকার ছিল। শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র্রের অংশগ্রহণ ছিল অপরিহার্য। কিন্তু সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে দিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি এই চুক্তি প্রত্যাহার করায় ২৫ কোটি ভোক্তার বাজার বাদ দিতে হবে অন্য দেশগুলোকে। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ কিছু দেশ উল্লেখ করেছেন যুক্তরাষ্ট্র্র ছাড়াই বিকল্প চুক্তি সম্ভব। তবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ২৫০ মিলিয়ন ভোক্তাকে ছাড়া টিপিপি হবে অর্থহীন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজ দেশকে আত্মনির্ভরশীল করতেই এ ঘোষণা দিয়েছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের নির্বুদ্ধিতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে এ চুক্তি বাতিলের সংবাদ বাংলাদেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে বলেও মনে করছেন তারা। ট্রাম্পের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে ক্ষতিটা তাদেরই বেশি হবে। চুক্তি বাতিলের পেছনে আত্মনির্ভরশীলতার কথা বলা হলেও এতে তাদের জীবনযাত্রার মানের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা এতদিন যেসব পণ্য সস্তায় ভোগ করত এর ফলে তা সহজলভ্য হবে না। চুক্তি বাতিল বাংলাদেশ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রেও সরাসরি তেমন কোন প্রভাব ফেলবে না। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম উভয় দেশকে গড়ে প্রায় ১৬ শতাংশ শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি করতে হয়। তাই বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামের এ চুক্তির অন্তর্ভুক্তিতাই ছিল চিন্তার কারণ। এখন তা বাতিল হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য হয়েছে স্বস্তির। এই বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক ড. নাজনিন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘প্রথমত এতো বড় চুক্তি না হলে উন্নত দেশের মধ্যে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তাদের নিজেদের মধ্যে আলাদা বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে। তথ্যগত (থিউরিটিক্যাল) দিক থেকে বলা হলেও, বাণিজ্য চুক্তি দুপক্ষের জন্য সুফল বয়ে আনবে। সেই দিক থেকে টিপিপি সদস্যরা যে নতুন সুবিধা পেতেন, তা হয়ত হবে না। কিন্তু সরকার টু সরকার যে চুক্তি রয়েছে, তার আওতায়ও তারা বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন টিপিপি বাতিল হলে যে অসুবিধা হতে পারে তা হলো- একে অন্যের কাছ থেকে যে প্রযুক্তিগত বা কারিগরি সহায়তা পেত, হয়ত তা সেই অর্থে পাবে না। এর সদস্যরা এই সুফল থেকে বঞ্চিত হবে।’ ট্রাম্প নিজের দেশে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে এবং বাহিরের পণ্য নিজের দেশে ঢুকতে না দেয়ার জন্য এই উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা এতদিন সস্তায় যেসব পণ্য পেত তা আর সহজলভ্য না হলেও তারা এতো বেশি উন্নত দেশ যে এজন্য তাদের সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে জনসাধারণের মধ্যে কিছু সময়ের জন্য প্রভাব পড়বে। কারণ তারা সস্তায় ভোগ করতে অভ্যস্ত। টিপিপি চুক্তি বাতিল বাংলাদেশের রফতানির ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে জানতে চাইলে পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ‘এতে আমাদের শঙ্কা দূর হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তাই তার কাছ থেকে বাণিজ্যের বাধাগুলো দূর করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী। বিশেষ করে স্থগিত হওয়া জিএসপি পুনর্বহাল এবং সকল পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে চাই আমরা।’ সালাম মুর্শেদী আরও বলেছেন, ভিয়েতনাম পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী। কোন প্রতিদ্বন্দ্বী কোথাও বাড়তি সুবিধা পেলে তা অন্য প্রতিযোগীদের বেকায়দায় ফেলে। তাই টিপিপি হলে ভিয়েতনামের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি একটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ত। টিপিপি বাতিল হওয়ায় সেই আশঙ্কা আর থাকছে না। বেসরকারী গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ট্রাম্পের বাণিজ্যনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সংরক্ষণমুলক নীতি ফুটে উঠছে। ট্রাম্প বহুমুখী আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে যাওয়ার কথা বলেছেন। অর্থাৎ ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বাণিজ্যকে অগ্রাধিকার দেয়ার নীতি গ্রহণ করছে। মার্কিন শ্রমস্বার্থও তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তা রক্ষার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের বিশ্ব বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবেশ, শ্রম অধিকারসহ অন্যান্য বিষয়ও বিবেচনা করতে পারে। এসব নীতি কার্যকর হলে বর্তমানে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশ যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারছে, তা সংকুচিত হতে পারে। এবং যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এরূপ সংরক্ষণমূলক নীতিতে এগোতে থাকলে শ্রমস্বার্থ রক্ষায় পরিবেশ, সুশাসন, শ্রমিক অধিকারসহ নানা বিষয়ে বিশ্বব্যাপী প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা বাংলাদেশের ওপরও পড়তে পারে। তবে বিষয়টি এখনো পরিষ্কার নয়। তাই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে আগামী এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জিএসপি সুবিধা পাওয়ার নির্ধারিত বৈঠক ফলপ্রসূ করতে গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়া। টিপিপি নিয়ে বাংলাদেশ, চীন, ভারতসহ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানিকারক দেশগুলো ছিল চরম আতঙ্কে। আর এদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভিয়েতনামের বাড়তে থাকে আনন্দ। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেতে থাকে ভিয়েতনামের টেক্সটাইল ও বস্ত্রশিল্পে, যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত রফতানির আশায়। যা ছিল বাংলাদেশের জন্য বিপজ্জনক। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের টিপিপি বাতিলের ঘোষণার পর সেই বিপদ কেটে যায়। বাংলাদেশে এখন জিএসপি পুনর্বহালসহ আরও সুবিধা পাওয়ার আশা করছে রফতানিকারকরা। টিপিপি বাতিলের সময় ট্রাম্প বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তিতে থাকবে না। সে কারণে উত্তর আমেরিকার অন্য দুই দেশ কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে কার্যকর থাকা নাফটা চুক্তি পর্যালোচনা করে বাতিল করার কথা বলেছেন তিনি। টিপিপির পর নাফটা বাতিল হলে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটলে তাতেও স্বস্তির আশা করছে বাংলাদেশ। কারণ ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরের পথে হাঁটছেন। ফলে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে যে শুল্ক ও কোটামুক্ত রফতানি সুবিধা চেয়ে আসছে, তা আগামী দিনে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর তা না হলেও ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে বাংলাদেশের পোশাক রফতানির ওপর এখন যে সবচেয়ে বেশি শুল্কারোপ রয়েছে, তা কিছুটা কমানো সম্ভব হতে পারে।
×