ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১

গেরিলাযোদ্ধা রাজার নেতৃত্বে ওই আক্রমণেই থানা ছেড়ে পালায় পাকসেনারা

তানোর থানা দখলে নিতে আমাদের তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ২২ ডিসেম্বর ২০১৬

তানোর থানা দখলে নিতে আমাদের তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ ২৯ নবেম্বর, ১৯৭১। তানোর থানা দখল নিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেও মাত্র একরাতের যুদ্ধেই সেদিন শত্রুমুক্ত হয় রাজশাহীর তানোর উপজেলা। গেরিলাযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজার নেতৃত্বে পরিচালিত ওই যুদ্ধে পিছু হটতে বাধ্য হয়ে এক পর্যায়ে থানা ছেড়ে পালিয়ে যায় পাকসেনারা। একাত্তরে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ফাইনালের ছাত্র। এখন আলুপট্টির বাসিন্দা। মহান বিজয়ের মাসে জনকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় সফিকুর রহমান রাজা তুলে ধরেন গেরিলাযুদ্ধের খুঁটিনাটি। যুদ্ধে সহযোদ্ধাকে হারানোয় তার কণ্ঠ যেমন আবেগতাড়িত হয়ে উঠে তেমনি পাকসেনাদের বিতাড়িত করার তথ্য তুলে ধরার সময় তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় উচ্ছ্বাসের সুর। গেরিলা লিডার সফিকুর রহমান রাজা বলেন, ‘সে রাতের যুদ্ধের পরেই পাকিস্তানী আর্মি তানোর থেকে পুলিশ বাহিনীসহ সব সরিয়ে নিয়েছিল। তখন থেকেই এই অঞ্চল প্রায় মুক্ত। এরপর ১৭ ডিসেম্বর তানোর থানাতে আমি স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলন করি। এই দিনটি এখনও আমার কাছে স্মরণীয়।’ এক প্রশ্নের উত্তরে সফিকুর রহমান রাজা জনকণ্ঠকে বলেন, যুদ্ধে অংশ নিলেও তাদের হাতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল খুবই কম। শুধু সাহস নিয়ে কৌশল খাটিয়েই বিতাড়িত করা হয় শত্রুদের। তিনি বলেন, ‘প্রতি রাতেই তানোর থানায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনদের ধরে নিয়ে আসত, থানায় এনে নির্যাতন করা হতো। আবার অনেককেই রাতের বেলা নিয়ে যাওয়া হতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে। সেখানে ব্যাপক টর্চার করা হতো। অনেককে মেরেও ফেলা হতো।’ রাজার ভাষ্য ‘আমরা বাগদানী এবং দুয়ারী ব্রিজ টার্গেট করলাম। ব্রিজ দুটি উড়ানোর পরিকল্পনা করলাম। কারণ এই দুটি ব্রিজ ব্যবহার করেই তানোরে আসত পাকসেনারা। এই দুটো ব্রিজ ভেঙ্গে দিলে তাদের আসা যাওয়াটা যেমন বন্ধ হয়ে যাবে, তেমনি আমরা যারা গেরিলা যোদ্ধা আছি তাদের থাকাটাও নিরাপদ করতে পারব। এতে জনগণকেও রক্ষা করার মতো একটা অবস্থা সৃষ্টি হবে। তবে ব্রিজ উড়াতে গিয়ে দুয়ারী-বাগদানীর মাঝামাঝি পাক সেনাবাহিনীদের হাতে ঘেরাও হয়ে গেলাম। শুরু হয়ে গেল আক্রমণ। আমাদের পক্ষ থেকে শুরু হলো পাল্টা আক্রমণ। কিন্তু আমাদের অস্ত্রশস্ত্র সীমিত। আমাদের প্রতিটা গেরিলার কাছে যে অস্ত্র থাকে, তা দিয়ে এক ঘণ্টার বেশি যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।’ তিনি বললেন, ‘আমরা যে ৪০-৫০ মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম, তাদের সকলের কাছে এ্যামুনিশন প্রায় শেষের পথে। একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা পিছু হটতে বাধ্য হলাম। সকাল হয়ে গেল। কিছু মুক্তিযোদ্ধা হটে এসে শেল্টারে অবস্থান নিতে পারলাম। বুরুজ ঘাটে আইয়ুব চেয়ারম্যান নামে মুসলিম লীগের এক লোক ছিলেন, তার ওই এলাকায় আধিপত্য ছিল। ৬ মুক্তিযোদ্ধা ওই এলাকায় গিয়ে ধরা পড়ে গেল। দুপুর নাগাদ খবরটা পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পনা- যে করেই হোক আক্রমণ করে তাদের উদ্ধার করতেই হবে। রাতের মধ্যে উদ্ধার করা না হলে তাদের জোহা হলে নিয়ে টর্চার করবে। সেই কারণে আমরা সেদিনই আবার তানোর থানা আক্রমণ করলাম। অতর্কিত থানায় ঢুকে পড়লাম। আমাদের আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানী মিলিশিয়া বাহিনীর সবাই পালিয়ে গেল। আমরা কিন্তু কেউ হতাহত হইনি। কিন্তু একজন এসে যখন থানার ভেতরের লকআপ খুলতে গেল ঠিক তথনই গুলি এসে লাগল ওই মুক্তিযোদ্ধার পায়ে। আমরা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। ধরে আনা লোকদের থানায় যেভাবে টর্চার করা হয়েছে তা নির্মম। আমরা যখন তাদের উদ্ধার করি তখন তাদের শারীরিক যে অবস্থা, নির্যাতনÑ তা দেখার মতো ছিল না। কারো চোখে রক্তাক্ত, কারো দাঁত উপড়ে ফেলা হয়েছে। থানাতেই তাদের নির্যাতন করা হয়েছিল। তানোর থানায় আমরা পরপর কয়েক দফা আক্রমণ করেছিলাম কিন্তু তানোর থানার যেসব বাঙ্কার ছিল সেগুলো পাকাপোক্ত।’ তিনি বলেন, ‘২৯ নবেম্বরে তানোর থানায় শেষ আক্রমণ করি। এই আক্রমণে ৩০-৩৫ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিই। চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে থানা ঘিরে ফেলি। তানোর থানা আক্রমণে পশ্চিম-দক্ষিণ দিক দিয়েই মূলত আসা হয়েছিল কিন্তু ১০০ থেকে সোয়াশ’ গজের ব্যবধানে আমরা ওখানেই থেমে যাই। তখন ওখান থেকে গোলাগুলি শুরু হয়। এদিক থেকেও বিভিন্ন আওয়াজ হয় এবং আমাদের দিক থেকেও বিভিন্ন আওয়াজের মাধ্যমে আমরা সাবধান বাণী পৌঁছানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, ওদের যত অস্ত্রশস্ত্র ছিল আমাদের তত ছিল না। তারপরও আমাদের বিভিন্ন কৌশল নিতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যায়ে আমাদের তিন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হলেন। লাশ শত্রুপক্ষ নিয়ে নিতে পারে। তাই লাশ পিছনে সরিয়ে দেবারও একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। শহীদদের একজন মঞ্জুর, সে খুব সাহসী ছিল। বারবারই সে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু বারবারই ওকে থামিয়ে দেয়া হয়েছে। সকলের মধ্যে তো সাহসটা একরকম থাকে না। তখন এই মঞ্জুর এবং আরেকজন হবিবুর খুবই সাহসিকতা দেখায়। তারা আমাকে বলছিল যে এই যুদ্ধ আমরা চালিয়ে যাব কি-না। আমি বলেছিলাম- তাদের দিক থেকে গোলাগুলি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। কেননা ওরা যদি গোলাগুলি চালিয়ে যেতেই থাকে তবে পেছনে যেতেও তো আমাদের হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাবে। সেই পর্যন্ত আমরা ক্রমান্বয়ে যুদ্ধটা চালিয়ে গিয়ে পরবর্তীতে যুদ্ধটা শেষ হয়। শহীদ মোনায়েম মঞ্জুর ছিলেন রাজশাহী পলিটেকনিকের ছাত্র। আর শহীদ ইসলাম ছিলেন কাটাখালী মাসকাটাদীঘি স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। আরও এক আদিবাসী যুবক শহীদ হন এই যুদ্ধে। তার পরিচয় জানা যায়নি। এই যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হন সিরাজুল ইসলাম ওরফে হানিফ মৃধা। সে রাতের যুদ্ধের পরেই পাকিস্তানী আর্মি তানোর থেকে পুলিশ বাহিনীসহ সব সরিয়ে নেয়। তখন থেকেই এই অঞ্চল প্রায় মুক্তই বলতে হবে। এরপর ১৭ ডিসেম্বর তানোর থানায় আমি স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলন করি। এটা আমাদের কাছে একটা স্মরণীয় ঘটনা।’ একই যুদ্ধে অংশ নেয়া গুরুতর আহত সিরাজুল ইসলাম মৃধা বলেন, যুদ্ধে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েও বেঁচে রয়েছি। ওরা বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। আমরাও গুলি করছি। কিন্তু আমাদের গুলি কম। তাই আমরা মুখে প্রচার করছি, ‘এই তোর দিকে কতজন আছে?’ উত্তর আসে- ‘৭০’, কেউ বলছে, ‘৮০।’ কিন্তু সংখ্যায় আমরা ৩৫ জনের বেশি ছিলাম না। আওয়াজের সঙ্গে মাইন বিস্ফোরণ করছি। যাতে বিকট শব্দ হয়, ওরা ভয় পেয়ে যায়। যখন যুদ্ধ করছিলাম, ক্রলিং করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিÑ এমন সময় একটা গুলি মাথার কাছে এসে পড়ল। বুঝতে পারছিলাম আহত হয়েছি। আমি বললাম, ‘এডভান্স। এডভান্স না হলে ওরা তেড়ে মারবে। আর এডভান্স করলে কিছু মরবে কিছু বাঁচবে।’ আমাদের গুলিবিদ্ধ চারজনের মধ্যে তিনজন মারা গেল, আমি বেঁচে আছি। কিন্তু থানা আমরা মুক্ত করতে পারলাম। এটাই আমাদের সার্থকতা। তিনি বলেন, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র কম কিন্তু মনোবলটা বেশি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী অঞ্চলের বিভিন্ন গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনা করেন সফিকুর রহমান রাজা। তিনি বলেন, মূলত রাজশাহী ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী আমাকে রাজশাহী সদর উপজেলার গেরিলা লিডার হিসেবে মনোনীত করেন। পরে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষ করে দেশে ফিরে জুলাই মাসের দিকে আমরা রাজশাহী শহরে এবং রাজশাহীর বিভিন্ন থানায় গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য অল্পসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে পবা এলাকা দিয়ে প্রবেশ করি। পবা অঞ্চলে কিছুদিন থাকার পর উত্তরের গোদাগাড়ী, তানোর এলাকায় গেরিলাযুদ্ধের জন্য জনগণের সমর্থন সংগ্রহ করি। কিছুদিন পর আমাদের সাব সেক্টর কমান্ডার গিয়াস উদ্দিন পর্যায়ক্রমে যারা ভারত থেকে মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং শেষ করে ফিরতো তাদের আবার এ অঞ্চলেই আমার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় উনি পাঠাতেন।’ রাজা বলেন, ‘প্রথম যুদ্ধে, রাজশাহী শহরে একটি গ্রুপকে পাঠিয়েছিলাম শুধু গ্রেনেড চার্জ করার জন্য। এপ্রিল মাসে সর্বশেষ ডিফেন্স উইড্রো হলো মহিশালবাড়ি থেকে। জুলাইয়ের শেষ দিকে আমরা ১০/১২ জনের একটা দলকে দিয়ে, শুধু গ্রেনেড নিয়ে- রাজশাহী শহরে পাঠাই। আমরা সে সময় অস্ত্র সরবরাহ পাচ্ছিলাম না। গ্রেনেড চার্জ করার জন্য আমরা প্রথম টার্গেট করেছিলাম রাজশাহী শহরের পিডিবির পাওয়ার হাউস, কোট চত্বরের এই জায়গাগুলোতে আমরা গ্রেনেড চার্জ দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গেরিলাযুদ্ধ যে ফের শুরু হলো এটা একটা সিগন্যাল দিয়েছিলাম। তারপর কিছুদিন পর আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা যারা গেরিলা ও ওয়ারফেয়ার শিখে এসেছিল পর্যায়ক্রমে এসে আমরা বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন অপারেশন শুরু করি। মাঝে মধ্যে আমরা ভারত থেকেও সেক্টর কমান্ডার-৪ মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে বিভিন্ন খ-যুদ্ধও করি। তার ডাক পেলেই আমরা আবার চলে যেতাম ভেতর থেকে। এভাবেও আমরা যুদ্ধ করেছি বিভিন্ন জায়গায়। তবে আগস্টের দিকে আমরা অভয়া ব্রিজ অপারেশনের টার্গেট করে। সেটা ছিল ২২ আগস্ট। যে অভয়া ব্রিজটা অপারেশন তখন নির্ধারণ করা হয়েছিল গোদাগাড়ী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডের উপরে সে ব্রিজটি অবস্থিত।’ রাজার ভাষ্য, মূলত মেজর গিয়াস ঠিক করেছিলেন, রাজশাহী শহর মুক্ত করতে হলে তাদের সরবরাহের লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে। আমাদের অপারেশনে যাবার আগে এ ধরনেরই একটা বর্ণনা দিয়েছিলেন সেদিন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহী লাইনটা কেটে আমরা রাজশাহীতে এ্যাটাক করার জন্য পরিকল্পনা নিচ্ছি, সুতরাং এই কাজগুলো আমাদের পুর্বাহ্নে করে যেতে হবে। তো সেভাবেই আমাদের অভয়া ব্রিজ অপারেশনের টার্গেট হয়েছিল। অপারেশনে ৪০-৫০ মুক্তিযোদ্ধা ওখানে রেগুলার বাহিনীসহ আমরা অংশ নিয়েছিলাম। নেতৃত্বে ছিলেন মেজর গিয়াস। প্রায় মাঝ রাত হয়ে যায় আমাদের টার্গেটকৃত স্থানে পৌঁছাতে। আমাকে মেজর গিয়াস বলে, ‘ব্রিজের ওপর গিয়ে যারা পাহারা দিচ্ছে তাদের অতর্কিতে এ্যাটাক করবে বললেন তাদের পযুর্দস্ত করে আমাকে সিগন্যাল দেবে।’ কিন্তু এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ব্রিজ উড়ানোর আগেই আমাদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বেধে যায়। তারা ফায়ার ওপেন করে। আমরাও ফায়ার করি। দুই পক্ষের মধ্যে তখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। এখানে প্রায় তিন-চার ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। আমাদের এক সহযোদ্ধা শহীদ হয়। সেখানে ওদের ৯ থেকে ১০ জন মারা যায়, যাদের মধ্যে পাক সেনাও ছিল।
×