অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ করদাতারা এখন ঘরে বসেই অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারবেন। এছাড়া করদাতাদের যাতে অহেতুক নাজেহাল না হতে হয়, সে উদ্যোগও নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পাশাপাশি যারা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাদের খুঁজে বের করতে মাঠে নেমেছেন এনবিআরের গোয়েন্দারা।
এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেছেন, করদাতাদের আর নাজেহাল হতে হবে না। যারা কর দেবেন তারা ভাল থাকবেন। আর যারা কর দেবেন না, তারা বিভিন্ন সমস্যায় পড়বেন। তিনি বলেন, করযোগ্য আয় থাকার পরও যারা আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন না, তাদের খুঁজে বের করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এনবিআরের গোয়েন্দারা ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছেন।
আয়কর মেলায় যেভাবে হয়রানি ছাড়াই আয়কর কিংবা বিবরণী জমা দেয়া সম্ভব হয়েছে, সেরকম স্বস্তি বছরজুড়েই চাইছেন করদাতারা। পাশাপাশি করদাতাদের হয়রানি বন্ধে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি ও এনবিআরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আরও মানবিক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এ্যাসোসিয়েশন অব গ্রাসরুটস উইমেন এন্টারপ্রেনার্স বাংলাদেশের (এজিউইবি) প্রেসিডেন্ট মৌসুমী ইসলাম। তিনি বলেন, যারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারকে কর দিচ্ছেন, তাদের নানাভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে। দেশের মানুষ আনন্দের সঙ্গে কর দিতে চায়। কিন্তু দেশে এখনও সেই পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। বরং কর যারা ফাঁকি দিচ্ছেন তারা ভাল আছেন। আমরা যারা নিয়মিত কর দিচ্ছি, তাদের অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়েছি।
নিয়মিত করদাতা মোস্তফা আনোয়ার বলেন, ২০১৬ সালের মার্চে তার ব্যক্তিগত আইনজীবী তাকে জানিয়েছিলেন, তার আয়করের ফাইল দৈব চয়নের তালিকায় নেয়া হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে এনবিআরের তৃতীয় শ্রেণীর এক কর্মচারীর হাতে ২০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে দৈব চয়নের হাত থেকে রক্ষা পান তিনি। মোস্তফা আনোয়ার জানান, এর আগে তার ফাইল দৈব চয়নে ফেলে নানা ধরনের কাগজপত্র চেয়েছিলেন এনবিআরের সংশ্লিষ্ট সার্কেলের কর্মকর্তারা। তখন লক্ষাধিক টাকার বিনিময়ে রফা করেছিলেন তিনি। এরপর আরও দুবার ঘুষ দিয়ে দৈব চয়ন (র্যানডম সিলেকশন) থেকে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। করদাতাদের অহেতুক হয়রানির শিকার হওয়ার অভিযোগ স্বীকার করে এনবিআরের কর্তা-ব্যক্তিরা জানান, এ অবস্থার অবসানে তারা অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আয়কর বিবরণী বা রিটার্ন দাখিলের ফাইল অডিটের ভয় দেখিয়ে কিছু দিন আগেও করদাতাদের অহেতুক হয়রানি করছেন মাঠ পর্যায়ের কিছু কর কর্মকর্তা। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে করদাতাদের হয়রানির একটা কালচার ছিল। কিন্তু এখন ঠিক তার উল্টো। তিনি বলেন, করদাতাদের হয়রানির বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। এখন মানুষ আগ্রহের সঙ্গে আয়কর রিটার্ন জমা দেয়।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, আগে রিটার্ন জমা দিতেও ঘুষ দিতে হতো। কিন্তু চলতি বছরে কর দিতে তেমন ঝামেলা হয়নি। এই ধারা অব্যাহত রাখতে এনবিআরকে আরও জোরালোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, এখনও যারা কর দিচ্ছেন, তারা নানাভাবে নাজেহাল হচ্ছেন। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, যারা কর দেবেন তারা ভাল থাকবেন। এই নিশ্চয়তা এনবিআরকেই দিতে হবে। কেবল কথার মধ্যে না রেখে বাস্তবে এটা প্রমাণ করতে হবে। করদাতাদের নাজেহাল থেকে মুক্তি দেয়ার যে ঘোষণা এনবিআর চেয়ারম্যান দিয়েছেন, সে কারণে তাকে সাধুবাদ জানাই। এনবিআর চেয়ারম্যানের ইতিবাচক চেষ্টা করদাতাদের উৎসাহিত করছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, করদাতাদের অহেতুক হয়রানি করা হবে না। এমনটিই হওয়ার কথা। তবে বাস্তবে তা হয় না। করদাতাদের অহেতুক হয়রানি হওয়ার যে ভয় এখনও আছে, তা দূর করার দায়িত্ব এনবিআরের। একইভাবে যার কর দেয়ার কথা ১০ কোটি টাকা, তিনি যদি এক লাখ টাকা কর দিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করেন, সেটিও এনবিআরের দেখার কথা। এছাড়া ঘুষ প্রথা বন্ধ হওয়া জরুরী। তিনি বলেন, হয়রানি বন্ধ হলে, ঘুষ প্রথা বন্ধ হলে কর দেয়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে। নতুন নতুন করদাতা যুক্ত হবে।
প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরের ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ২ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা আদায় করবে এনবিআর। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ করবর্ষে সবমিলিয়ে সাড়ে ১১ লাখ করদাতা রিটার্ন জমা দিয়েছেন। এই সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৪০ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। এছাড়া ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের কাছ থেকে মোট আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৩৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকা। আদায়ের পরিমাণ বেড়েছে ২০৭ শতাংশ। রিটার্ন দাখিলের জন্য সময় বাড়াতে ১ লাখ ৫১ হাজার ৮৮৯ জন করদাতা আবেদন করেছেন। যেসব করদাতা সময় চেয়ে আবেদন করেছেন, তাদের নির্ধারিত করের ওপর প্রতি মাসে ২ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে।